তুলিন। পুরুলিয়া।
পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

তুলিনের সুবর্ণরেখা আর বনডি পাহাড়ে সূর্যাস্ত

দীপক দাস

আর একটু হলে শিব্রাম চক্রবর্তীর গল্প হয়ে যাচ্ছিল। ঠিকঠাক মনে নেই। দার্জিলিংয়ের গল্প ছিল বোধহয়। এমনিতেই শিব্রামের পাহাড়ে উঠতে আপত্তি। আলস্যই মূল কারণ। যদিও মুখে বলেন, উঠে কী হবে? সেই তো নেমে আসতে হবে! আপাত দৃষ্টিতে পাহাড়ে ওঠা নামার সহজ কথা মনে হলেও ‘সিধি বাত’ নয় মোটেই। সম্ভবত চুড়োয় ওঠার জন্য মানুষের হাঁচড়পাঁচড়ের মনোভাবকে ব্যঙ্গ করেছিলেন। মুখে যাই বলুন, গল্পে আছে, সূর্যোদয় দেখতে পাহাড়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু কী আশ্চর্য! সূর্য যে উঠেই নামতে শুরু করল! বিস্ময়ে অন্য পর্যটকদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন সূর্যের এমনতর ব্যবহারের কারণ জানতে। তাঁরা ভুল ভাঙান, সূর্যাস্তে সূর্য নামবে না তো কি উঠবে! আসলে ঘুমকাতুরে শিব্রাম ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ফলে সকালের বদলে পাহাড়ে উঠেছিলেন বিকেলে।

আমি এতটা ঘুমকাতুরে নই। তবে সুযোগ পেলে চোখ বুজে আসে। তাই সূর্যাস্ত দেখতে উঠে একটা চওড়া পাথর পেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সূর্যাস্তের তখনও কিছুটা বাকি ছিল। রাতে ট্রেনে ভাল ঘুম হয়নি। তার উপর একটু আগে এক পাহাড় চষে এখানে এসেছি। ক্লান্ত লাগছিল। খানিক বিশ্রাম নিতে পাথরে পিঠ পেতেছিলাম। কখন চোখ বুজে এসেছিল! বাবলা পরে বলেছে, নাকও নাকি ডাকছিল ফুরফুর করে। মিনিট দশেক আগে ডেকে দিয়েছিল তাই। না হলে অসাধারণ দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হতাম।

তুলিনের সুবর্ণরেখা।

এসব ঘটনা পুরুলিয়ার তুলিনে। এ বছর পুজোর সময়। আমাদের দলের ঐতিহ্য অনুযায়ী ঘুরতে এসেছি দুর্গাপুজোর দিনে। দিনটা সপ্তমী। তুলিনের অটোচালক ক্যাবলাদা আমাদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। ঝালদা পেরিয়ে নোড়াহারা জলাধার, নরহরা ঝরনা দেখে ফিরছিলাম তুলিনে। পরের গন্তব্য ছিল সুবর্ণরেখা নদী। সেখান থেকে ফিরে সূর্যাস্ত পয়েন্টে আসা।

তুলিন দুই রাজ্যের সংযোগকারী গ্রাম। পশ্চিমবঙ্গ তথা পুরুলিয়ার শেষ গ্রাম। এর পরেই শুরু হয়েছে ঝাড়খণ্ড। সুবর্ণরেখা বয়ে যাচ্ছে দুই রাজ্যের সীমানা দিয়ে। এখানে স্বর্ণরেণুর নদীটি ক্ষীণস্রোতা। নদীখাতে বড় বড় পাথর। সেসবের উপর দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে নদী চলেছে। ওপারে বিশাল অ্যালুমিনিয়ামের কারখানা।

সেতু তৈরির সমান পাথরের বাধা বেয়ে জল পড়ছে। খাবারের সন্ধানে পাখির দল।

নদীর সৌন্দর্য বিকশিত হয় তার জলধারায়, চড়ায়, তীরের গাছপালায়। সুবর্ণরেখাকে অনেক জায়গায় দেখেছি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে। ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ছাড়িয়ে রাতমোহনায়, রাখামাইনসের কাছে, যাদুগোড়ায় রঙ্কিণীদেবীর মন্দিরে যাওয়ার পথে সিদ্ধেশ্বর পাহাড়ের চুড়ো থেকে। আর এখানে। ছবিতে দেখেছি ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রামে। প্রতি জায়গায় রূপ আলাদা। প্রতি জায়গায় রূপের কারণ আলাদা। ভাললাগা আলাদা। এর মাত্রাভেদ করা যায় না। সিদ্ধেশ্বর পাহাড়ের উপর থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা নদীটি রাতমোহনায় চুনাপাথরের খণ্ডগুলো বুকে নিয়ে থাকা জলধারাটি অন্যরকম সুন্দর। ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরে হাতিবাড়ি যাওয়ার পথে এবং হাতিবাড়িতেও সুবর্ণরেখা রয়েছে। সে-ও আলাদা রূপ।

তুলিনের সুবর্ণরেখা উপলময়। অনেকটা রাতমোহনার মতো। তবে পাথরের পার্থক্য আছে। আকারে এবং প্রকারে। তুলিনের নদীর উপরে কাছাকাছি দু’টো সেতু। একটা ভাঙা। কোনও একসময়ে ছিল ওপারের যোগসূত্র। এখন আরেকটু এগিয়ে নতুন সেতু হওয়ায় হয়তো পুরনোটির দিন গিয়েছে। ভাঙা সেতুর নীচে সমান পাথরের বাধা। মনে হয়, সেতু গড়তে এই পাথর বসানো হয়েছিল। সমান পাথরের গা বেয়ে নদীর জল গড়িয়ে পড়ছে। পাথরগুলোর উপরে বক ও অন্য পাখির দল খাবারের সন্ধানে। ভাঙা সেতুর ওদিকটায় শরতের শুকিয়ে আসা কাশফুলের ঝাঁক। নদীর দু’পারেই প্রচুর গাছপালা। বড় বড় গাছও আছে। আমরা যেদিকটায় দাঁড়িয়েছিলাম সেদিকে একটা শ্মশান। শ্মশানের পরে বালির চরা। তার পর বড় বড় পাথর। পাথরের পরে জল। সেই জলেও পাথর।

প্রকৃতির খেয়াল। বনডি পাহাড়ে।

অনেকক্ষণ ছিলাম আমরা। ক্যাবলাদা বললেন, তুলিনের এই গ্রামে লাক্ষা চাষ হয়। কুটীর শিল্পের মতো। অনেক বড় ব্যবসায়ীও আছেন। কলকাতায় এখান থেকে গাড়িতে লক্ষা সরবরাহ করা হয়। ফেরার সময়ে সুবর্ণরেখা ছাড়িয়ে একটুখানি এসেছি। রাস্তার পাশে ধানজমি। দূরে জঙ্গল। হঠাৎ ট্যাঁ ট্যাঁ করে আওয়াজ আর ডানার শব্দ। অটোর আওয়াজে ধানজমি থেকে এক ঝাঁক টিয়াপাখি উড়ে গেল। গিয়ে বসল জঙ্গলের গাছে। ধান প্রায় পেকে এসেছে। দল বেঁধে ধান খাচ্ছিল পাখিগুলো। আমাদের বেশ লাগল। চাষিদের কেমন লাগে কে জানে!

পরের গন্তব্য বনডি। তুলিনেরই একটা গ্রামের নাম। গ্রামের নামেই পাহাড়। বড় রাস্তা থেকে ভিতর দিকে গ্রাম। সেদিন ছিল হাটবার। রাস্তায় হাটুরে লোকের যাতায়াত। সেসব পেরিয়ে রাস্তা থেকে ডানদিকে বেঁকে গেল ক্যাবলাদার গাড়ি। পাহাড়ের গোড়ায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে ক্যাবলাদা চলে গেলেন। কোনও কাজ আছে। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ৫.১৬ সূর্যাস্ত। আর দেখিয়ে দিলেন কোন পাথরের চাঁইয়ে উঠলে সূর্যাস্ত ভাল দেখা যাবে। আমরা উঠতে শুরু করলাম।

পাহাড়ের উপর থেকে রাস্তা ও বসতির দিকে।

এ জায়গায় লোকজনের যাতায়াত আছে। পাহাড়ে ওঠার জঙ্গুলে পথের পাশে প্লাস্টিকের গ্লাস, কাচের বোতল পড়ে আছে। মদ এ রাজ্যে সর্বত্রচারী হয়ে উঠেছে দেখছি।

কিছুটা ওঠার পরে একটা চত্বর মতো মিলল। বড় চ্যাটাল পাথরও ছিল। আরও বেশ কিছুটা চড়লে সূর্যাস্ত পয়েন্ট। কে যেন বলল, এখনও তো দেরি আছে সূর্য ডোবার পালা আসতে। এখানে একটু বসা যাক। ইন্দ্রই বলেছিল মনে হয়। ও এর পরই ঘোষণা করেছিল, আর পাহাড়ে চড়বে না। আমাদের জন্য এখানেই অপেক্ষা করবে। চ্যাটাল পাথরটায় আমি আর বাবলা বসলাম। ইন্দ্র ফোনে কথা বলতে শুরু করল। দাঁড়িয়েই। প্রতি সফরেই দেখেছি, মাঝে মাঝেই ফোনে খুটখাট করে। কাকে বা কাদের যেন আপডেট দিতে হয়। সেই রকমই বলেছিল আমাদের। এখন চলা থামিয়েছি। তাই ফোন শুরু। ছোটা ডন আর আমি খোঁচাচ্ছিলাম ওকে। তার পর জুতো জোড়া মাথায় দিয়ে পাথরটায় পিঠ পেতেছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে নাক ডাকতে শুরু করেছিলাম!

পাহাড়ের আরেক দিক। আকাশে রাঙা আলোর ছটা।

ঘুম ভেঙেছিল বাবলার ডাকে, ‘‘চলো চলো, বেশি সময় আর নেই।’’ তাড়া দিচ্ছিল ছোটা ডন। ইন্দ্র তখনও ফোনে কথা বলছে। ওকে রেখেই আমরা উঠতে শুরু করলাম। পুরো জায়গাটা জংলা গাছে ভর্তি। ঝোপঝাড়ের মাঝে পাথর বেছে ওঠা। উপর দিকে বোধহয় লোকজন কম ওঠে। পথে আবছা চলার রেখাও নেই। কিছুটা উঠে একটা পাথরের উপরে দাঁড়ালাম। উপর থেকে কী অসাধারণ দৃশ্য। মনে পড়ে যাচ্ছিল সিদ্ধেশ্বর পাহাড়ের চুড়ো থেকে দেখা উপত্যকার কথা। যে দিকটা দিয়ে চাতালের কাছটায় উঠেছিলাম সেদিকে রাস্তা, পথচারী খুদে খুদে লোকজন, গাছপালার মধ্যে দেখতে পাওয়া বাড়িঘর— অনন্য ক্যানভাস। আমরা যে পাথরের কাছে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম সেই দিকটায় প্রচুর গাছপালা। সবুজ উপত্যকা। পশ্চিম দিকে সবুজ প্রান্তরের শেষে অস্তগামী সূর্যে রক্তিম আকাশ অন্যরকম সৌন্দর্য তৈরি করেছিল। ওদিকে অনেকগুলো পাহাড় চুড়ো মাথা তুলে আছে। জঙ্গলের মাঝে মাঝে চাষের জমিগুলো ফিকে সবুজ হয়ে জেগে। একটা সুন্দর বৈপরীত্য তৈরি করেছে।

দিনমণি অস্তাচলের পথে।

দুর্গাপুজোর সময়েই তুলিনে ঠান্ডার আমেজ এসে গিয়েছিল। সূর্যের জোর কমতেই তাই একটা ফিনফিনে কুয়াশার চাদর। ওটাই সৌন্দর্যের পথে বেশ বাধা। বাবলা বলল, ‘‘আরেকটু আগে উঠলে বোধহয় ভাল হত।’’ বুঝলাম, আমার ‘পাওয়ার ন্যাপে’র আরামে প্রকৃতি দর্শনের আনন্দ কমেছে। আরও একটা জিনিস মনে হল, আরেকটু উঁচুতে আরেকটা পাথর। ওখানে উঠতে পারলে আরও ভাল দেখাবে সূর্যাস্ত ও উপত্যকা। উঠলাম। উপত্যকার রূপ আরেকটু খুলল বলেই মনে হল। কিন্তু একটা মুশকিলও হল। একটা গাছ আর পাথরের বিশাল চাঁই দৃষ্টিপথের বাধা হচ্ছিল।

কিন্তু ওই পাথরে ওঠা এই সন্ধের আগে বেশ মুশকিল। ওঠার পুরো পথটা ঝোপঝাড়ে ভাল মতো ঢাকা। পথ খুঁজে নেওয়া যাবে। কিন্তু বেগ দেবে। পুরোপুরি শীত এখনও পড়েনি। সাপখোপও থাকতে পারে। তা ছাড়া ঝোপজঙ্গল পার করে পাথরে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। পাহাড়ি অঞ্চলে সূর্য ডুবে গেলে ঝুপ করে সন্ধে নামে। নামার সময়ে বিপাকে পড়তে পারি।

তিনি ডুবিলেন। ডানদিকের পাথরটায় চড়ার ভাবনা ছিল।

যেখানে ছিলাম দু’জনে রয়ে গেলাম সেখানেই। সূর্য তখন একেবারে গাছপালার সবুজ প্রান্তরেখায় ঠেকেছে। পশ্চিম দিগন্ত পুরো সিঁদুর রাঙা। তার উপরের অংশ নীল। এত ভাল লাগছিল। এমন সুন্দর পরিবেশে আমার কোনও ভ্রমণ সাহিত্যের বিখ্যাত সূর্যোদয় মনে পড়ল না। মনে এল একটা কার্টুনের কথা। পু বেয়ারের কার্টুন। পু আর তার বন্ধুরা এরকম একটা পাথরে বসে সূর্যাস্ত দেখত মনে দিয়ে। ইন্দ্রটা আমাদের সঙ্গে উঠলে আমরা সেরকম ভাবেই বসে থাকতাম। অস্তমিত সূর্যের দিকে চেয়ে। এরকম যখন ভাবছি, তখনই একটা চিৎকার শুনতে পেলাম। একটা ছেলে সেই আমাদের উঠতে না পারা পাথরের উপর থেকে চিৎকার করছে। উল্টো দিক দিয়ে উঠেছে মনে হয়। এখন চিৎকার করে কাউকে নামার পথ জিজ্ঞাসা করছে।

সূর্য ডোবার পালা সাঙ্গ হল। দর্শক আমরা নামতে শুরু করলাম। সেই নেমে আসা। শিব্রামের সেই অমোঘ উক্তি।

ছবি— ইন্দ্র, বাবলা

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *