দ্বারকা মিষ্টান্ন ভান্ডার।
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

হালুয়া নয়, কাঁচা ছানার মোহনভোগ

দীপক দাস

পথে নেমেছিলাম মিষ্টি-চাকির চক্করে। চাকি চক্রে মিলল মধুর গোল্লা। মোহনভোগ নাম তার। আচমকাই সন্ধান। আমার অনুপ্রেরণা ‘যেখানে দেখিবে ছাই’। মিষ্টির দোকানের শোকেস দেখি তাই। তাতে অমূল্য রতনের মতো মাঝে মাঝে মিষ্টি-মোহন মেলে। আরেকবার প্রমাণ পেলাম।

‘রামকৃষ্ণচাকী’র সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। নামটা মেলে হরিপদ ভৌমিক মহাশয়ের লেখা থেকে। এক ধরনের সন্দেশ। প্রাপ্তিস্থান বাগবাজারে রাজা রাজবল্লভ স্ট্রিটের মোড়। তবে সময়কালটা বেশ পুরনো। প্রায় টাইম মেশিনে চড়ে খোঁজার মতো কালের। তাতে কী! এলাকায় গেলে অনেক কিছু মেলে। সম্পর্কিত কাহিনিও। অনেক সময়েই তা পল্লবিত। চেষ্টা করলে সেই পল্লবের ফাঁকে মুকুলেরও সন্ধান মিলতে পারে।

কিন্তু বাগবাজার লঞ্চ ঘাট থেকে রাজবল্লভ স্ট্রিট পর্যন্ত পদযাত্রায় কিছুই মিলল না। একাধিক দোকানদার এবং পথচারীদের জিজ্ঞাসাবাদেও নয়। শেষে এক স্থানীয় ব্যক্তি জানালেন, এখানে পুরনো যে মিষ্টির দোকানটি ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তিনি শ্যামপুকুর স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যেতে বললেন।

শ্যামপুকুর স্ট্রিটে কাছাকাছি তিনটি মিষ্টির দোকান। একটা মূল রাস্তার পাশে। আর দু’টো মূল রাস্তা থেকে ডান দিকে ফড়িয়াপুকুরের দিকে বাঁক নেওয়া রাস্তার শুরুতেই। পাশাপাশি। তিনটি দোকানের অবস্থান মোড়ের এদিক ওদিক। মোড়ের এদিকে খোঁজ নিয়েছিলাম। শোনেননি জানালেন দোকানের কর্মীরা। পাশাপাশি দু’টির একটি দোকান বন্ধ। খোলাটার শোকেসের সামনে দাঁড়ালাম। দ্বারকা মিষ্টান্ন ভান্ডার। ভান্ডারি তরুণটি রামকৃষ্ণচাকীর সন্ধান দিতে পারলেন না। কী আর করা! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোকানের শোকেস অবলোকন ছাড়া! এই দোকানের একটা সুবিধে ট্রেতে মিষ্টির দামের সঙ্গে নামও লেখা ছিল। এতে কাজের কাজের সুবিধে হয় উভয়েরই। আমাকে বারবার ‘এটা কি মিষ্টি?’, ‘ওটার কী নাম?’ জিজ্ঞাসা করতে হয় না। কাজের মাঝে জিজ্ঞাসায় দোকানদারের বিরক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।

দ্বারকা মিষ্টান্ন ভান্ডার
শোকেসে আলো করে আছে মোহনভোগ।

দ্বারকায় রকমারি মিষ্টি। ছানার আঙুর, ক্ষীরকদম্ব, ক্ষীরের পটল। আরও নানা চেনা মিষ্টি। চোখ আটকাল মোহনভোগ নামে। দু’রকম মোহনভোগ জানি। এরকম তো দেখিনি। দামেও বেশ। ২০ টাকা। খেলাম একটা দারুণ খেতে। উপরে কাঁচা ছানার একটা প্রলেপ। সেটি একটি রসগোল্লাকে জড়িয়ে আছে। রসগোল্লার রংটা ঠিক সাদা নয়। হালকা বাদামি। এই বৈশিষ্ট্যও আলাদা রকম। খেয়ে হাত ধোয়ার সময়ে আরেকটা বিষয় চোখে পড়ল। ধোয়ার পরেও আঙুল চটচট করছে। মানে ছানা খাঁটি। তার মাঠা বা ঘিয়ের জন্য এমনটা হচ্ছে।

কাঁচা ছানার এমন মিষ্টি আগে খাইনি। মনে তো পড়ছে না। তাছাড়া নামটাও বেশ। কিন্তু দোকানে যিনি ছিলেন তিনি কিছু বলতে চাইছিলেন না। মালিকের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। মানে তিনি দ্বারকার ভান্ডারি নন। কর্মীটি মালিকের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরও দিতে চাইলেন না। দিলেন দোকানের ল্যান্ডলাইন নম্বর। বিকেল ৫-৭টা পর্যন্ত পাওয়া যাবে মালিক দিব্যেন্দু ঘোষ দোকানে থাকেন। গোপাল নামেই বেশি পরিচিত। মালিকের সঙ্গেই কথা বলব। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে একটা ধারণা পেলে মালিকের সঙ্গে কথা বলতে সুবিধে হবে।

একটা ধারণা পেয়েছিলাম সেদিন। প্রথমে রসগোল্লা তৈরি করে নেওয়া হয়। একটু ছোট আকারের। তার পর রস নিংড়ে গরম দুধে ভেজানো হয়। এর পর ওই রসগোল্লার উপরে দেওয়া হয় কাঁচা ছানার চাদর। চাদরের উপরে থাকে একটা পেস্তা বাদাম।

কাঁচা ছানার চাদর আর রসগোল্লার গুটি আলাদা করা যাচ্ছে রঙেই।

কিছুদিন পরে ফোন করেছিলাম দোকানের নম্বরে। ধরেছিলেন দিব্যেন্দুবাবুর ছেলে ঋষভ ঘোষ। অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল সেদিন। ঋষভ ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন। এখন বাবার দোকান সামলাচ্ছেন। মিষ্টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা আছে। মিষ্টির জগৎ ও ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনাও। মিষ্টিতে বিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে ভাবেন। শ্রদ্ধা আছে নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি। জাতিতে গোপ অর্থাৎ গোয়ালা। বাবার দুধের ব্যবসা আছে। মিষ্টান্ন জগতের অন্যতম কিংবদন্তি দ্বারিক ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা ফুটে উঠল কথায়। জানালেন, তাঁর আইডল গোপ জাতির উজ্জ্বল পুরুষ দ্বারিক ঘোষ। দ্বারিক ঘোষের বিষয়ে একটা ঘটনাচক্র রয়েছে। ঋষভবাবুদের দোকান দ্বারকার ঠিকানা ৭৭ বি শ্যামপুকুর স্ট্রিট। এই ৭৭ শ্যামপুকুরেই ছিল দ্বারিক ঘোষের প্রথম দোকান। এখান থেকেই তাঁর মিষ্টি সাম্রাজ্য তৈরি। আসলে এই ৭৭ নম্বর ছিল জমিদার নন্দনদের সম্পত্তি। দ্বারিক ঘোষ এঁদের ভাড়াটে ছিলেন। শরিকের ভাগাভাগিতে এর দু’টি অংশ হয় ৭৭এ এবং ৭৭বি। ১৯৬০ সালে নন্দনরা সম্পত্তি বিক্রি করেন। ৭৭বি কেনেন ঋষভবাবুর ঠাকুরদা মুক্তকিশোর ঘোষ।

দোকানের দ্বারকা নাম আর পদবি ঘোষ দেখে অনেকে ঋষভবাবুদের দ্বারিক ঘোষের পরিবারের লোক ভাবেন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একটা যোগাযোগ বহুদিনের। দ্বারিকের ছেলে নিশিকান্ত, অবলাকান্তদের দুধ সরবরাহ করতেন ঋষভবাবুর ঠাকুরদা। তাঁর পরে দুধ দিতেন ঋষভবাবুর বাবা। দ্বারকা নামের উৎপত্তি শ্রীকৃষ্ণের সূত্রে। প্রথমে দোকানের নাম ছিল মথুরাপুরী। দুই তীর্থক্ষেত্র অনুসারে নাম। কৃষ্ণভক্ত ঘোষ পরিবারের ইষ্টদেবতা জগন্নাথ। তাই কৃষ্ণের মথুরা আর জগন্নাথদেবের পুরী। পরে দোকানের নাম হয় দ্বারকা। কৃষ্ণের রাজ্য এবং জগন্নাথদেবের রথের সারথির নামও দ্বারকা (আসলে দারুক)। দ্বারকা বছর পনেরোর দোকান।

ঋষভবাবুদের নিজস্ব ডেয়ারি রয়েছে। দোকানের মিষ্টি তৈরি হয় ডেয়ারির দুধেই। এবার বোঝা গেল কেন মোহনভোগ খাওয়ার পরে হাত ধুলেও আঙুলে ঘি লেগে থাকে। দুধ খাঁটি, ছানাও। কিন্তু মোহনভোগের উৎস কী? ঋষভবাবু বাবার থেকে জেনেছিলেন। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই চত্বরে কাঁচা পাকের সন্দেশ প্রথম তৈরি করেছিলেন দ্বারিক ঘোষ।। সেখান থেকে ধারণা নিয়েছেন। তাছাড়া বিভিন্ন বড় দোকানের ভিয়েন ঘরের দুধ দেওয়ার সূত্রে যাতায়াত ছিল ঋষভবাবুর বাবার। ঢুকতে পারতেন দোকানের ভিয়েন ঘরেও। ঋষভবাবুর কথায়, পাকপ্রণালী টপ সিক্রেট ব্যাপার। সেটা তো কেউ বলবে না। বাবা দেখেশুনে ধারণা তৈরি করে নিয়েছিলেন। তার পর কাজ করতে করতে আরও নিখুঁত করা হয়েছে।

দ্বারকায় পাওয়া যায় ক্ষীরের পটল।

একটা ভুল ভাঙালেন ঋষভবাবু। আমি বারবার মোহনভোগকে রসগোল্লার চাদরে জড়ানো মিষ্টি বলছিলাম। উনি বললেন, ‘‘রসগোল্লা নয়। রসগোল্লার গুটি। ক্ষীরকদমের ভিতরে থাকে ক্ষীরকদমের গুটি। এগুলো মোটা রসের হয়। তাই মিষ্টান্ন কারিগরদের পরিভাষায় একে মোটা মাল বলে।’’ মিষ্টির জগতে গুটি নাম হলেও প্রকরণে কিন্তু এটা রসগোল্লাই। মোহনভোগের গুটি সাদা হয় না কেন? ঋষভবাবু জানালেন, আগে রসগোল্লার গুটি সাদাই হত। কিন্তু তাতে একটু সমস্যা ছিল। ছানার চাদর সাদা। গুটিও সাদা। ফলে খদ্দের বুঝতে পারতেন না চাদর আর গুটি আলাদা রকমের। তাই একটু ক্যারামেলাইজ় করে গুটিটা হালকা বাদামি করা হয়েছে। ক্যারামেলাইজ়েশন একটা বিক্রিয়া। মোহনভোগের রসগোল্লার গুটি মোটা রসে ফোটানো হয়। গোল্লার রং সাদা রাখতে হলে হাই মেরে অর্থাৎ ডাবু দিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে ঠান্ডা করতে হয়। তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হলে ক্যারামেলাইজ়েশন হবে না। রংটা সাদা থাকবে। কিন্তু এই গুটি তৈরিতে হাই মারা হয় না। রেখে দেওয়া হয় আপনা আপনি ঠান্ডা হওয়ার জন্য। ঠান্ডা হতে ৫-৬ ঘণ্টা সময় লাগে। চিনির রস যত ঘন হয় তত তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে। এই তাপেই রসের চিনি ক্যারামেলাইজ়েশন হয়ে বাদামি রং ধরে।

মোহনভোগ নামে কিন্তু মিষ্টিমহলে নানা মিষ্টান্ন রয়েছে। প্রত্যেকেই একে অপরের থেকে আলাদা। একটা মোহনভোগ তো হালুয়া। বাড়িতে তৈরি করেও অনেকে খেয়েছেন।

কভারের ছবি— মোহনভোগ

ছবি- লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *