ঝাড়খণ্ড
জলযাত্রা পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

৭০০ সিঁড়ির হুড্রু জলপ্রপাতে

দীপক দাস

প্রতিটা ধাপে পা ফেলছি আর গুরুদেবের কথা মনে পড়ছে। হে রসরাজ, তোমার এ কী রসিকতা! চুড়োয় ওঠা কেন উচিত নয় তার ব্যাখ্যান করেছ। কিন্তু নামার বিষয় নিয়ে কোনও বাণী দাওনি কেন? নামাটাও খুব কষ্টের। যারা ওঠে তাদের নামতে হয়। যারা নামে তাদের কষ্ট কম নয়।

কষ্টটা বেশ বুঝতে পারছিলাম হুড্রু জলপ্রপাত দেখতে গিয়ে। আমাদের গাড়ির চালক সোনু, যার ভাল নাম বিজয় সিংহ, বলছিলেন, ৭০০টা সিঁড়ি কিন্তু। ওঠার সময়ে খুব কষ্ট। ওঠার কষ্টের কথা আমরা সকলেই জীবন দিয়ে জানি। সেই জন্যই শিব্রাম চকরবরতী, আমার গুরুদেব, বলে গিয়েছিলেন, লোকে কেন হাঁচড়পাঁচড় করে চুড়োয় ওঠে কে জানে! সেই তো নেমে আসতে হয়। বড় দার্শনিক ভাবনা। জন্মিলে মরিতে হবের মতোই উঠিলে নামিতে হবে। কিন্তু নামিতেও যে খুব কষ্ট!

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ের দৃশ্য।

এ বারের দুর্গাপুজোর সময়ে তুলিনে গিয়েছিলাম। পুরুলিয়ার নির্জন জনপদ। সেখান থেকে ঝাড়খণ্ডের পতরাতু উপত্যকা। ফেরার সময়ে হুড্রু জলপ্রপাত। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি। সেই কিশলয়ে পড়া ‘ডুডুমার ডাক’ আর বড়দের মুখে শোনা হুড্রু জলপ্রপাত। তুলিন থেকে ঝাড়খণ্ডের রাস্তা যে কী মনোরম! পতরাতু থেকে হুড্রুর রাস্তাও দারুণ। এত গাছপালা, এত সৌন্দর্য মনে হয় গাড়ি চলুক। আমরা অনন্ত পথের সওয়ারি হই। বাস্তবে তো তা হওয়ার নয়। ভাড়ার গাড়ি। আমাদের ঘরে ফেরার ট্রেনের তাড়া। তাই গাড়ি একসময়ে হুড্রুর দিকেই বেঁকে গেল। সেতুর উপরে রাস্তা থেকে দেখতে পেলাম পাহাড়ি পথে বয়ে একটি ধারা।

বেশ কিছু সিঁড়ি বেয়ে নামার পরে এরকম একটা সমতল জায়গা মেলে। যেখানে পায়ের কাঁপুনি থেমেছিল লেখকের।

নামী পর্যটন কেন্দ্র। দোকান পসরায় জমজমাট। পুজোর ছুটিতে বেশ ভিড়। গাড়ি রেখে সোনু আমাদের জলপ্রপাতের কাছে নামার সিঁড়িটা দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে উধাও হয়ে গেলেন। প্রায়ই আসেন। তাই হয়তো। আমরা তিনজনে নামতে শুরু করলাম। ইন্দ্র, বাবলা আর আমি। সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে কাঠের কাজের শিল্পীরা জিনিসপত্র বিক্রি করছেন। কেউ কেউ অন্য হাতের কাজও। কিছুক্ষণ নামার পরে মনে হল, পা যেন কাঁপছে। একটানা সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বাঁ পা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। সঙ্গীদেরও কি একই অবস্থা? জিজ্ঞাসা করতে ভরসা হল না। ইন্দ্র ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট। বাবলা নিয়মিত খেলাধুলো করে। ওদের যদি কিছু না হয় আমাকে বুড়ো বলে খোঁচা দেবে। মুখে যতই ‘হ্যাঁ আমি বুড়ো’ বলে পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করি না কেন, কোথায় যেন ব্যথা লাগে।

ইনিই হুড্রু। এর আকর্ষণেই আসা।

কাঁপুনি ধরা পা নিয়েই নামতে শুরু করলাম। আর মনে মনে শিব্রামকে দোষারোপ করতে থাকলাম। ফেরার সময়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দম বেরিয়ে যাবে বুঝতেই পারছি। এর আগে বামনি ফলসে নেমেও ইন্দ্র, গার্ডবাবু আর আবার দম বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওঠা তো দূরের কথা। নামতেই তো বেগ পেতে হচ্ছে। থেমে, ছবি তুলে ধীরে ধীরে পৌঁছলাম জলপ্রপাতের কাছে। সেখানে মেলাই ভিড়। দোকানদানি রয়েছে। রয়েছে জলপ্রপাতকে পিছনে রেখে ছবি তোলার ব্যবস্থাও। ভাবছিলাম, এখানকার ব্যবসাদারদের কথা। রোজ তো এই ৭০০ সিঁড়ির চড়াই উতরাই টপকাতে হয়! পায়ের কী জোর রে বাবা!

ধারাপাতের জলে তৈরি জলাশয়। এর পাড়ের পাথরের কাছে চলে গিয়েছিলেন কমবয়সি কয়েকজন।

পর্যটন দফতর থেকে কিছু কর্মীর ব্যবস্থা করা হয়েছে জলপ্রপাতের কাছে। মাঝে মাঝেই ফুররর… করে বাঁশির আওয়াজে মালুম হল। কেন বাঁশি? এদিক ওদিক তাকাতে দেখি, কিছু কমবয়সি ঢাল বেয়ে নেমে জলপ্রপাত যেখানে আছড়ে পড়ছে তার কাছাকাছি চলে গিয়েছে। এই অসম সাহসীরা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে বিপদ ঘটান। তরুণ তুর্কি তো সব! দেখব এবার জগৎটাকে বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পর বিপদ ঘটিয়ে বাড়ির লোকের এবং পর্যটন কেন্দ্রের দুর্দশার কারণ হয়। এই সব পায়তাড়া লোকজনের নিজস্বীর ভিড়ের পাশ দিয়ে আমরাও জলপ্রপাত দেখতে শুরু করলাম।

তৈরি হচ্ছে কাঠের শিল্পকর্ম।

হুড্রু সুবর্ণরেখা নদীর উপরে এক জলপ্রপাত। সেই সেতু থেকে দেখা ধারাই খাড়া পাহাড় থেকে লাফিয়ে জলপ্রপাত তৈরি করেছে। অনন্তকাল ধরে ধারাপাতে পাথর ক্ষয়েছে। হয়তো কিছু খসে পড়েছে নীচে। পাহাড়ের উপরে জঙ্গল রয়েছে ভালই। তারা ধারাপাতে সজীব। বর্ষার পরে বলে ধারারাশির তীব্রতা রয়েছে। জলপ্রপাত নীচে একটা জলাশয় তৈরি করেছে। সবুজ জল। পাথরের উপরে একটা বোট আছে দেখলাম। পর্যটকদের জন্য নাকি সুরক্ষায় বোঝা গেল না। গ্রীষ্মে নাকি জলপ্রপাতের ধারা শীর্ণ হয়ে যায়। তখন নিশ্চয় এলাকার এই সজীব রূপ থাকে না।

রোপওয়েতে চলেছে সেই সাহসী বালিকা।

এবার ফেরার পালা। ওঠার ঠেলা। ওঠার সময়ে দেখলাম, এক দারুশিল্পী নানা জিনিস তৈরি করছেন। কাঠের কুমির, খুন্তি, কুঠার, তরবারি। নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। এরই মাঝে একটা কাঠের কুঠার তুলে বাবলা ইন্দ্রর গলায় ধরল। মজার এমন দৃশ্য আমারও মোবাইলে বন্দি করার ইচ্ছে জাগল। কিন্তু শিল্পী গেলেন খেপে। বললেন, ছবি তুললে টাকা লাগবে। জানতে চাইলাম, কত টাকা? বললেন, ২০ টাকা। দিতে রাজি হতেই বললেন, ১০০ টাকা। কুঠারের দাম জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ১৫০ টাকা। দেড়শো টাকার কুঠার নিয়ে ছবি তুললে ১০০ টাকা! চলে এলাম ধন্যবাদ জানিয়ে। পরে একটু অনুশোচনাই হচ্ছিল। শিল্পী হয়তো তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে মজা করা পছন্দ করেননি। আমাদের এরকম করা উচিত হয়নি বলে মনে হল।

উপর দিকে জলপ্রপাতের বাঁদিকে অংশ। বড়ই সুন্দর।

ওঠার সময়ে পায়ের জোর আর ছিল না। চারটে সিঁড়ি ভেঙেই মনে হচ্ছে একটু দাঁড়াই। এত কষ্টের মধ্যে বাবলা কখন সিঁড়ি গুনতে শুরু করেছে। ও বলল, ‘‘যতই কষ্ট হোক সিঁড়ি গুনেই ছাড়ব।’’ কষ্ট সকলেরই হচ্ছিল। আশপাশ দিয়ে ওঠা বা সিঁড়ির বাঁকে বিশ্রাম নেওয়া পর্যটক, সকলেই সেকালের স্টিম ইঞ্জিনের মতো নিঃশ্বাস ছাড়ছে। এরই মাঝে একটা মজার কথোপকথন কানে এল। ৮-১০ বছরের মেয়েকে নিয়ে সিঁড়ি ভাঙছিলেন এক বাবা। আমরা যেখানে বিশ্রাম নিতে দাঁড়িয়েছি সেখানে এসে দাঁড়ালেন তাঁরা। মেয়েটি বলল, ‘‘বাবা মশা।’’ বাবা যেন আশাহীন, উদ্বেগহীন। উত্তর দিলেন, ‘‘আর মশা!’’ আমরা হেসে উঠলাম। সত্যিই তো সিঁড়ি ভাঙার প্রবল কষ্টের কাছে ক্ষুদ্র মশার দংশন নিয়ে উদ্বেগের কোনও মানেই হয় না।

ওই দূরে জলধারা।

উপরে উঠতেই সোনু কোথা থেকে চলে এলেন। বাবলা সিঁড়ি গোনার কাজ শেষ করেছিল। কিন্তু কতগুলো আর সঠিক মনে নেই। তবে সাতশোর কম। ৬৭৭ বা ৬৯০ এরকম হবে। আমরা একটু হালকা হয়ে খাবারের সন্ধান করতে লাগলাম। এদিকে ট্রেন ধরতে হবে তুলিন থেকে। এখানে খেতে গেলে দেরি হতে পারে। ঠিক হল, আমরা যেখানে উঠেছি সেখানে খেয়েই ট্রেন ধরব। কোনও ভাবে ট্রেন মিস হলে মুশকিল। কিন্তু হুড্রুর কিছু স্মারক তো নিয়ে যেতে হবে! উপরের চত্বরে কাঠের কাজ করছিলেন মনহুর বুধিয়া। কাছেই বাড়ি। তাঁর কাছ থেকে কাঠের খুন্তি, আর কুমির নিলাম। মা, ভ্রাতৃবধূর জন্য খুন্তি আর ভাইপোর জন্য কুমির। বাবলাও কিছু একটা নিল। ইন্দ্র তখন গাড়িতে বসে।

রোপওয়ের কাছ থেকে জলপ্রপাতের দিকে তাকালে এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে। এই অংশটাই বেশি ভাল লেগেছে।

শিল্পী কাজগুলোয় শেষ স্পর্শ দিচ্ছিলেন। আমি আর বাবলা চলে গেলাম রোপওয়ের কাছে। দেখা হল, দুই অসমসাহসী বোনের সঙ্গে। বছর বারোর মধ্যে বয়স দু’জনের। অনায়াসে বাবা-মাকে টা-টা করতে করতে রোপওয়ে বেয়ে ওপারে চলে গেল। আবার ফিরেও এল। এখানে কিন্তু নাগরদোলার মতো দু’চারজনের বসার মতো রোপওয়ে নয়। একাই যাত্রা করতে হবে। আমরা কিছুটা নেমে গেলাম নীচের দিকে। এটা জলপ্রপাতের উঁচু দিকের অংশ। এখান থেকে পুরো উপত্যকা একযোগে দেখা যায়। এবং বেশ সুন্দর সে দৃশ্য। আমার তো উঁচু থেকে জলপ্রপাত দেখাটাই বেশি ভাল লাগল।

এবার ফিরতে হবে। সোনু আমাদের ডাকতে চলে এসেছেন। গাড়িতে উঠলাম। হুড্রু থেকে অনগড়া যাওয়ার পথে রাস্তাটা জঙ্গলে ঘেরা। দুর্দান্ত। পথের পাশে জমিতে কী সব ফসল ফলে আছে। চোখে পড়েছে, কিন্তু মনে কোনও কৌতূহল জাগেনি। বাবলার জাগল। ও আর ইন্দ্র গিয়ে দেখে এল। স্থানীয় এক বৃদ্ধের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল, রাগি চাষ করা হয়েছে জমিতে। ছোটা ডন বাবলার জানার কৌতূহল হয়েছিল। কিন্তু ছবি তোলার কথা মনে হয়নি। সে জন্য গাড়িতে একটু গালমন্দ শুনল।

কভারের ছবি— রোপওয়ের কাছ থেকে জলপ্রপাতের দিকে

ছবি— ইন্দ্র, বাবলা

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *