মিষ্টির খোঁজে জিয়াগঞ্জে
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মিষ্টির নাম সাধুবাবা

ফারুক আবদুল্লাহ

মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকার জনপ্রিয় মিষ্টির খোঁজ করছিলাম ২০২২ সালে। মিষ্টি-খোঁজের কথা শুনে বিপ্লবদা জানান, জিয়াগঞ্জে সাধুবাবা নামে এক বিশেষ ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। জিয়াগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক তিনি। মিষ্টির এমন নাম শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু তখন মিষ্টি সম্পর্কে দাদা তেমন তথ্য দিতে পারেননি। পরের বছর জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে অঞ্জনদার সঙ্গে কথা হয়। অঞ্জনদা জিয়াগঞ্জের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক। তিনি খোঁজ নিয়ে জানান, জিয়াগঞ্জের এক পুরনো দোকান ক্ষুদিরাম রায় বা খুদু রায়ের দোকানে এই মিষ্টি পাওয়া যায়। এই দোকানের ভিয়েন ঘরেই জন্ম সাধুবাবা মিষ্টির।

গত বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি অঞ্জনদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। দিনটা মিষ্টতর কিছুর খোঁজে কাটানোর কথা। কিন্তু সমস্যা হল, দাদা দোকানের অবস্থান জানতেন না। রাস্তায় বেশ কয়েকজনের কাছে দোকানের অবস্থা জিজ্ঞাসা করা। অবশেষে দুপুর প্রায় ২টোর সময় পৌঁছে যাই খুদু রায় বা ক্ষুদি রায়ের দোকানে। দোকানে এক তরুণী ক্যাশ কাউন্টার সামলাচ্ছেন। প্রথমে তাঁর সঙ্গে কথা হয় দোকান ও মিষ্টি নিয়ে। তরুণী জানান, তাঁর নাম পায়েল রায়।

ক্ষুদি রায়।

পায়েল রায় জানিয়েছিলেন, মিষ্টির দোকানটি প্রথমে তাঁর দাদুর বাবা দেবেন্দ্রনাথ রায় শুরু করেছিলেন। দেবেন্দ্রবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে ক্ষুদিরাম রায় ও কালি রায় দোকানের দায়িত্ব বুঝে নেন। ঠিক এই সময় দোকানটির মাঝে একটি প্রাচীর তুলে দোকানটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি দোকান পরিচিত হয় ক্ষুদি রায়ের দোকান নামে। অন্যটি পরিচিত হয় কালি রায়ের দোকান হিসেবে। এই দু’টি দোকানই পুরনো ও জনপ্রিয়। জিয়াগঞ্জের পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষও এক নামে চেনে এই দোকান দু’টি।

পায়েল রায়ের দাদু ছিলেন ক্ষুদিরাম রায়। ক্ষুদিরাম রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে জয়দেব রায় ও সনৎকুমার রায়ের উপর দোকানের ভার এসে পড়ে। জয়দেব রায়ের মেয়ে হলেন পায়েল রায়। তিনি বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। পায়েল রায় তাঁদের মিষ্টান্ন ব্যবসার পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখন নিয়মিত দোকানে বসেন। তাঁর বক্তব্য, তিনি হাল না ধরলে হয়তো তাঁদের এই মিষ্টান্ন ব্যবসা অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে। পায়েল রায় অত্যন্ত মার্জিত। তাঁর নম্র আচরণে বিদ্যার দান করা বিনয় ফুটে ওঠে।

দোকান সামলাচ্ছেন পায়েল রায়।

দোকানে ঢুকে স্বাভাবিক ভাবেই চোখ যায় শোকেসে সাজানো নানান রকমের মিষ্টির উপরে। প্রতিটি মিষ্টিই খুব লোভনীয় মনে হচ্ছিল। আসলে জিয়াগঞ্জের মিষ্টির এমনিতেই খুব সুনাম রয়েছে। সেখানে এই দোকানটি খুব পুরনো আমলের এবং খুব জনপ্রিয়। ফলে এই দোকানের মিষ্টি যে ভাল হবে সেটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। মিষ্টিরাজির দিকে তাকিয়ে সাধুবাবা মিষ্টির খোঁজ করতেই পায়েল রায় একটি বিশেষ মিষ্টির দিকে আঙুল তাক করেন। জানান, এটিই সেই সাধুবাবা মিষ্টি। তিনি প্রথমে তাঁর দোকানের বেশ কিছু জনপ্রিয় মিষ্টির স্বাদ আস্বাদন করান। যা শেষ হয় সাধুবাবা দিয়ে।

সাধুবাবা মিষ্টিটি চ্যাপ্টা ও গোলাকার। এই মিষ্টি ছানার তৈরি। তবে মিষ্টির চারিপাশে মোয়ার একটা আস্তরণ এবং তার উপরে একটি ছোট্ট গোলাকার সন্দেশ বসানো থাকে। মিষ্টির মধ্যে গোলাপ জলের একটি সুগন্ধ দেওয়া থাকে। আসলে মিষ্টিতে গোলাপ জল দেওয়ার এই প্রবণতাটি খুব সম্ভবত স্থানীয় শেহেরওয়ালি সম্প্রদায়য়ের কাছ থেকেই এসেছে। কারণ তাঁদের প্রায় অধিকাংশ মিষ্টি জাতীয় খাবারেই গোলাপ জল দেওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে।

দোকানের শোকেসের শোভা সাধুবাবা।

সাধুবাবা মিষ্টিটি খেতে বেশ ভাল। ছানার সঙ্গে মোয়া ও সামান্য কিছুটা সন্দেশ মুখের ভিতরে মিলে মিশে গিয়ে একটি অন্য রকমের সুখানুভূতি তৈরি করে। তাতে অন্য মাত্রা যোগ করেছে গোলাপ জলের সুগন্ধ। মিষ্টি খেতে খেতে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল মিষ্টির নামটি নিয়ে। মিষ্টির নাম নিয়ে কৌতূহল আগেও হয়েছে। কিন্তু তখন সেই কৌতূহল নিবারণ করার কোনও উপায় ছিল না। তাই আজ মিষ্টি খেতে খেতেই পায়েল ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলাম নামের ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে। পায়েল ম্যাডাম জানান, তাঁর বাবা জয়দেব রায় মাঝেমধ্যেই মিষ্টি নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালবাসেন। প্রায় ১৫-২০ বছর আগে মিষ্টি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়েই তিনি একদিন এই সাধুবাবা মিষ্টি তৈরি করে ফেলেন। মিষ্টি তৈরি করলেও প্রথমে তিনি মিষ্টির নাম ভাবেননি। তবে সেই সময় নাকি ‘বাঁচাও সাধুবাবা’ নামে একটি গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। জয়দেববাবু গানের জনপ্রিয়তার প্রভাবে তাঁর তৈরি নতুন মিষ্টির নামও সাধুবাবা রাখেন। তখন থেকেই নতুন মিষ্টির স্বাদ জিয়াগঞ্জবাসীকে মুগ্ধ করে। পরবর্তী সময়ে এই মিষ্টির জনপ্রিয়তা দেখে জিয়াগঞ্জের বাকি দোকানগুলোও এই মিষ্টি তৈরি করতে শুরু করে। আজ জিয়াগঞ্জের বহু দোকানে এই সাধুবাবা মিষ্টি পাওয়া গেলেও জয়দেববাবুর দোকানের মিষ্টি স্বাদের জন্য আজও বিখ্যাত হয়ে আছে।

সাধুবাবা মিষ্টির স্বাদ এবং পায়েল রায়ের নিজ পরিবারের ঐতিহ্য আগলে রাখার ক্রমাগত প্রচেষ্টা— দুই মুগ্ধতা সঙ্গে নিয়ে সেদিন আমরা বাড়ি ফিরেছিলাম।

কভারের ছবি— সাধুবাবা মিষ্টি

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *