মিষ্টি কথা
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

উত্তরের লালমোহন, দক্ষিণের লালমোহন

দীপক দাস

লালমোহনের বাড়ি কোথায়? ‘ফেলুদার বইয়ে’, এমন উত্তর আসা অস্বাভাবিক নয়। বই-সিনেমা এবং সন্তোষ দত্তের মিলিত প্রভাব আর কী! ফেলুদার গল্পের লেখক ছাড়াও আরেক লালমোহন জনপ্রিয়। মিষ্টিপ্রিয় বহুজনই এ উত্তর দিতে পারবেন। বাড়ি তার জলপাইগুড়ি। আরও স্পষ্ট করে বললে, জলপাইগুড়ির ফুলবাড়ি। জায়গাটা শিলিগুড়ির কাছে। দেশভাগের ফলে বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছিলেন মণীন্দ্রনাথ ঘোষ। তিনিই ফুলবাড়িতে তৈরি করেন লালমোহন নামের মিষ্টিটি। তার পর তো ফুলবাড়ি আর লালমোহন সমার্থক হয়ে গিয়েছে।

জলপাইগুড়ি আর হুগলির অবস্থান সত্যিই উত্তর-দক্ষিণে। যাকে বলে বিপরীত মেরুতে অবস্থান। জলপাইগুড়ি উত্তরবঙ্গের জেলা। আর হুগলি দক্ষিণবঙ্গের। একদিন এই হুগলিতে সন্ধান মিলল লালমোহনের। সন্ধান দিল আমাদের বন্ধু দীপ্তেন্দুবিকাশ জানা। সে জানাল, হুগলির জাঙ্গিপাড়ায় একটি দোকানে মেলে লালমোহন। দীপ্তেন্দু আবার তথ্যটি পেয়েছিল গালিব উদ্দিন মণ্ডলের কাছ থেকে। গালিব সাহিত্যিক। আমার পরিচিত। ওঁর জাঙ্গিপাড়ার ইতিহাস নিয়ে কাজগুলো অন্যরকম ভাবে দেখা ও লেখা। জাঙ্গিপাড়ার এই অঞ্চল ইতিহাসের খনি। সেই ইতিহাসের সঙ্গে মিষ্টিও জড়িয়ে রয়েছে। আমরা আগে ইতিহাস ও মিষ্টি, দু’টোরই স্বাদ পেয়েছি। নতুন স্বাদের সন্ধানে পুনরাগমন। এবার অবশ্য একা।

দোকানের নাম মৃসুপ মিষ্টিঘর। তবে এলাকায় পরিচিতি গোবিন্দ মাস্টারের দোকান হিসেবে। তাঁর বাবা মৃত্যুঞ্জয়, মায়ের দাদু সুরেন্দ্রনাথ দে এবং মা পদ্মাবতীর নাম মিলিয়ে দোকানের নাম। গোবিন্দপদ নন্দী উদয়নারায়ণপুর সারদাচরণ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ছিলেন। ২০০৩ সালে অবসর নিয়েছেন। দোকানটি কর্মীরাই চালাতেন। ছুটিছাটায় দোকানে বসতেন গোবিন্দবাবু। সেদিন দোকানে গোবিন্দবাবু ছিলেন না। ছিলেন তাঁর ছেলে গৌতমকুমার নন্দী। তিনি জানালেন, দোকানে লালমোহন রয়েছে। রসগোল্লার মতো। রংটা সাদা নয়। বাদামি মতো। খেতে বেশ ভাল।

স্বাদ গ্রহণের সময়ে লালমোহন।

খাওয়াদাওয়ার পরে স্বাদের ইতিহাস সন্ধান। জলপাইগুড়ির লালমোহন মিষ্টির অনুকরণেই কি এই মিষ্টি তৈরি করা হয়েছে? গৌতমবাবু বছর বাইশ দোকানে রয়েছেন। জানালেন, তাঁর দোকানে বছর আঠারো আগে লালমোহন তৈরি হয়েছে। তবে তিনি মিষ্টিটির কথা শুনেছিলেন এক বন্ধুর বাড়িতে। তাঁর থেকে জেনে দোকানে তৈরি করা শুরু করেন। এলাকার লোকজনের ভাল লেগে যায়। ভাল লাগার পরিচয় দোকানে বসে পাওয়া গেল অবশ্য। বেশ কয়েকজনকে লালমোহন নিতে দেখলাম। নিয়মিত ক্রেতাই মনে হল তাঁদের। এঁরা লালমোহনের স্বাদের সঙ্গে পরিচিত। তাই এসেই ‘লালমোহন দিন’ বলছিলেন। না হলে, ‘‘এটা কী মিষ্টি’’ বলতেন।

কী ভাবে তৈরি হয় লালমোহন? গৌতমবাবু ও দোকানের এক রসশিল্পী উপকরণ আর প্রস্তুত প্রণালী জানালেন। উপকরণ ছানা আর খাবার সোডা। মিশ্রণে দেওয়া হয় জায়ফল, জৈত্রীও। ছানার গোল্লা পাকিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে তৈরি করা হয় লালমোহন। রসে ফোটাতে হবে ঘণ্টাখানেক। ফোটানোর জন্যই বাদামি রং আসে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে দেখে নিতে হবে গোল্লার ভিতরটা শক্ত রয়েছে কিনা। যদি শক্ত থাকে তা হলে কাঁচা জল দিতে হবে প্রয়োজন মতো। ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে যাবে স্বাদু লালমোহন।

ফুলবাড়ির লালমোহন আর জাঙ্গিপাড়ার লালমোহন কি এক? না, ব্যাপারটা উত্তর-দক্ষিণই হয়ে যাচ্ছে। একটা কথা স্বীকার করে নিই, ফুলবাড়ির লালমোহন চেখে দেখা হয়নি। যা কিছু তথ্য তা আনন্দবাজার পত্রিকা এবং আন্তর্জাল থেকে আহরণ করা। এ জন্য কিছু সংশয়ও রয়েছে। যেমন, এপার বাংলায় লালমোহন প্রথম তৈরি করা মণীন্দ্রনাথ ঘোষ বাংলাদেশের কোথা থেকে এসেছিলেন? ইন্টারনেটে ঢাকা ও ময়মনসিংহ, দু’টো তথ্যই মিলছে। আমরা বৃহত্তর অর্থে বাংলাদেশই ধরলাম। এবার প্রস্তুত প্রণালীর উত্তর-দক্ষিণটা দেখা যাক। ইন্টারনেটের তথ্য বলছে, ফুলবাড়ির লালমোহন তৈরিতে ছানা, ময়দা, ক্ষীর ভাল করে মেখে নিয়ে গোল করতে হয়। সেই গোল্লা ভাজার পরে চিনির রসে ডোবানো হয়। প্রস্তুত প্রণালী অনেকটাই পান্তুয়ার মতো। অনেকে পান্তুয়া বলেও থাকেন। লালমোহনের জনক মণীন্দ্রনাথ ঘোষ প্রয়াত। তিনি কিন্তু লালমোহনের পান্তুয়া পরিচয়ে সায় দিতেন না। তাঁর মিষ্টি লালমোহন হিসেবেই পরিচিত হোক, চাইতেন তিনি।

দোকানে গৌতমবাবু।

দুই লালমোহনের উত্তর-দক্ষিণে অবস্থান বোঝা গেল? ফুলবাড়ির লালমোহন ভাজা মিষ্টি। পান্তুয়া জাতীয় বলা যায়। কিন্তু হুগলির লালমোহনকে রসগোল্লা জাতীয় বলা যায়। ভাজা নয়, কিন্তু রসে গাঢ় করা। রসে গাঢ় করা এমন মিষ্টি আরও রয়েছে। যেমন, সোমড়াবাজারের ক্ষীরমোহন প্রস্তুতের দ্বিতীয় পর্বে রসগোল্লা রসে ফোটানো হয়। কলকাতার কাঁচা ছানার মোহনভোগের ভিতরের গুটিও মোটা রসে ফুটিয়ে বাদামি করা হয়। প্রণব রায়ের ‘বাংলার খাবার’এ দ্বারিক দত্তের দোকানের লাল রসগোল্লার উল্লেখ আছে। এর প্রস্তুত প্রণালী জানা নেই। যদি রং না দেওয়া হয় তাহলে এটাও হয়তো রসে ফুটিয়ে গাঢ় করা হত। ভীম নাগের কড়া পাকের রসগোল্লাও এরকমই রসে ফুটিয়ে গাঢ় করা হয়।

লালমোহন নামে একটা মিষ্টি আমরা আগেও খেয়েছিলাম। খেয়েছিলাম এই হুগলিতেই। তবে সেটা চন্দননগরে। খ্যাতনামা মৃত্যুঞ্জয় সুইটসে। সে মিষ্টি গোল। তবে রসগোল্লার মতো নয়, চাকতির মতো। মাঝখানটা কিছুটা উঁচু। যেন খেলার ডিসকাস থ্রোয়ের চাকতির মতো। তখন প্রস্তুত প্রণালী জানা হয়নি। তবে স্বাদে মনে হয়েছিল রসগোল্লা জাতীয়। রংটা রসগোল্লার মতো সাদা নয়। বাদামি।

লালমোহনের উত্তর-দক্ষিণের এই তফাৎ কেন? তবে কি দক্ষিণবঙ্গের মিষ্টান্ন শিল্পীরা লালমোহন নামে স্বতন্ত্র কোনও ধারা তৈরি করেছেন? সঠিক সিদ্ধান্তের সময় আসেনি। আরও কিছু লালমোহন নামের মিষ্টির সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত সিদ্ধান্ত মুলতবি রাখতে হবে। ইন্টারনেটে বাংলাদেশের লালমোহনের খোঁজ করছিলাম। ছানা, ময়দা ও অন্য উপকরণের মিশ্রণকে ভেজে রসে ডোবানোর কথাই বলা হয়েছে। ওপার বাংলায় আরও কিছু ধরনের লালমোহন রয়েছে। যার উপকরণ আলাদা, কিন্তু প্রস্তুত প্রণালী এক। যেমন, ডিমের তৈরি লালমোহন। এতে ছানা লাগে না। গুঁড়ো দুধ লাগে। সুজি বা পাউরুটি দিয়ে তৈরি লালমোহনের সন্ধানও মেলে আন্তর্জালে। আর তার প্রস্তুত প্রণালী ওপার বাংলার এবং অবশ্যই ভেজে নেওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কোনও মানুষই শিকড় ভুলতে পারেন না। মণীন্দ্রনাথবাবু লালমোহনকে শিকড়ের স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছিলেন হয়তো। তবে প্রস্তুত প্রণালীতে ছানা, ক্ষীরকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যা তাঁর একান্ত নিজস্ব হয়ে উঠেছিল।

রসে টইটম্বুর।

গৌতমবাবুর সঙ্গে কথা বলার সময়েই তাঁর বাবা গোবিন্দবাবু এলেন। ৮৭-৮৮ বছর বয়সি। তিনি দোকান প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানালেন। দোকানটি তৈরি করেছিলেন গোবিন্দবাবুর দাদু সুরেন্দ্রনাথ দে। তিনি ছিলেন কিছু দূরের গ্রাম বাহিরগড়ার বাসিন্দা। বাহিরগড়া ইতিহাস প্রসিদ্ধ জায়গা। গোবিন্দবাবুর তিন বছর বয়সে তাঁর মা পদ্মাবতী মারা যান। তিনি মামার বাড়িতেই মানুষ। সুরেন্দ্রনাথ দে আগে একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করতেন। সেখানে কোনও সমস্যা হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী জানিয়েছিলেন, আর কাজে না যেতে। এই জায়গাটি ছিল নৃসিংহ সিংহ রায়েদের। তিনি সুরেনবাবু জায়গা দিয়েছিলেন। রাতারাতি দোকান তৈরি হয়ে যায়। হাওড়া-চাঁপাডাঙা মার্টিন রেল চালুর আগে এ দোকান তৈরি হয়েছিল। দোকানের তিন ফুট দূর দিয়ে মার্টিন রেল যেত।

সুরেন দে পড়াশোনা জানতেন না। কিন্তু তাঁর দোকানে বিখ্যাত লোকেরা আসতেন। আসতেন বৃন্দাবন সিংহ রায়, নৃসিংহ সিংহ রায়। এই দু’জনের সঙ্গেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ ছিল। বৃন্দাবনবাবু ছিলেন বিভূতিভূষণের মেস-বন্ধু। আর নৃসিংহবাবু ছিলেন চিকিৎসক। তাঁর ডিসপেনসারির পাশের ঘরে বিভূতিভূষণ ভাড়া থাকতেন। সুরেনবাবুর দোকানে বিভূতিভূষণ এসেছিলেন কিনা বলতে পারলেন না গোবিন্দবাবু। তবে বিভূতিভূষণের জাঙ্গিপাড়া-স্মৃতিতে দু’টো মিষ্টির দোকানের উল্লেখ মেলে। একটা ফকির ময়রার দোকান। ‘পথের কবি’তে এর উল্লেখ রয়েছে। বিভূতিভূষণ আরেকটি দোকানের উল্লেখ করেছেন ‘অভিযাত্রিক’এ। সেই দোকানের পরিচয় মেলেনি। অবস্থানও বোঝা যায়নি। সেই সময়ে জাঙ্গিপাড়ায় সুরেন ময়রার সঙ্গে ভদ্রেশ্বর ময়রা, ফকির ময়রা, গোষ্ঠ ময়রারাও ছিলেন। কার দোকানে বিভূতিভূষণ ও নীরদ সি চৌধুরী এসেছিলেন? এখন বোঝা সম্ভব নয়।

তবে এটা বোঝা সম্ভব, পুরনো একটা দোকান নতুন কিছু তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। সেই চেষ্টায় উত্তর-দক্ষিণ মিলে গিয়েছে। অজান্তে হলেও।

কভারের ছবি— লালমোহন

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *