Uncategorized পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

পবিত্র অরণ্য, লেপচাঘর আর অপরূপা সিটং

দীপশেখর দাস

দরজাটা এমনিই খুলে গেল। দরজাটা বাইরে বেরোনোর। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দরজাটা সপাটে বন্ধ করে দিয়েছিল। আমাদের জন্য খুলে গেল হঠাৎই। আমাকে আর সহকর্মী শুভজিতদাকে যেতে হবে পূর্ব হিমালয়ের গ্রামে গ্রামে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করতে। বেরিয়েছিলুম বিশ্বকর্মা পুজোর পরদিনই। তিস্তা-তোর্সায় জানালার পাশেই আসন। ট্রেন শহরাঞ্চল ছাড়তেই মন পুলকিত হল। বাংলার আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা। নিম্নচাপ সবে গভীর হতে শুরু করেছে। বর্ষার পল্লিপ্রকৃতির মনোমুগ্ধকর সব রূপ কেউ যেন একে একে তুলে ধরতে লাগল। ধুসর-কালো আকাশের নীচে সবুজ মাঠ। ধানের খেতে মরুৎ-হিল্লোল। কোথাও বা পাটতন্তু সবে ধোলাই-কাচাই করে কাঠিগুলোকে সাজিয়ে রাখা মাঠের ধারে। বাংলার এ রূপ আমি অনেকদিন দেখিনি। ছোটবেলায় আমার গ্রামে ধান-পাট চাষ হতে দেখতুম। কিন্তু সময়ের নিয়মেই গ্রাম উন্নত হয়েছে। মাঠের চরিত্র বদলেছে। ধান চাষ বেশ কিছু জমিতে এখনও হলেও পাট চাষ সাঙ্গ হয়েছে। যতক্ষণ না অন্ধকার নামল ততক্ষণ জানালার কাচে চোখ রেখে বসে ছিলুম।…

মেঘ পাহাড়ের মেলামেশা।

বেঘোরে ঘুমুচ্ছিলুম। শুভজিতদা ডেকে তুলল। রাত ৩টেয় তিস্তা-তোর্সা নিউজলপাইগুড়িতে। ব্যাগপত্তর নিয়ে সোজা  প্রতীক্ষা গৃহে। ভোরের আলো না ফুটলে বেরোবো না ঠিক করেই রেখেছিলুম। একটা টাটাসুমো গাড়ি ভাড়া করে সকাল ৬টা নাগাদ রওনা। গন্তব্য সিটং। হোম স্টে ঠিক করাই ছিল। সিটংয়ের রসিকা হোম স্টে। ড্রাইভারদাদা হোম স্টের অবস্থানটা বুঝতে পারছিলেন না। শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে ফোন করলুম হোম স্টের মালিক রোশনজিকে। রোশনজি ড্রাইভারদাদাকে ঠিকানা বুঝিয়ে দিতে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এ পথ বড়ই মনোরম। সবুজের বুক চিরে এগিয়ে চলা। শাল বন, চা বাগান, সবুজ পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা আর সাদা মেঘের ভেলা ভরা নীল আকাশ সঙ্গে করে এগিয়ে চলা। এ চলায় ক্লান্তি নেই। আছে শুধু মুগ্ধতা। এ পথে আগেও অনেকবার গিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারেই এই পথ আমায় নতুন করে ভালবাসিয়েছে। ঘণ্টা দুয়েকের যাত্রা শেষে গন্তব্যে।

অরণ্যানী।

প্রথম দর্শনেই রসিকা হোম স্টে মন টানল। পাহাড়ের ধাপে ছোট সুন্দর বাড়ি। সামনে উন্মুক্ত প্রকৃতি। ঘরের চারিধারে ছোট ছোট পাত্রে অনেক ফুলের গাছ লাগানো। যত্নে সাজানো। আসার পথে সিটংয়ের বেশ কিছু ঘর চোখে পড়ল। সব ঘরেরই প্রায় একই বৈশিষ্ট্য। বারান্দায় পা দিয়ে ভাললাগা আরও বাড়ল। সামনে অনন্ত সবুজ পাহাড়ের দল। একটার পর একটা যেন স্তরে স্তরে সাজানো। একই সঙ্গে অনেক অনেক পাহাড়ের শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। সকালের সোনালি রৌদ্রে সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকতে আর মন চাইছিল না।

আমাদের হোম স্টে।

এরই মধ্যে ঘরে কাউকে না পেয়ে রোশনজি কখন গরম চা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। পাহাড়গুলোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি দেখে বোধ করি মনের ভাব বুঝলেন। দূরের পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে জানালেন, ওগুলো সব সিকিমের পাহাড়। আরও দূরে এখন দৃশ্যমান শেষ পাহাড়ের পরে যেখানে অল্প একটু ধূসর মেঘ জমে আছে ওখানে নাকি চিনের সীমানা। ওই যে যেখানে যুদ্ধ লেগেছিল। আকাশ পুরো পরিষ্কার থাকলে নাকি সবটা দেখা যায়। আমাদের কয়েকদিনের ঠিকানা এটাই। রোশনজির কথা শুনে মনে দুরুহ আশা জাগে। আহা, যদি একবার অমন পুরো মেঘমুক্ত আকাশ পাওয়া যায়।

বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলা পাহাড়ি গ্রাম। সেদিন চাঁদ উঠেছিল।

সেদিন রাত্রে ঘুমটা বেশ গাঢ়ই হল। আগের দিনের অর্ধ রাত্রি জাগরণের জন্যই হোক বা ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্যই, সকালে ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হল। সূর্য বেশ খানিকটা উপরে উঠে গিয়েছে। রৌদ্রও বেশ চড়া। প্রাতরাশ সেরে ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে চটজলদি বেরিয়ে পড়লুম। শুভজিতদার আরও একটু বিশ্রাম দরকার ছিল। বিকেলের দিকে বেরোবে। অগত্যা একাই…।

গুহার পাশে দেখা ঝরনা। এটা নীচে নামার পরে।

খানিকটা পথ হেঁটেই একটা পাহাড়ি ঝোরা মিলল। সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে তিরতিরিয়ে নেমে এসেছে। চোরা স্রোতের জলকণায় রোদ্দুর পরে চিকচিক করছে। খানিকটা রইলুম তার সঙ্গে। কয়েকটা সেলফিও নিলুম ওর সঙ্গে। পাহাড়ের একটা মহাত্ম্য আছে। পাহাড় রোজ নতুন দৃশ্য দেখায়। প্রতি মুহূর্তে, প্রতি মোড়ে রূপ পাল্টায়। পাহাড়ের গাছে গাছে রৌদ্র ছায়ার খেলা চলতে থাকে। উপরি পাওনা সিটংয়ের কোলাহলহীন জনজীবন। পাহাড়ের কোলে ছোট সুন্দর গ্রাম। এখানে শুধুই শান্তি। শহরের হল্লা এখানে পৌঁছতে পারে না। এক জায়গায় চুপ করে বসেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো যায়। আরও একটু এগিয়ে একটা মোড়ে এক প্রাচীন মহীরুহের সাক্ষাৎ। ডালপালা ছড়িয়ে জঙ্গলের বাকিদের থেকে নিজের অস্তিত্ব আলাদা করেছেন তিনি। শাখাপ্রশাখায় আশ্রয় দিয়েছেন অনেককে। আধুনিক যুগের অভিশাপে এমন মহীরুহ পাওয়াই তো দুষ্কর। বেশ খানিকটা সময় কাটালুম তাঁর সঙ্গে।

মহীরুহে কতজনের আশ্রয়।

মহীরুহ ছেড়ে এগোতে যাচ্ছি শুভজিতদার ফোন এল। সে-ও বেরিয়ে পড়েছে ঘর থেকে। সত্যিই তো এমন পরিবেশে কি আর ঘরে থাকা যায়! অতএব আরও কিছুক্ষণ মহীরুহের সঙ্গে। শুভজিতদা এলে চলল ফটোশুটও। বেলা অনেকটাই হয়েছিল। খিদেও পেয়েছিল। অগত্যা সেদিনের মতো ফেরা। হাতে আরও কয়েকদিন আছে। সিটংয়ের বাকিটা ঘুরে দেখা যাবে ধীরে সুস্থে।

চোখে পড়ে এমন সব মনলোভা দৃশ্য।

পরেরদিন সকালে আবার নতুন দৃশ্য। সকালেই আঁধার। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। হালকা কুয়াশার মতো সাদা মেঘগুলো পাহাড়ের গা বেয়ে কখনও উপরে উঠছে। কখনও বা হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে দূর বহু দূরে। উপর থেকে মেঘ দেখছি। কখনও উপরের কালো ভারী মেঘ ঝরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে দু’এক পশলা। প্রকৃতি তখন অত্যন্ত রোম্যান্টিক। আহা! আমি যদি কবি হতুম তবে দু’এক পঙক্তি বেরিয়ে আসত।

সেই গুহা।

রোশনজির থেকে খবর পেলুম এখানে নাকি লেপচাঘর নামে একটা বাড়ি আছে। সেখানে এখন কেউ থাকে না। আছে শুধু পুরনো দিনের চিহ্ন হিসেবে। পাহাড়ের ঘরবাড়ি বেশিরভাগই কাঠের। কাঠের কাঠামোয় পেরেকের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী। লেপচাঘরের বিশেষত্ব নাকি এখানেই। লেপচাঘরের কাঠামোয় নাকি কোনও পেরেক নেই। কৌতূহল হল। রোশনজির থেকে পথের হদিশ নিয়ে বেরিয়ে পরলুম। আজও একাই। আজ রাস্তাটা অন্যদিকে। হাঁটছি, পাহাড় দেখছি, পাখি দেখছি, গাছ দেখছি, ফুল দেখছি আর এগোচ্ছি। বেশ খানিকক্ষণ হেঁটে পথচলতি কয়েকজনের থেকে তথ্যতালাশ করেও লেপচাঘরের সন্ধান পেলুম না। একটা তিন মাথার মোড়ে পৌঁছে ফোন করলুম রোশনজিকে। রোশনজি বললেন উপরের রাস্তা ধরে আরও এগিয়ে যান। চললুম। না লেপচাঘর নেই। তবে এগিয়ে গিয়ে যা পেলুম তা-ও কিছু কম নয়। বেশ খানিকটা এগিয়ে গ্রামটা শেষ হল। গ্রামের শেষ বাড়িগুলো ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে জঙ্গলটা ঘুরে গাছপালার ছবি তুলে ফেরার পথ ধরলুম।

প্রথম দিনের ঝোরা।

ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে আমায় ঘুরতে দেখে কিরণ বিশ্বকর্মা আর রাজু বিশ্বকর্মার কী মনে হল জানি না। রাস্তার পাশের জমিতে দু’জনেই কাজ করছিলেন। নিজেরাই এসে পরিচয় করলেন। জেনে নিলেন আমার বৃত্তান্ত। লেপচাঘরের সন্ধান তাঁরাও দিতে পারলেন না। কিরণ বললেন, ‘‘এখানে লেপচাঘর নেই কিন্তু একটা গুহা আছে।’’ যদি দেখতে চাই নিয়ে যাবেন। আর কী! সঙ্গ নিলুম। বেশ কিছু ধাপ সিঁড়ি ভেঙে, কিরণের ঘর পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পৌঁছে গুহার মুখ দেখলুম। গুহার পাশ দিয়ে তিরতিরিয়ে নেমে এসেছে পাহাড়ি ঝোরা। জঙ্গলে নাম না জানা পাখিদের কলতান। মায়াবি পরিবেশ। কিরণ জানালেন, এ গুহার অন্য মুখ আছে বেশ কিছুটা উপরে। পাহাড়ে কোনও আন্দোলনের সময় নাকি বিক্ষোভকারীরা গোপন আস্তানা নিয়েছিল এখানে। খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলুম। কিরণজির আক্ষেপ এখানে কেউ আসে না। উপরে উঠতে হবে জেনে কেউ আর গুহা দেখতে যায় না। শহুরে জীবনে উপরে ওঠার জন্য তীব্র লড়াই। আর এখানে উপরে উঠতে হলে…।

পোষা রুই কাতলা।

গুহা থেকে ফেরার পথে আরও একটা তিনমাথা মিলল। অভিষেক হোম স্টের সামনে দিয়ে একটা রাস্তা আড়াআড়ি চলে গিয়েছে গ্রামের ভিতরে। যাবার সময় লেপচাঘরের সন্ধানে উপরের দিকেই চলেছিলুম। এবার এই আড়াআড়ি রাস্তায়। পৌঁছে গেলুম সেই ঝোরার কাছে যাকে পেয়েছিলুম সেই গুহার পাশে। এখানে সে আরও প্রশস্ত, আরও কল্লোলিনী। এখানেও খোঁজ করা হল লেপচাঘরের। হতাশ হতে হল। খোঁজ করতে করতে হাজির একটা ছোট বাড়ির কাছে। উঠোনের চৌবাচ্চায় মাছ রাখা। রঙিন মাছ নয়। একেবারে রুই-কাতলা-কালবোস। আসার পথে আগেও কয়েক জায়গায় এ ভাবে মাছ রাখা আছে দেখেছি। এমনকি বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে অল্প জমা জলেও কিলো দেড়েকের রুই দেখেছি। কিন্তু সেগুলো হোমস্টের ছিল। ভেবেছিলুম ঘুরতে আসা বাঙালিদের মাছ-ভাতের বায়না মেটাতে এই ব্যবস্থা। এটা হোম স্টে নয়। বসতবাড়ি।

পবিত্র অরণ্যে দেবতা রূপে পুজো করা গাছ।

কৌতূহল মেটাতে গৃহকর্ত্রীর শরণাপন্ন। তিনি চৌবাচ্চার পাশে বসে কিছু একটা করছিলেন। জিজ্ঞাসা করতে বললেন, শখ করে মাছ পালন করেছেন তাঁরা। আমাদের কথাবার্তা শুনে গৃহকর্তা বাইরে এলেন। রবিবারের বেলা। পেটে তরল উত্তেজনা। কথা শুনেই মালুম। আমার নাম ধাম, এখানে আসার কারণ ইত্যাদি জেনে নিলেন। প্রমাণ হিসাবে অফিসের পরিচয়পত্রটাও দেখাতে হল। পরিচয়পত্র দেখার পরেই বাবুর অদ্ভুত পরিবর্তন হল। বাড়ির গম্ভীর কর্তা হঠাৎ যেন বহুদিনের পরিচিত হয়ে উঠলেন। নিজেই পরিচয় দিলেন “হ্যালো। আই অ্যাম কিরণ রাও।’’

বনপথ।

আবার এক কিরণ! এই কিরণ সন্ধান দিলেন এক পবিত্র বনাঞ্চলের (সেক্রেড গ্রুভ)। কিরণের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই ওই বনাঞ্চল। নিজেই নিয়ে চললেন। যেতে যেতে অনেক কথা বললেন। বললেন তাঁর কলকাতা ঘোরার কথা। বেঙ্গালুরু ঘোরার কথা। আরও কত কী। বুঝলুম কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ভাবের জন্যই এসব বলে চলেছেন। কিরণও শখে মাছ পোষার কথা জানালেন। মাছ ওঁরা খান না। পর্যটকদেরও বিক্রি করেন না। তবে মাছের সংখ্যা এবং আকার বেশ বড় হয়েছিল বলে কিছুদিন আগেই নাকি ২৫ কিলো বিক্রি করেছেন দিলারাম বাজারের কোনও এক ব্যবসায়ীর কাছে। সিটং আসতে দিলারাম বাজার হয়েই আসতেহয়। সেখানে মাছের দোকানও দেখেছি। তাই কথাটা অবিশ্বাস করতে পারলুম না। বিশেষত পাহাড়ের এইসব গ্রামবাসীদের মিথ্যে বলতে শুনিনি বলে আরও দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করলুম। পরে অভিষেক হোমস্টের কাছে অমিতের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কিলো দেড়েকের রুইগুলোর মালিক সে-ই। অমিতও জানিয়েছিল শখের মাছের কথা। অনুগ্রহ হোম স্টের সামনেও এমনই মাছ রাখা অনেক। সবই শখে। পর্যটকদের জন্য নয়। শত অনুরোধ করলেও নয়।

লেপচাঘর।

কিরনজির বাড়ি থেকে পবিত্র বনাঞ্চল হাঁটাপথে মিনিট দশেক। জঙ্গলের বেশ কিছুটা অংশকে নিয়ে পবিত্র বনাঞ্চলটা। তার মাঝ বরাবর কয়েকটা গাছকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হয়েছে। সেই অংশের কিছুটা আগে একটা প্রবেশদ্বার। এটা গত দু’এক বছরের মধ্যেই তৈরি করা বোঝা গেল। জঙ্গলের এই অংশ থেকে কিছু বনজ জিনিস সংগ্রহ করা বা গাছকাটা নিষিদ্ধ। স্থানীয় বনাঞ্চল রক্ষা করার এ এক বহু পুরনো রীতি। পবিত্র বনাঞ্চল দেখে কিরনজিকে বিদায় জানিয়ে হোম স্টেতে ফিরলুম।

পরের তিনদিন আর সিটং ‘ঘোরা’ হয়নি। এ ক’দিন কাজ মেটাতেই বেলা ফুরোল। ঘুরতে না পারলেও দেখা ছাড়িনি। ভোরে উঠে আকাশ লাল করা সূর্যোদয় দেখেছি। পূর্ণিমার চন্দ্রোদয় দেখেছি। আর দেখেছি রাতের আকাশ আর পাহাড়। মিশমিশে অন্ধকারে জোনাকির মতো আলোর অসংখ্য মিটমিট করা বিন্দু আকাশময়। তেমনই আলোর বিন্দু পাহাড়ের গায়েও। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন আকাশেরই প্রতিচ্ছবি।

লেপচা ঘরের উনুন।

সিটং ছাড়ার আগের দিন দুপুর পর্যন্ত কাজ চলল। কাজ শেষে বিকেলে আবার লেপচাঘর খুঁজতে বেরুলুম। এবার শুভজিতদাও সঙ্গ দিল। রোশনজির ছোট ছেলে বিধান আমদের পথ দেখিয়ে দিল। ও বলা হয়নি। রোশনজির দুই ছেলে আর এক মেয়ে। বড় ছেলে রোহন বারো ক্লাসে পড়ে। মেয়ে রসিকা এগারোয়। আর বিধান নবমে। মেয়ের নামেই হোমস্টের নাম রাখা। রোশনজি বছর পাঁচেক আগেই শুরু করেছেন এই হোমস্টে। তিনি সঙ্গে গাইডের কাজও করেন। আবার গাড়িও চালান। গেস্টরা চাইলে নিউজলপাইগুড়ি থেকে নিজেই নিয়ে আসেন তাঁদের। দিয়েও আসেন। বিধানের দেখানো পথে এগিয়ে চললুম। এ পথটা পাকা নয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাথরের সিঁড়ি বাঁধানো পথ। কারও বাড়ির উঠোন দিয়ে, কারও বাড়ির পিছন দিয়ে এ পথ গিয়েছে। এমনই এক বাড়ির কাছে পথের উপর দু’টো রাজহাঁস পেলুম। আমাদের দেখে দু’জনেই কর্কশ গলায় ডাক ছাড়ল। রাজহাঁস পেরিয়ে একটু এগিয়ে থমকাতে হল। শুভজিতদা সঙ্গ ছেড়েছে। পিছন ফিরে দেখি রাজহাঁসদ্বয় দাদার পথ আগলেছে। শুভজিতদা ওদের পেরিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না। অবস্থা বুঝে ইশারায় দাদাকে উপরের পথ বাতলে দিলুম।

পাহাড়রাজি।

বাড়িগুলো পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে জঙ্গল। কিছুটা দূর দূরই জঙ্গল ভেদ করে সরু জলের ধারা নীচের দিকে চলেছে তিরতিরিয়ে। জঙ্গলের মধ্যে বাসায় ফিরে আসা পাখিরা একনাগাড়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছে। বেশ খানিকক্ষণ যেতে জঙ্গল পথটা শেষ হল। আবার একটা নতুন পাকা রাস্তা। এতক্ষণ নীচের দিকে নামছিলুম। পাকা রাস্তায় উপর দিকে উঠতে লাগলুম। সেদিনে রোশনজির উপরদিকে যাওয়ার পরামর্শের কথাটা মনে এল। বুঝলুম রোশনজি এখান থেকেই উপরদিকে যাওয়ার কথা বলছিলেন। আমি রাস্তা চিনতে না পেরে অন্যদিকে চলে গিয়েছি। পাকা রাস্তায় কিছুটা দূর গিয়েই লেপচাঘর মিলল। এ কাঠামো আমার চেনা। মাটির ঘর। মাথায় খড়ের ছাউনি। আমাদের গ্রামের আগেকার ঘরের মতোই। তবে পার্থক্যও আছে। এ ঘরের ভিতটা কাঠের। মেঝেটাও। দেহেও কাঠের উপর মাটি লেপা। ভিতটা রাস্তার অনেকটা নীচে থেকে শুরু হয়ে রাস্তার সমানে এসে শেষ হয়েছে। ঘরের কাঠামোটা নীচের কয়েকটা কাঠের স্তম্ভের উপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে। এখন শহরের ফ্ল্যাটের নীচের অংশটা যেমন হয় ঠিক তেমনই। শহরের ফ্ল্যাটের নীচে গাড়ি থাকার ব্যবস্থা। এখানে গৃহপালিত পশুর। কাছাকাছি কাউকে পাওয়া গেল না। তাই বিস্তারিত তথ্য নেওয়া হল না। ঘরে একবার ঢুকেছিলুম। একটা মাত্র বাল্ব আর একটা তক্তোপোশ। রাতে কেউ এখানে আশ্রয় নেয় বোঝা গেল। উনুনটাও একটু অন্য রকমের। এখানে জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করেই রান্না করার রীতি। কাঠের জ্বালানি জোগাড়ের সুবিধার্থে তিনটে মাত্র মাটির স্তম্ভ করা। অনেকটা আগের বনভোজনের সময় ইট সাজিয়ে করা উনুনের মতোই। উনুনের তিনটে স্তম্ভের পাশে আরও দু’টো স্তম্ভ করে সেখানে কাঠের জোগান রাখার জায়গা। এমন ভাবে বানানো যাতে প্রয়োজনে সেটাকেও উনুনে পরিণত করা যায়।

সিটংয়ে সূর্যোদয়।

লেপচাঘর দেখার আশ মিটিয়ে হোম স্টের রাস্তা ধরলুম। আকাশে তখন গোধূলি রং লেগেছে। আমাদের মন খারাপ। অদ্যই শেষ রজনী যে। আবার ফিরতে হবে কোলাহলে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: রাসিকা হোমস্টেতে থাকার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন রোশন মুখিয়ার সঙ্গে। ৯৭৩৩২৭৯২১২ এই ফোন নম্বরে।

কভারের ছবি- পাহাড়ি গ্রামে রাত। যেন জোনাক জ্বলা আলো।

ছবি- লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *