গড় পঞ্চকোট
জলযাত্রা পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

দর্পচূর্ণের গাড়িতে গড় পঞ্চকোট, ভায়া মাইথন-পাঞ্চেত

দীপক দাস

দর্প একদিন চূর্ণ হবেই। কার নিয়ম জানি না। প্রকৃতির? সময়ের? নাকি ‘ল অব অ্যাভারেজ’? কিন্তু দর্প চূর্ণ হয়। আমাদেরও হল। পুরুলিয়ার লাল, কাঁকড়ময় মাটিতে আমাদের দর্প সেদিন এক এসইউভি-র চাকায় পিষ্ট হতে হতে এগোচ্ছিল। অহংকার নাকি পতনের কারণ? সেদিন পতন হয়নি। তবে গুমোর ভেঙেছিল।

আমাদের গুমোর ঘোরাফেরার যানবাহন নিয়ে। বড় গাড়ি, ভাল মাথা গোঁজার ঠাঁই, দুরন্ত দামি খাওয়া এসব নিয়ে ঘোরাফেরায় মাথা খাটাই না। তাই কখনও মুড়ি দিয়ে লাঞ্চ, দোকানের মালপত্র সরিয়ে ঘর, ইঞ্জিন ভ্যান, ছোটা হাতি, কিছু দূর গিয়ে ব্যাটারির দম ছেড়ে দেওয়া টোটো আমাদের সফর সঙ্গী। মুরাডি স্টেশন থেকে রিকশায় গিয়েছিলাম বরন্তি। এ নিয়ে আমাদের বেশ গর্ব। কিন্তু বছর ছয়েক আগে এক শীতকালে সে গর্ব ভেঙেছিল। সেবার এসইউভি ভাড়া করতে হয়েছিল। সওয়ারি ক’জন? মাত্র দু’জন।

সেই খাদান।

পুরুলিয়া পরিক্রমায় বেরিয়েছিলাম আমরা দু’জন। দলের অন্যদের ব্যস্ততায় দুই সিনিয়রের সফর। প্রথমে বরন্তি। তার পর বাকি স্থান। বরন্তিতে দলের রীতি অনুযায়ী ঠোক্কর খেতে খেতে অবশেষে একটা থাকার জায়গা জুটল। পরদিন যাব পুরুলিয়া ফুঁড়ে ঝাড়খণ্ডে। কিন্তু হলিডে হোমে কোনও ছোট গাড়ি নেই। এসইউভি। ভাড়া বেশি। এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আমরা মহাস্থবির জাতকের মতো ঘোরাঘুরি করতে চাই। নেহাত সাহসে কুলোয় না বলে কম খরচের বাহন ও বাসায় বিশ্বাস রেখেছি। সব রীতি যে ভাঙতে চলেছে!

এই পাথরটাকে কি খুলি গুহার মতো মনে হচ্ছে?

রীতি ভাঙল। পকেট ভাল মতো খালি হল। বিশাল গাড়ির পেটে মাত্র দু’জন। খালি পেটে অনেকটা জল খেলে যেমন ঢকঢক করে নড়ে তেমনই নড়তে নড়তে সফরে শুরু হল। গন্তব্য ঠিক হয়েছে মাইথন, পাঞ্চেত। সেখান থেকে গড় পঞ্চকোট। ঘোরা শেষে আমাদের আদ্রায় নামিয়ে দেবেন চালকদাদা। সেখান থেকে রাতের ট্রেন ধরে হাওড়া ফিরব। চালকদাদাকে বলে দেওয়া হয়েছিল, গন্তব্য যা-ই ঠিক করা হোক না কেন পথে কিছু দেখতে পেলে থামব।

ওই সেই দূর দ্বীপ। যেথায় যাত্রা করে সবাই। মাইথন।

কোন পথে যে সেই সফর হয়েছিল এত বছর পরে আর মনে নেই। তবে একটা জিনিস মনে আছে। চালকদাদার সঙ্গে প্রচুর আলোচনা করছিলাম এলাকার অবস্থা নিয়ে। যথারীতি মাওবাদী প্রসঙ্গ এল। এই একটা জিনিসে আমি কোথাও কাউকে ভাল বলতে শুনিনি। সকলের মধ্যেই বিরক্তি দেখেছি। সে পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া— যেখানেই হোক না কেন। ত্রাস একটা কারণ। আরেকটা কারণ এই সব চালকদের রুটিরুজিতে টান পড়া। আমাদের দলেরই এক সদস্যের বাড়িতে পুরুলিয়া যাব শুনে নিষেধ করছিল। তার পরে আলোচনা অবশ্য প্রকৃতির দিকেই ঘুরে গিয়েছিল। চালকদাদা পরামর্শ দিয়েছিলেন, বসন্ত কালে আসতে। তখন প্রচুর পলাশ ফোটে। চারিদিক লাল হয়ে যায়।

তরঙ্গ বাহিত। মাইথন।

পুরো দল থাকলে প্রচুর হইহই করা যায়। কিন্তু এবার মাত্র দু’জন। একা একা বেশিক্ষণ ইন্দ্রর পিছনে লাগা যায় না। ফলে রাস্তার দু’পাশ দেখতে দেখতে চলা। এক জায়গায় পৌঁছে দেখলাম, প্রতিটা গাছের পাতা কালো হয়ে গিয়েছে। কী ব্যাপার? চালকদাদা বললেন, ‘‘কাছেই কয়লা খাদান রয়েছে। কয়লা গুঁড়ো উড়ে পড়ে গাছের পাতা ভরে দিয়েছে।’’ কয়লা খাদান দেখিনি কখনও। চালকদাদাকে অনুরোধ করা হল, যেন একবার নিয়ে যান খাদানে।

সাহসী ইন্দ্র।

গিয়েছিলাম সেদিন খাদানে। জায়গাটা বরাকর সম্ভবত। পরিত্যক্ত খাদান। বিশাল এক জায়গা। যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর বুকে এখন বড় বড় সব ক্ষত। সেই ক্ষত কিছুটা ভরার চেষ্টা করে জল। খাদগুলোয় একেকটা জলাশয় তৈরি হয়েছে। চারিদিকে এবড়োখেবড়ো পাথরের স্তর। রুক্ষতার মধ্যেও কেমন একটা সৌন্দর্য আছে। ঘুরতে ঘুরতে একটা পাথর চোখে পড়ল। উপরের অংশে দু’টো ক্ষত তৈরি হয়েছে। নীচের দিকে কিছুটা ভাঙা। একটা মানুষের অবয়ব তৈরি হয়েছে যেন। উপরের দু’টো ক্ষত চোখ। আর নীচের ভাঙা অংশটাকে মুখ বলে চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমার দেখে অরণ্যদেবের খুলি গুহা মনে হচ্ছিল। কিন্তু ইন্দ্র তেমন সায় দিল না। খাদান থেকে বেরিয়ে এলাম। অনেকটা পথ যেতে হবে। অনেক কিছু দেখা বাকি।

চিনা মুরগি।

এবার আমাদের গন্তব্য মাইথন বাঁধ। ভিন রাজ্যে প্রবেশ করব। তবে মাইথনে পৌঁছনোর আগে একটা মন্দিরে ঢুকেছিলাম সম্ভবত। হংসেশ্বরী মন্দির কি? চালকদাদা সেরকমই বলেছিলেন বোধহয়। নোটবুকের পাতা ফুরিয়ে বলে সেটা হারিয়েছে। তাই যাচাইয়ের সুযোগ নেই। আর ইন্দ্রর স্মৃতি হাঁসেদের মতো। স্থায়ী নয় বেশিক্ষণ। ছ’বছর আগের কথা জিজ্ঞাসা করলে পূর্বজন্মের কথা জানতে চাইছি ভেবে ভড়কে যাবে। ধরে নিই হংসেশ্বরী মন্দির। কিন্তু উইকিপিডিয়ায় দেখাচ্ছে কল্যাণেশ্বরী। মাইথন নামটা হিন্দি ‘মাঈ কি স্থান’ থেকে এসেছে। মানে মায়ের থান। আর সেটা এই মন্দিরের দেবী কল্যাণেশ্বরীর জন্যই। পাঠকেরা যদি কেউ সংশোধন করে দেন।

ঘাটের কাছে নৌকা বাঁধা আছে।

মাইথন বাঁধে যেটা মনে প্রথম দাগ কাটল সেটা একটা উদ্বোধন ফলক। তাতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়ার নাম লেখা। ঝাড়খণ্ডের রাজনীতি থেকে মধু কোড়া মুছে গিয়েছেন। কিন্তু মাইথন বাঁধে তাঁর নাম স্থায়ী হয়ে গিয়েছে। ও হ্যাঁ, সেতুতে ওঠার আগের বাঁকে রাস্তার পাশে বড় বড় পাথর ঝুলে আছে দেখেছিলাম। সতর্ক করার বিজ্ঞপ্তিও ছিল, ধসপ্রবণ এলাকা বলে। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের বাঁধ। বাঁধের উপর দিয়ে দুই রাজ্যের গাড়ি যাতায়াত করছে। কিছু গাড়ির নাম্বার প্লেটে ডব্লিউবি। কিছুর জেএইচ। আন্ত:রাজ্য চলমানতা ভাল লাগছিল।

গড় পঞ্চকোট পাহাড়।

বাঁধের উপর থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশ ভাল। তবে আমাদের বেশি ভাল লাগছিল সেতু পেরিয়ে গিয়ে। সেখানেই দেখলাম লোকজনের বেশি জমায়েত। ঘাটের কাছে অনেক নৌকা বাঁধা আছে। পর্যটকদের নৌকাবিহারের ব্যবস্থা। দূরে একটা দ্বীপখণ্ডের মতো জায়গা। প্রচুর গাছপালা আছে তাতে। ওখানেই গন্তব্য দু’একটা নৌকার। ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করছিল, ‘‘নৌকায় যাবে দ্বীপে?’’ রাজি হলাম না। নদে প্রচুর ঢেউ। সময় লাগবে বেশ। থাকা যাবে না বেশিক্ষণ। কারণ সেই আদ্রা থেকে ট্রেন ধরতে হবে। তাই ক্ষান্ত দিলাম। ইন্দ্র একটু চটে গেল।

একরেখ মন্দিরটি।

মাইথন থেকে এলাম পাঞ্চেত। এখানেও বাঁধের নীচে সার সার নৌকা দাঁড়িয়ে। কিন্তু ভিড়ভাট্টা একদমই নেই। জল স্থির। নীরবতা একটা সৌন্দর্য থাকে। সেটা পেলাম এখানে। নৌকোগুলো মাছ ধরার। দু’একজন নৌকায় ছিলেনও। কিছুক্ষণ ছিলাম পাঞ্চেতে। একটু খিদে খিদে পাচ্ছিল ইন্দ্রর। চালকদাদাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, ‘‘কাছেই একটা চিড়িয়াখানা মতো আছে। সেটা দেখে এসে খাব।’’

বড় অপরূপ।

চিড়িয়াখানা মানে এক ব্যক্তি বেশ কিছু জীবজন্তু রেখেছেন একটা জায়গা ঘিরে। সেখানে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। মিনি সেই চিড়িয়াখানায় বেশ কয়েক ধরনের সাপ রয়েছে। রয়েছে গিনিপিগ, খরখোশ। কয়েকটা বাঁদর। আর কিছু মুরগির মতো প্রাণী। ইন্দ্র বলছিল চিনা মুরগি। আর দেখেছিলাম টার্কি। সেই প্রথম। কাছে গেলেই পালক ফুলিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল। ইন্দ্র বরাবরের সাহসী ছেলে। সেদিন আরেক সাহস দেখেছিলাম। একটা অজগর ছিল চিড়িয়াখানায়। ইন্দ্র অজগর গলায় ঝুলিয়ে পোজ দিয়েছিল। আমাকেও নিতে বলছিল। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। তবে আমি ইন্দ্রর ছবি তুলে দিয়েছিলাম। সে ছবি বহুদিন ওর ফেসবুকের প্রোফাইল পিচকারে জ্বলজ্বল করেছে। সাহসিকতার পুরস্কারও পেয়েছে। অনেক ফেসবুক বন্ধুনি।

গড়ের ধ্বংসস্তূপ।

খাওয়াদাওয়া করে রওনা দেওয়া গড় পঞ্চকোটের দিকে। এতক্ষণ জলযাত্রা হল। এবার পাহাড়িয়া বাঁশির টান। গড় পঞ্চকোট জায়গাটা বড়ই সুন্দর। আসার পথে অনেক টুকরো টুকরো ছবি জমা হচ্ছিল। তকতকে মাটির দেওয়ালে ছবি আঁকা বাড়ি, গোধূমি বেলায় ঘরে ফেরা গরুর দল। গড় পঞ্চকোটে ঢুকতে চোখে পড়ল এক ধরনের বাঁশ গাছ। সরু সরু বাঁশ। ছোট ছোট পাতা। ঝোপের মতো হয়ে আছে। পাতার ফাঁক দিয়ে কেমন পাতা পাতা বেরিয়ে আছে। এমন বাঁশ গাছ এত বছরের ঘোরাঘুরিতে আর দেখিনি।

গড় পঞ্চকোটের দু’টো রূপ। চত্বরটায় গিয়ে দাঁড়ালে প্রথমেই চোখ চলে যাবে পাহাড়ের দিকে। গাছগাছালির মখমলে ঢাকা যেন বিশাল একটা তাঁবু। সগর্বে মাথা উঁচু করে রয়েছে। এটা দূরের দৃশ্য। কাছে বাঁ হাতে এক গর্বিত রাজবংশের ইতিহাসের চিহ্ন বয়ে চলেছে ভাঙাচোরা প্রাসাদের দেওয়াল। এখানে শিখর রাজবংশের গড় ছিল। সেই গড়ের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাহাড়তলিতে। কবির কথায়, ‘রাজছত্র ভেঙে পড়ে…’। প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে একটা পঞ্চরত্ন মন্দির। সে এক এখন শুধু গৌরবহীন প্রাচীন। ডান পাশে আরেকটি একরেখ মন্দির রয়েছে। সেই মন্দির মেরামত করা হবে বলে একজন ২০ টাকা চাঁদা নিয়ে নিল।

জয়চণ্ডী পাহাড়।

পড়ন্ত বিকেলে আমরা পাহাড়ের দিকে চেয়ে ছিলাম। এত সুন্দর! পাহাড়ে যদি ওঠা যেত। কিন্তু চালকদাদা বারণ করলেন। ঘন জঙ্গলে সন্ধের আগে না যাওয়াই ভাল। ইন্দ্র বলেছিল, আরেকবার আসতে হবে। দলবল নিয়ে। না আর যাওয়া হয়নি ওদিকে। শুনেছি ও দেখেছি, ওই জায়গাটার বেশ পরিবর্তন হয়েছে। একটা হোম স্টে তখনই তৈরি হচ্ছিল দেখেছি। মন্দিরগুলোও নাকি সংস্কার করা হয়েছে। সৌন্দর্যহানি হয়েছে কিনা বলতে পারব না।

ও হ্যাঁ, ফেরার পথে জয়চণ্ডী পাহাড়েও গিয়েছিলাম। তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। পাহাড়ে কিছুটা উঠেছিলাম। কিন্তু শরীর আর দিচ্ছিল না। আদ্রায় ফিরে প্ল্যাটফর্মে বসে ঝিমোচ্ছিলাম।

কভারের ছবি— গড় পঞ্চকোট

ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *