পাখি
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ইতিউতি হাওড়ার জীবজগৎ— নবম পর্ব

যথা ইচ্ছা তথা যা

বৃষ্টি এবার বেশ খামখেয়ালি। মাঠেঘাটে জল আছে শীতকালেও। সেই কারণেই বোধহয় এবার শীতের পাখি বেশি দেখা যায়নি। বিশেষ করে ভূমিচর পাখিগুলো। আমাদের পাতিহাল গ্রামের কথা বলছি। তবে এ বছর মন ভরিয়ে দিয়েছে মুনিয়া। তিন রকম মুনিয়া দেখা গিয়েছে। প্রজাপতির ওড়াওড়ি বেড়েছে বেশ এবার। কিন্তু খুব বেশি জনকে ক্যামেরা বন্দি করা যায়নি। জীবজগতের উঁকিঝুঁকির অভিজ্ঞতা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া গেল।

১। স্বর্ণগোধিকা

গন্তব্যে চলার ফাঁকে।

চণ্ডীমঙ্গলে কালকেতুর জীবনে সুখ সমৃদ্ধি বয়ে এনেছিল এক স্বর্ণগোধিকাই। ছদ্মবেশী দেবী চণ্ডী। আমরাও সন্ধান পেয়েছিলাম স্বর্ণগোধিকার। একবার ঘুরতে যাওয়া হয়েছিল মাদুর গ্রামে। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের কানুপাটে। সেখানে এক মাঠে দেখতে পেয়েছিলাম। ছবিও তুলি। কিন্তু সৌভাগ্য তেমন ফেরেনি আমাদের। তার পরে তো আবার অতিমারির কারণে বেরনো বন্ধ হয়ে গেল। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।

২। প্রজাপতি –ক

তখন ক্ষণিকের বিশ্রামে।

গোটা হাওড়া জেলার কথা বলা অভিজ্ঞতার বাইরে। কিন্তু পাতিহাল ও আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর প্রজাপতি দেখতে পাচ্ছি আমার। বিভিন্ন পর্বে কয়েকটি ক্যামেরা বন্দি করা গিয়েছিল। এই পর্বে ছোট মতো একটাকে অনেকক্ষণের চেষ্টায় ফোকাসে আনতে পেরেছিলাম। হাতের কাছে ছিল ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ বইটি। ডক্টর সৌরভ দোয়ারী ও প্রফেসর অমলকুমার মণ্ডলের লেখা বই। সেখানে দেখলাম এই প্রজাপতিটির নাম, তিলাইয়া। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।

৩। প্রজাপতি-খ

প্রকৃতির বড় সুন্দর সৃষ্টি।

আরও একটা প্রজাপতি সেদিন দেখতে পেয়েছিলাম। ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’র ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম। মনে হল, এই প্রজাপতিটা বাংলায় কড়ি নামে পরিচিত। ভুলও হতে পারে আমাদের। অভিজ্ঞতা কম। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।

আমার ভুল হয়েছে যথারীতি। ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারী। তিনি বললেন— ‘প্রজাপতিটি কড়ি নয় এর নাম ফুরুৎ বা ফুরুস (Psyche)। ওড়ার ধরন থেকে এদের বাংলা নাম হয়েছে’।

৪। পোকা

সুন্দর পোকা।

কী পোকা জানা নেই। ঝোপের ভিতর একটা পাতায় বসেছিল। ঠিক যেন কুঁচ ফল। নড়াচড়া করায় বোঝা গিয়েছিল ওটা পোকা। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি তোলায় তেমন সুবিধা হয়নি। নাম জানা নেই আমাদের। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।

পরিবেশকর্মী সৌরভ দোয়ারী বলছেন— ‘এই পোকাটি একধরনের লেডি বা লেডিবার্ড বিটল’।

৫। শিকরে বাজ

বাড়ির কার্নিশে শিকারের অপেক্ষায়।

শিকারি পাখির সংখ্যা বেড়েছে। মাঝে মাঝে উড়তে দেখা যায়। নয়তো বিদ্যুতের খুঁটির একেবারে টংয়ে বসে থাকে। একদিন বাড়ির ছাদে বসেছিল। ধরে নিলুম ক্যামেরায়। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।

৬। হোয়াইট রাম্পড মুনিয়া

খামারে খাবার খুঁজছে সাদা বুক মুনিয়া।

জলে ডোবা জমিগুলো থেকে সব ধান কেটে নিতে পারেননি চাষিরা। দীপকদা অনেকদিন ধরেই বলছিল, হেলে পড়েও কোনও মতে মাথা তুলে থাকা ধানগাছে কিছু পাখি আসে। ২৫ ডিসেম্বর আমরা বনভোজন করছিলাম ছাদভোজনই বলা যায়। দীপকদাদের বাড়ির ছাদে। সেদিন বলাই ছিল ক্যামেরা আনতে হবে। আমার বোন নন্দিতা কয়েকটি ছবি তুলেছিল। তবে পাখিগুলো ছিল জমির উল্টোদিকের বাঁশবাগানের নীচে। ওই জায়গাটা চাষিরা খামার হিসেবে ব্যবহার করেন। দেখা গেল, পাখিগুলো হোয়াইট রাম্পড মুনিয়া। সুন্দর দেখতে। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)

৭। বনবিড়াল বা কটাশ

একসময়ে আমাদের পাতিহাল গ্রামে প্রচুর কটাশ ছিল। সন্ধে হলেই অদ্ভুত স্বরে ডাকত। মনে হত যেন ‘বাপ বাপ’ বলে ডাকছে। গ্রামের লোকের হাঁস, মুরগি কম ধরত না। পুকুর পাড় থেকে হাঁস তুলে নিয়ে পালিয়েছে। লোকের পোষা পায়রা মেরেছে। তার পর কোনও কারণে আর সন্ধে হলে ডাক শোনা যেত না। এখনও আর যায় না।

একদিন আমি স্কুটি নিয়ে বড়গাছিয়া থেকে ফিরছি। তখন সন্ধের ঠিক আগে। দেখি, দীপকদা হাঁটছে। আমাকে দাঁড় করাল। নানা কথা হচ্ছে। তখনই দীপকদা উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘‘বাবলা বাবলা মোবাইল বার কর। ওই দেখ!’’ দেখি একটা কটাশ কেটে রাখা ধানের আঁটিগুলোর ফাঁকে বসে রয়েছে ঘাপটি দিয়ে। ইঁদুর ধরছিল মনে হয়। আমরা রয়েছি দেখেও নড়েনি। সামান্য কাছে গিয়ে মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার চেষ্টা করেছিলাম। কোনও মতে একটা শট। তার পরেই দুদ্দাড় করে ছুটে পালাল। কম আলো, খড়ের রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়া। তার উপরে মোবাইল ক্যামেরা। ছবি ভাল হয়নি। দেখা গিয়েছে তার অল্প প্রমাণ। একটা, দু’টো কটাশ বা বনবিড়াল বোধহয় ফিরে এসেছে। এটাই ভাল খবর। (বিভাস বাগের অভিজ্ঞতা)।

৮। রঙিন গঙ্গাফড়িং

রংবেরঙের গঙ্গাফড়িং।

এমনটা দেখিনি কোনওদিন। প্রজাপতির পিছনে ধাওয়া করতে করতে চোখে পড়লে। সামনেটা লাল। পিছনের অংশটা কালো। ঝোপের ভিতর পাতার উপরে চুপ করে বসেছিল। অনেকক্ষণ পোজ দিয়েছে। কিন্তু আমিই ঠিক মতো ফোকাসে আনতে পারছিলাম না। ছবি ভাল ওঠেনি। নামও জানি না। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারী বললেন— ‘পোকাটি হল একধরনের bush cricket. ইনি আবার nymph, মানে পোকাদের খোকা। বড় হতে হতে কালচে সবুজ হয়ে যাবে। নাম Conocephalus sp’।

৯। ফড়িং

সিড়িঙ্গে ফড়িংবাবু।

লম্বা। কিন্তু ভীষণ রোগা। ছোটবেলা থেকেই দেখছি। কিন্তু ইংরেজি নাম বা বাংলা নাম কিছুই জানি না। ছবি তুলে নথি রাখা হল। কেউ যদি নাম বলে সাহায্য করেন। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারী বললেন—ফড়িংটি একধরনের Damselfly, এর নাম Coromandel Marsh Dart’।

১০। শিয়াল

শিয়াল। বেশ বড়। সঙ্গীটা পালিয়েছে তখন।

জ্যাকেল এবং ফক্সের পার্থক্য কোনওদিন করতে পারিনি। আমাদের গ্রামে একসময় প্রচুর শিয়াল ছিল। মাঝে কমেছিল। এখন আবার বেড়েছে। আমাদের বাড়ির কলতলায় বাটিতে বিড়ালের খাবার দেওয়া থাকে। রাতে অন্য প্রাণীরা খেতে আসে। বেশ কয়েকবার গন্ধগোকুল দেখেছিলাম। সেদিন শিয়াল দেখলাম। দু’টো শিয়াল। বাটি থেকে খাবার খাচ্ছিল। একটার ছবি তোলা গিয়েছে কোনও মতে। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারীর সংযোজন— ‘জ্যাকেল আর ফক্স এর সবচেয়ে বড় দুটি পার্থক্য, জ্যাকেল আকারে বড় আর ফক্স এর লেজে লোমের গুচ্ছ অনেক বেশী, আরো কিছু পার্থক্য আছে।এক সময় হাওড়া জেলায় ফক্স ভালো সংখ্যায় ছিল। এখন নেই বলাই চলে। অনেক বছর ধরে নিজে ও অন্যান্যদের চেষ্টাতে একটিরও হদিস করতে পারিনি। অনেকে দেখেছে বলে নিয়ে গিয়েও দেখাতে পারেননি’।

১১। বাদুড়

বাদুড়ের ট্রাপিজের খেলা।

পাতিহালের মন্দিরতলায় এ টি দেবদের (অভিধান, দেবসাহিত্য কুটীর) জায়গায় একটা বিশাল মৌফল গাছ আছে। মানে মহুয়া গাছ। বসন্তে ফুল এলে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় আসত সন্ধ্যেবেলায়। বাড়িঘর বেড়ে যেতে গাছে বাদুড় আসা কমেছে মনে হয়। আমাদের বাদুড়ের ছবি ছিল না। বাবলা মানে বিভাগ বাগ খবর দিল, ওদের বাড়ির কাছে একটা পুরনো বাড়িতে প্রচুর বাদুড় আছে। কড়ি বরগা থেকে ঝোলে। একদিন গিয়ে ছবি তুলে আনা হল। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।

১২। তিলা মুনিয়া

অতিথিদের ঝাঁক।

হোয়াইট রাম্পড মুনিয়ার ছবি তোলার দিনেরই ঘটনা। পাখিগুলো সব বাঁশবাগানে, বিদ্যুতের তারে বসেছিল। আলোর দিকে আর অনেক উঁচুতে হওয়ায় সব ছবি ছায়া ছায়া আসছিল। তার পর এক এক করে পাখিগুলো নামতে শুরু করল ধান জমিতে। সেই জলে ডোবা, হেলে পড়া, ছন্নছাড়া ধানের ছড়ার উপরে। আমার কাজ সহজ হল। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।

কভারের ছবি- মোহনচূড়া বা হুদহুদ

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *