সন্দেশ। রাধাবল্লভ।
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

গুটকে সন্দেশ আর দুই কিংবদন্তী

দীপক দাস

মিষ্টির এমন মজারু নাম কখনও শুনিনি। মজার জন্য মিষ্টি তৈরি হয়েছে। যেমন সূর্য মোদকের জলভরা তালশাঁস সন্দেশ। জামাই ঠকাতে তৈরি। এটিও সন্দেশ। কিন্তু নাম শুনলেই মনে হয়, পাড়ার কোনও ফাজিল ছোকরা এই বুঝি মুখ ফস্কে কিছু বলে ফেলল। সন্দেশের নাম গুটকে। পাড়ায় পাড়ায় কত গুটকে এক সময় ছিল। সন্তানের নামকরণে এবং ডাক নামে আধুনিকতার জোয়ার এসেছে। ফলে গুটকেরা হারিয়েছে। কিন্তু সন্দেশ গুটকে রয়ে গিয়েছে বহাল তবিয়তে।

গুটকে সন্দেশের খোঁজ দিয়েছিলেন প্রত্যয় ভুক্ত মহাশয়। শ্রীরামপুরের বাসিন্দা। পরিচিতির বাইরে এক মিষ্টি-শুভানুধ্যায়ী। ‘গুরুচণ্ডালী’ ওয়েবসাইটে মিষ্টি নিয়ে এক লেখায় তিনি মন্তব্য করে তথ্য দিয়েছিলেন। সেই তথ্য ধরেই শ্রীরামপুর গমন। শ্রীরামপুরকে ইতিহাসের নগরী বলেই মনে হত বরাবর। একসময়ের দিনেমার উপনিবেশ। দরিয়ার দৈত্য ভাইকিংদের খুঁজে পাওয়া এলাকা। সেখানে নাম করেছে সন্দেশ! খোঁজ নেওয়া কর্তব্য।

কর্তব্যবোধেই প্রাণিত হয়েছিলাম এই মঙ্গলবার। সন্দেশের খোঁজে বেরোব। কিন্তু দলটারই কেমন যেন ছানা কাটা অবস্থা। মিষ্ট্যভিলাষী সফরসঙ্গীরা মনে হয় ত্যাগই করেছেন আমাকে। হতে পারে বয়স বাড়ার কারণে আমার জিভের মিষ্টি শোণিতে সাঁতার দিতে শুরু করেছে বলে। অথবা সঙ্গীরা মিষ্টতর কোনও কিছুতে মজে। ফলে একাই বেরোতে হল।

গোস্বামী পাড়ার দোকান।

শ্রীরামপুর স্টেশনে নেমে কিছুটা থমকানো। সংগৃহীত তথ্য মানিকতলা, রাধাবল্লভ মন্দির আর মহেশচন্দ্র দত্ত। প্ল্যাটফর্মের এক মনোহারি দ্রব্য বিক্রেতার সাহায্য প্রার্থনা। তিনি এক ধাপ এগিয়ে এক মুড়ি বিক্রেতার স্টলে পাঠালেন। পথ নির্দেশ পেলাম। সাবওয়েতে নেমে ডানদিকে গিয়ে রাস্তায় উঠে বাঁদিকে সোজা হাঁটা। এক মোড়ে পড়বে মহেশচন্দ্র দত্তের মিষ্টির দোকান। হাঁটা পথে জিজ্ঞাসাবাদে পৌঁছনো গেল মোড়ে। একদম মোড়ের মাথাতেই দোকান। বেশ জমাটি। জায়গাটি গোস্বামী পাড়া। রাহা পরিচয়, ঠাকুরদাস বাবু লেন।

ভিড় ছিল দোকানে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। আগে আসা সকল খদ্দের ছাড়ার পর পালা এল। দোকানের এক কর্মী জানতে চাইছিলেন, কী নেব আমি। একটু সংকোচ নিয়েই বললাম, ‘‘গুটকে সন্দেশ পাওয়া যায়?’’ মিষ্টির নামকরণে অনেক জটিল আবর্ত আছে। তার মাঝে ঢুকে পড়লে অনেক সময়ে ভুলভুলাইয়ার চক্কর। তখনও পর্যন্ত গুটকে নামে ঠিক প্রত্যয় জন্মায়নি। কর্মীটি অবশ্য গুটকে আছে বলেই জানালেন। ঘুরে অন্য দিকে আসতে বললেন। সেদিকের শোকেসেই আছে অভিষ্ট সন্দেশ। কর্মীটিকে আসার উদ্দেশ্য জানাতে তিনি বললেন, ‘‘মালিক তো এখন দোকানে নেই। এই মাত্র মেয়েকে বাড়িতে রাখতে গেলেন।’’ গলার স্বরে বুঝলাম, এঁরা হুগলির গাংপুরের রাবড়িকর বা আমতার চালতাখালির শনপাপড়িকরদের মতো খেপচুরিয়াস নন। সাহায্য করতে প্রস্তুত।

গোস্বামী পাড়ার দোকানের গুটকে।

মালিক আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ততক্ষণে ছবি তোলার কাজগুলো সেরে রাখা যেতে পারে। সঙ্গীদের দামি ক্যামেরা নেই। মোবাইল ফোনই ভরসা। ছবি তুলতে তুলতেই মালিক এসে হাজির। নাম সুকান্ত দাস। মহেশচন্দ্র দত্ত তাঁর বাবার ঠাকুরমার বাবা। দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা মহেশচন্দ্রই। তাঁর আমলেই তৈরি হয়েছিল গুটকে সন্দেশ। কেন এমন নাম? সে বিষয়ে সুকান্তবাবু কিছু বলতে পারলেন না। শুধু জানালেন, সেই সময়ে এই এলাকা তেমন উন্নত ছিল না। মিষ্টি বলতে চিনির আর ছানার। গুটকে সন্দেশ মূলত পুজোর জন্য তৈরি হয়েছিল। লোকে এমনি খাবার জন্যও কিনত। কিন্তু পালাপার্বণেই এই সন্দেশের বিক্রি বাড়ে। যদিও প্রতিদিনই তৈরি হয় সন্দেশটি।

বালার ছবি দেওয়া বাক্স।

আর গুটকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কিংবদন্তী? সুকান্তবাবু জানালেন, তিনি শুনেছেন, মাহেশের জগন্নাথদেবের প্রিয় এই সন্দেশ। একবার জগন্নাথদেব বালা বন্ধক দিয়ে গুটকে সন্দেশ খেয়েছিলেন। কেন বালা বন্ধক দিতে হয়েছিল? ঠিক কী ঘটেছিল সেটা সুকান্তবাবু সঠিক বলতে পারলেন না। তাঁদের দোকানে জগন্নাথদেবের বালা বন্ধক দেওয়ার ঘটনাকে স্মরণীয় করার বন্দোবস্ত হয়েছে। সুকান্তবাবু দেখালেন, মিষ্টির বড় প্যাকেটে একটি সুদৃশ্য বালার ছবি। বালার মাঝের অংশে দোকানের নাম লেখা। আর লেখা, ‘স্থাপিত ১৮৫৬’। বেশি মিষ্টি কিনলে দোকান থেকে ব্যাগ দেওয়া হয়। সেই ব্যাগেও বালা বন্ধক দেওয়ার ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বয়ানটা এরকম, ‘বালা বন্ধক রেখে শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের গুটকে সন্দেশ খাওয়ার পৌরানিক কাহিনীর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান’। ব্যাগে দোকান স্থাপনের বাংলা ও ইংরেজি দুই সনই দেওয়া। বাংলা ১২৬২ বঙ্গাব্দ। ইংরেজি ১৮৫৫ সাল। এ তফাৎ সম্ভবত বঙ্গাব্দ থেকে সময় ইংরেজি সালে রূপান্তরে কারণে। গোস্বামী পাড়ার দোকানটি মহেশচন্দ্র দত্তের আদি দোকান নয়। সে দোকান মানিকতলায়। গোস্বামী পাড়ার দোকানটি পরিবারের একটি শাখা করেছেন।

আদি দোকান। মানিকতলায়।

শিকড়ে ফেরা ও শিকড় ছোঁয়া খুব জরুরি বিষয়। ফলে মানিকতলায় গমন টোটো সহযোগে। শ্রীরামপুর বেশ জমজমাট নগর। ভিড় দেখতে দেখতে চলে এলাম মানিকতলায়। জিটি রোডের একেবারে পাশে দোকান। ঢুকতেই চমক। আদ্যিকালের সজ্জায় দোকান। পাটার উপরে বসে রয়েছেন মালিক। কাচ লাগানো কাঠের শোকেসে মিষ্টি রাখা। শোকেসের বিভিন্ন খুপরিতে নানা মিষ্টি। বিশাল কাঁসার থালায়, গামলায়, ট্রেতে। সন্দেশ, রসগোল্লা, ক্ষীরের গজা, নলেন গুড়ের রসগোল্লা। এরকম পুরনো ছাঁদের দোকান দেখেছিলাম হাওড়ার বাগনানে, বামাচরণে। এখন সব মিষ্টির দোকানেই কাচের শোকেস। দাঁড়িয়ে দোকানদারি। গোস্বামী পাড়ার দোকানেও নব্য রীতির প্রচলন ঘটেছে।

আদি দোকানে বসেছিলেন সুব্রত দাস। তিনি আবার জানালেন, মহেশচন্দ্র তাঁর দাদুর দাদু। তাঁর সময়েই তৈরি হয়েছিল গুটকে সন্দেশ। সুব্রতবাবুও সন্দেশের নামের উৎস নিয়ে কিছু বলতে পারলেন না। জানালেন, মূলত পুজোর সন্দেশ হিসেবেই বিক্রি বেশি। তবে লোকেরও পছন্দের। কিন্তু তাঁর কথিত সন্দেশ নিয়ে কিংবদন্তীর সঙ্গে নব্য দোকানের কিংবদন্তী মিলল না। সুব্রতবাবু জানালেন, কাছেই রাধাবল্লভের মন্দির রয়েছে। ওই মন্দিরের অধিষ্ঠিত দেবতাই তাঁদের দোকানে বালা বন্ধক দিয়ে গুটকে সন্দেশ খেয়েছিলেন। গুটকে সন্দেশকে সে জন্য অনেকে বালা সন্দেশও বলে থাকেন। কেউ কেউ জোড়া সন্দেশও বলেন।

কাঁসার থালায় রাখা গুটকে।

কিন্তু দেবতা কেন হঠাৎ বালা বন্ধক দিতে গেলেন? এর উত্তর দু’টো দোকানেই মিলল না। সে উত্তর মিলছে শ্রীরামপুরের বাসিন্দা মিষ্টির সন্ধান দেওয়া প্রত্যয় ভুক্ত মহাশয়ের মন্তব্য থেকে। পূজারী নাকি একবার শীতলভোগে গুটকে সন্দেশ দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাই রাধাবল্লভ ছদ্মবেশে বেরিয়ে হাতের বালা বন্ধক দিয়ে সন্দেশ খান।

গুটকের উপর ও নীচের অংশ।

গুটকে আসলে কেমন সন্দেশ? কড়াপাকের সন্দেশ। ছানা ও চিনি যার উপকরণ। শীতকালে খেজুরের গুড় দেওয়া হয় চিনির বদলে। দু’টো সন্দেশ একসঙ্গে জোড়া থাকে। অনেকটা গুপ্তিপাড়ার গুপোর মতো। যদিও গুপো হয় চাকতির মতো দুই সন্দেশের জোড়। গুটকের একটা দিক একটু টেপা। গুপোর সঙ্গে এ সন্দেশের কোনও যোগ নেই বলেই জানিয়েছেন সুব্রতবাবু। গুটকের জন্ম শ্রীরামপুরেই। শুধু জোড়াতেই যা মিল। গুটকে ভাল মানের কড়াপাকের সন্দেশের মতোই খেতে। দুই দোকানের সন্দেশই খেয়েছি। স্বাদে বেশ ভাল। গোস্বামী পাড়ার সন্দেশ ছ’টাকা করে। মানিকতলার দোকানে ১২ টাকা। বেশি দামেরগুলো আকারে বড়। তবে গুটকে সাধারণ সন্দেশের তুলনায় আকারে কিছুটা ছোট।

মহেশচন্দ্র দত্ত। একদম ডানদিকে।

গুটকের জাত তো চেনা গেল। কিন্তু কিংবদন্তীর দুই পরত কেন? সঠিক ভাবে বলা শক্ত। অনুমান করা যেতে পারে, দত্ত পরিবারের কাছে জনশ্রুতির লিখিত কোনও বয়ান ছিল না। লোকমুখে প্রচারে জনশ্রুতিতে কিছু বদল ঘটতে পারে। আবার জনপ্রিয় বিষয়ের সঙ্গেও অনেক সময়ে জনশ্রুতি জড়িয়ে যায়। শ্রীরামপুরে রাধাবল্লভের থেকে মাহেশের রথ বেশি জনপ্রিয়। ফলে এমনটা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। মহেশচন্দ্র দত্ত গুণী ময়রা ছিলেন। তাঁর সন্দেশ বাসিন্দাদের প্রিয় ছিল। কারণ আদি দোকানে এখনও প্রচারের ক্যাচলাইন হিসেবে ‘প্রসিদ্ধ সন্দেশ বিক্রেতা’ কথাটি রয়েছে। এ দোকানে কোনও ভাজা মিষ্টি তৈরি করা হয় না। মহেশচন্দ্র গুটকে জনপ্রিয় করতে পেরেছিলেন। জনপ্রিয় হওয়ার কারণেই মিষ্টিটি রাধাবল্লভের ভোগে ঠাঁই পেয়েছিল। পরে পূজারীর কোনও বিচ্যুতিতে এমন কিংবদন্তীর জন্ম হলেও হতে পারে।

গুটকে নাম হল কেন? এখানেও অনুমান ভরসা। আকারে ছোট হওয়ার কারণেই সম্ভবত।

কভারের ছবি— আদি দোকানের গুটকে

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “গুটকে সন্দেশ আর দুই কিংবদন্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *