কভার পিকচার। মনোহরা।
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মুর্শিদাবাদে মনোহরা অভিযান

ফারুক আব্দুল্লাহ

অনেক দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল মনোহরা খাওয়ার। আসলে মুর্শিদাবাদের মানুষ হয়েও এতদিন জেলার এই জনপ্রিয় মিষ্টির স্বাদ আস্বাদন করার সুযোগ আমার হয়নি। অবশ্য তাতে আমি যথেষ্ট লজ্জিতও। কিন্ত ইচ্ছে থাকলেও তা পূরণের সুযোগ তেমন হয়নি। চেষ্টা যে একেবারে করিনি তা নয়। কিন্ত সেই চেষ্টা কোনওবারই সাফল্যের মুখ দেখেনি। তাই গত বছরের নভেম্বর মাসে মনোহরায় মন মাতাতে বেলডাঙা যাওয়ার পরিকল্পনা করেও কিছু ব্যক্তিগত কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাই ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রায় কোনও রকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছিলাম মনোহরার খোঁজে বেলডাঙার উদ্দেশ্যে।

আসলে মুর্শিদাবাদের মনোহরা বলতে সাধারণত বেলডাঙার মনোহারাকেই বোঝানো হয়। এই মনেহরা অভিযানে সঙ্গে পেয়েছিলাম ভাই বিশ্বজিৎ মণ্ডলকে (বিশ্ব)।

বিশ্ব বেশ এনার্জেটিক ছেলে। নিত্য নতুন এলাকার জনপ্রিয় খাবারের সন্ধানে বেরনোর ব্যাপারে বিশ্বর আগ্রহও বেশ পুরানো। আমরা দু’জনে যখনই কোনও নতুন জায়গায় যাই, নজর থাকে সেখানকার স্থানীয় খাবারের উপর। গতবছর ফেব্রুয়ারিতে রাজগির ও নালন্দায় গেছিলাম। সেখানেও আমরা স্থানীয় বহু খাবারের স্বাদ আস্বাদন করেছি।

মনোহরার কারখানায়।

যখন বেলডাঙা স্টেশনে পৌঁছলাম তখন দুপুর বেলা। আমরা এমন একটা ধারণা মনের মধ্যে পোষন করেছিলাম যে, বেলডাঙা মানেই হয়তো মনোহরার শহর। যেখানেই যাব মনোহরা পাবোই। সেই আশা নিয়েই আমরা স্টেশন থেকে বের হলাম বাজারের উদ্দেশ্যে। কিন্ত বাজারে পৌঁছে মনোহরা খুঁজতে গিয়ে মনে হল, ‘একী! কোথায় মনোহারা?’’ মিষ্টির দোকানের অভাব নেই ।কিন্ত অভাব শুধু মনোহারার। যে দোকানেই যাচ্ছি নিরাশ হচ্ছি। ইতিমধ্যেই আমরা মনোহারার খোঁজে প্রায় ৩ কিমি হেঁটে ফেলেছি। কিন্ত মনোহরার দেখা নেই।

বহু খুঁজে অবশেষে এক দোকানের খোঁজ পাওয়া গেল। মজার ব্যাপার হল আমরা শহরের বহু বড়, বড় দোকানে মনোহরার দেখা না পেলেও ছোট্ট, জীর্ণ, অপরিষ্কার একটি দোকানে মনোহারার দেখা পেলাম। সেখানে গিয়ে মনোহারার অর্ডার দিতেই দোকানদার এসে দিয়ে গেলেন। জীবনে প্রথম মনোহারা দর্শন করে মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। কিন্ত মনোহরায় কামড় বসাতেই সেই প্রফুল্ল মন হঠাৎ করেই বদলে গেল।মন ভরে গেল একরাশ বিরক্তিতে।

বেলডাঙার। ভিতর-বাহির।

বেলডাঙার মনোহরায় বাইরের চিনির প্রলেপ বেশ পুরু। ফলে প্রথম কামড় দিতেই মুখটা চিনির মিষ্টি স্বাদে ভরে উঠল। চিনির স্বাদ এতই তীব্র যে ভিতরের ছানার স্বাদ তেমন আর পাওয়া গেল না সে ভাবে। মনোহরার মোটা চিনির প্রলেপের জন্য একটি মনোহরা খেয়েই মুখের অবস্থা ইতিমধ্যেই খারাপ হয়ে গেছে। মনোহরার বাইরেটা যেমন শক্ত তেমনই ভেতরটাও আবার শুষ্ক। বাইরের চিনির প্রলেপ ভেঙে যেই ভেতরে প্রবেশ করলাম অমনি দেখি ভেতরের শুকনো ছানা ঝরে ঝরে পড়ছে।

এদিকে আমার মতো বিশ্বর অবস্থাও করুণ। সে ভেবেছিল দাদা এত দূরে শুধু মনোহরার জন্য এসেছে যখন তখন মনোহরায় হয়তো স্বর্গীয় স্বাদ রয়েছে। কিন্ত মিষ্টি মুখে দিতেই বেচারার সব মোহভঙ্গ হল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, এই মনোহরা কী ভাবে এত জনপ্রিয় হল? শুনেছি নবাবরাও নাকি এই মিষ্টির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কেন করতেন কে জানে। হয়তো তখন মনোহরা অন্য ভাবে তৈরি করা হত। বা হয়তো এখনকার মতো মিষ্টির এত বৈচিত্র ছিল না। তাই তখন এই মনোহারাই হয়তো মানুষের মন মাতাত। আমরা দোকানদারকে মনোহারার দুরবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি উত্তর দিলেন, দোকানে যে কয়টি মনোহরা পড়ে আছে তাই বিক্রি হবে কিনা সন্দেহ। মানুষ এসব আর খাচ্ছে না দাদা। মনোহরার দাম জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, মাত্র ৫ টাকা পিস। আমি শুনেছিলাম, ১০ টাকা পিসের মনোহরার কথা। সে কথা মুখে আনতেই দোকানদার জানালেন, কেউ অর্ডার দিলে তবেই বড় সাইজের মনোহরা তাঁরা তৈরি করে দেন। বিল মিটিয়ে বেশ অতৃপ্ত মন নিয়ে আমরা পা বাড়ালাম বাড়ির পথে।

হতাশ দুই। সেলফিতেই তৃপ্তি।

বাড়ি ফিরে মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিল। মনে হল, বেলডাঙায় গিয়ে যে দোকানে মনোহরা খেয়েছিলাম তার গুণগত মান হয়তো খারাপ ছিল। মনোহরা আদৌ হয়তো এতটাও খারাপ নয় খেতে। তা না হলে যুগ যুগ ধরে এই মিষ্টি মানুষের এত পছন্দের হত না। আমার মনে হল, আরও একবার মনোহরা খেয়ে দেখা দরকার। একবার খেয়েই এমন সিদ্ধান্তে আসা মনে হয় উচিত নয়। তবে বেলডাঙা আর যাবো না এমনই ভেবেছিলাম।

এমন সময় এক বন্ধু মারফত খবর পেলাম, লালবাগে একটি দোকান আছে। নাম ‘বেলডাঙা সুইটস’। শুনেই বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্ত সেখানে গিয়েও হতাশ হতে হল। দোকানদার জানালেন, এমনিতে তাঁরা মনোহরা তৈরি করেন না। তবে কেউ অর্ডার দিলে তৈরি করে দেন। কিন্ত সেখানেও শর্ত রয়েছে। কম অর্ডার দিলে হবে না। কমপক্ষে ২০০ থেকে ৩০০ পিস অর্ডার দিতে হবে। আরও একটি খবর পেলাম, বহরমপুরে কোনও এক দোকানে নাকি রোজ মনোহরা পাওয়া যায়।

বহরমপুরের তারা।

এক সন্ধ্যায় বিশ্বর সঙ্গে বাইকে বহরমপুর টেক্সটাইল কলেজের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই এক মিষ্টির দোকান চোখে পড়ল। চোখ গেল দোকানে সাজানো নানান মিষ্টির দিকে। কিন্ত প্রথমেই আমার চোখ আটকালো মনোহরাতে। ফলে মনোহরার স্বাদ আস্বাদনে সেই দোকানে হাজির। মনোহরা চাইতেই দোকানের এক কর্মী প্লেটে করে দিয়ে গেলেন। দেখি বেলডাঙার মনোহরার সঙ্গে আকারে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। শুধু এর মাথায় একটি করে কিসমিস বসানো রয়েছে।

এবার বড় আশা নিয়ে মনোহারা মুখে দিতেই সেই বেলডাঙার সেই পুরনো স্বাদ পুনরায় ফিরে পেলাম। আমি বড় কষ্টে কোনও রকমে দুটো মনোহরা শেষ করলেও, বিশ্ব পারল না। তার প্লেটের ক্ষতবিক্ষত মনোহরা প্লেটেই পড়ে রইল। আমরা দোকান থেকে বিল মিটিয়ে বাইকে উঠলাম। সেই সঙ্গেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, মনোহরা আর না। বিশ্বকে সে কথা জানাতেই হো-হো করে হেসে উঠে সে-ও আমার কথায় সম্মতি জানিয়ে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিল।

মনোহরার স্বাদের ভূত তখন আমাদের তাড়া করছে।

(সমাপ্ত)

One thought on “মুর্শিদাবাদে মনোহরা অভিযান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *