অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

আমার পোড়া শহরে তুমি…জাগো দুর্গা

জুয়েল সরকার

 

এক তাল মাটি, শুকনো খড়, আর বাঁশের কাঠামো লাগে…

আরও লাগে, অনেকটা অধ্যবসায় আর অনুকূল আবহাওয়া…এরপর তুলির টান। শেষে ‘চক্ষুদান’। তবেই তো প্রাণ পাবে মূর্তি।

কিছু অস্ত্রশস্ত্র গুঁজে দিতে হবে হাতের ফাঁকে। ব্যাস,তৈরি।

ঠিক এই ভাবেই আমাদের ভ্রমণ কাহিনীর বিগ্রহটি খাড়া করেছি। শুভ আর অরিজিতের সঙ্গে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো নবমীর রাতটাকে কাঠামো হিসেবে নিলাম। হাজারো হট্টগোল ঠেলে কলকাতার ঘোলাটে অন্ধকার আর দমচাপা বাষ্পে ভরা গলিগুলোতে যে ক্যানভাস খুঁজে পেয়েছি, তাদের তাল বানিয়ে খড়ের কাঠামোয় মাখিয়ে দেব ভাবছি!

তবে শুধু এতেই হবে না, চক্ষুদান করা চাই বিগ্রহের। তার জন্য বেছেছি চিত্রগ্রাহকের তোলা ছবিগুলি।…

প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, এই লেখা ছবি সর্বস্ব। এতে লেখার গুণগত মান উন্নত করার দায় অনেকটা কমে।

যাত্রা শুরু

‘যদি তুমি তাড়াতাড়ি যেতে চাও, তবে একা যাও। আর যদি অনেক দূর যেতে চাও তবে কেউকে সঙ্গে নিয়ে যাও’- একটি পুরানো প্রবাদ। এবারে পুজোর নবমীর এই রাতটা যে কোথায় শেষ হবে, তা বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় আন্দাজ করতে পারিনি। হয়তো, না জেনে অনেক দূরে যাব বলেই সঙ্গে নিয়েছিলাম দুই নন্দি-ভৃঙ্গী শুভ আর আরিজিৎকে। শিয়ালদা স্টেশনে রাত ৮.৩০ দেখা করে প্রথমেই পেটায় নম করে নিলাম সবাই। সারা রাত টো টো করবার জন্য চাট্টিখানি এনার্জি দরকার তো! খেতে খেতেই ঠিক হল-‘ঠাকুর দেখব না, তার বদলে খানিক রাতের কলকাতা দেখলে মন্দ কী?’

তবে মন্দ যে ছিল তা বুঝেছি…কিছু পরে।

ধর্মতলায় পায়চারী (রাত-১২টা)

না, শিয়ালদা স্টেশন থেকে এক লাফে ধর্মতলায় এসে পড়িনি। মাঝখানে অনেক তর্ক, গল্প, ফটোসেশন আর লেগপুলিং ছিল। আর ছিল নাম না জানা একটা পুজোমণ্ডপ। ছোট পুজো। তেমন নামী নয়।

নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না হয়তো। ক’দিন আগেও খবরের কাগজে যে জায়গায় ভিড় থিক থিক করতে দেখেছি, আজ তা একেবারে শুনশান! রাস্তা দিয়ে কয়েকটা বাস, ট্যাক্সি গজরাতে গজরাতে ছুটছে ঠিকই, তবে, ফুট মার্কেটের সব দোকান বন্ধ থাকায় গোটা চত্বরটাই নিস্পন্দ লাগছে। বন্ধ হয়ে থাকা কে.সি. দাস যেন গোটা ধর্মতলা মোড়কে একেবারে কানা করে দিয়েছে। রসগোল্লা সম্রাটের আস্তানাকে পাশে ফেলে এগোতে শুরু করলাম প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে…

গোটাকয়েক গুমটি চায়ের দোকান ছাড়া সবই প্রায় বন্ধ। পুজোমণ্ডপ, ভিড়, জটলা কিছুই প্রায় নেই এদিকটায়।

আমাদের সুরক্ষায় অতন্দ্র।

ক্রসিংয়ে ট্র্যাফিক পুলিশের অতন্দ্র প্রহরায় সবে তন্দ্রার আক্রমণ এসেছে, সারা সন্ধে চরকিবাজি সেরে মানুষের দল জমছে বাসে বাসে, কেউ আবার অপেক্ষা করছে স্ট্যান্ডে… রাত বারোটা, কলকাতায় রাত নয়। তবে হলুদ আলোয়, চওড়া রাস্তাগুলো ট্র্যাফিকের অপ্রতুলতায় যেন ঝিমিয়ে আছে। যেন খুব কম বয়সেই গাম্ভীর্য এসেছে কোনও কিশোরের মুখে।

বাইরের অসাড়তা বুঝি মনকেও আড়ষ্ট করে। আমাদের কারও মুখেই প্রায় কথা নেই। মাঝেমাঝে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়াদান পর্ব চলছে, গলগলিয়ে মুখ থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়ার পাকদণ্ডী।

ইডেন পেরিয়ে কিছুটা এসেছি, রাস্তার পাশে ফুটপাথের নুইয়ে পড়া পোস্টের আলোয় কয়েকজন চুকিয়ে নিচ্ছেন রাতের খাবার পালা। ওদেরই পাশ কাটিয়ে যাবার সময় হঠাৎ পেছন থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে ডাক পাড়লেন একজন মহিলা। মুহূর্তের জন্য পেছন ফিরলাম, তবে দাঁড়ালাম না। বুঝলাম এ হল ‘TRADE CRY’…

পুজোর কলকাতায় এঁরা, ভিনরাজ্যের পকেটমাররাও আনুষঙ্গিক।

বিকিকিনিতে ক্লান্ত।

প্রিন্সেপ ঘাটে আমরা…ওরা (রাত- ১.১৫)

অস্বস্তি, অম্বল আর অ্যান্টাসিডের ভিড়ে ঠাসা এই শহরে একরাশ হালকা হওয়ার পরিবেশ হিসেবে প্রিন্সেপ ঘাট মন্দ নয়। তবে এত রাতেও যে সেই পরিবেশ অটুট থাকবে তা আশা করিনি!

রাত দেড়’টাতেও রমরমিয়ে ব্যাবসা চালাচ্ছে ফাস্টফুডের দোকান গুলি, পাতায় জমে থাকা ফুচকা টুপটাপ চালান হয়ে যাচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা খদ্দেরদের মুখে, গঙ্গার ধারে বেঞ্চে বসে খুট খুট সেলফির ঝলকানি তুলছে যুগল, আবার কোথাও বা উপস্থিত গোটা পরিবার। গরম চায়ের ভার আর ত্রিফলা আলোয় সরগরম হয়ে আছে এই জায়গাটুকু। আমারাও মধ্যরাতে গলা ভেজালাম এলাচ দেওয়া গরম চায়ে।

উৎসবের রোশনাই থেকে দূরে।

আপাত সহজ দৃশ্যের জটিল বর্ণনা কঠিন নয়। তবে সহজ ঘটনাগুলির সহজ বর্ণনা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে হয়…ওই যে গঙ্গার ধারে যে বেঞ্চগুলিতে কিছুক্ষণ আগে কত শোরগোল হতে দেখেছি, কিছুদূর এগিয়ে তাদেরই একটায় বিশ্রাম নিচ্ছেন কোনও এক দিনমজুর …রাজপথের ধারে ট্র্যাফিক ডিভাইডারকে বিছানার মতো পেতে শুয়ে আছে গোটা দুই পরিবার…ধানের ছড়ার পশার সাজিয়ে তার পাশেই শুয়ে থাকা মানুষ গুলি! ওদের বর্ণনা কীভাবে দেওয়া যায়?

শেষ রাতে জগন্নাথ ঘাট (রাত-৩.০০টে)

গুমোট, বেশ গুমোট এই এলাকা। ছোট একটা ভাগাড় রয়েছে পাশে, তার থেকেই চাপা দুর্গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে, হাওয়া দিলেও থমকে দাঁড়িয়ে থাকছে। ডাবের খোলা, ডাঁই করা ভাঙা চায়ের ভাঁড়, শালপাতার থালা আর পচে যাওয়া ফুলের সঙ্গে গতকালের কাদাগোলা বৃষ্টির জল পথকে চলার অযোগ্য করে রেখেছে। শুভর কথায় লক্ষ করলাম রাস্তার পাশেই আবর্জনায় পড়ে আছে কতগুলো পদ্মের কুঁড়ি, দেবীর পুজোর অযোগ্য ওরা, পচতে শুরু করেছে…এরই মাঝে রাস্তার এক পাশের একটি ভ্যানে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে দু’জন। বোঝা যায় পরিশ্রমই নিশ্ছিদ্র ঘুমের শেষ কথা।

পুজোয় বাতিল।

রাস্তার পাশেই জগন্নাথ ঘাট। পুরনো আমলের তেলচিটে খয়াটে রঙের বিশাল প্রবেশদ্বার। ঢুকেই সামনে অনেকখানি চওড়া এবং প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা, তার ঠিক শেষেই পাড় বাঁধানো সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে জলে। ঘাট থেকে সহজেই চোখে পড়ে হাওড়া ব্রিজ, নদীর দু’পাড়কে জুড়ে রেখেছে ধাতুতে বোনা এই বিশাল ব্রততী।

ঘাটের প্রশস্ত ফাঁকা অংশের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছড়িয়েছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছেন জনা পঞ্চাশেক মানুষ। গেঁজিয়ে ওঠা তরলের উপরিতলে জমে থাকা বুদবুদের মতো এঁরাও ভিড় জমিয়েছেন এখানে। প্রথম দর্শনে মানুষের মড়ক বলে ভুল হতে পারে কি?

ঘাটের পাশেই এক কোণে আড্ডা চলছে স্থানীয় লোকেদের, কেউ এখন থেকেই ফুলের পসার সাজিয়ে বসেছেন, আবার কোথাও লঞ্চ পারাপারের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।

তখন থেমেছে বাজনা।

ঘাট পেরিয়ে ছলে আসার সময় পাশে নজর পরতেই অবাক হতে হল। কী অবলীলায় নিজের বিছানায় কয়েকটি সারমেয়র সঙ্গে ভাগ করে শুয়ে আছেন কয়েকজন! আশেপাশের গ্রাম উঠে এসেছে পুজোর শহরে। তাতে এঁদের কিছু যায় আসে না। রোশনাইয়ের দুনিয়া থেকে দূরে এঁরা প্রাত্যহিকীর বাইরে নন। এঁদের কাছে পুজোর অর্থ কী?

জানি না। তবে এটুকু বুঝলাম, ঘুলঘুলি দিয়ে দুনিয়া দেখার প্রবণতা এবার ছাড়তে হবে…

উৎসব সফরে ক্লান্ত।

 ঝটিতি হাওড়া ব্রিজ (রাত-৩.৩০)

বাড়ি ফেরার জন্য বাস ধরতে হবে- এই ভেবে ব্রিজে উঠেছিলাম বটে, তবে ঠান্ডা জোলো হাওয়া পা জড়িয়ে ফেলল।

ব্রিজ পার হচ্ছে একের পর এক গাড়ি, থরথরিয়ে কেঁপে উঠছে গোটা কাঠামো, কাটা ফলের দোকানে দেদার বিক্রি চলছে প্লেটে প্লেটে, হাতঘড়ি-চশমার দোকানীরা শেষ রাতের ঝিমুনি সেরে নিচ্ছেন, ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানিরা যে যার ঠেলা গাড়িতে শয্যারত- এমন হাজারো টুকরো ছবি ছড়িয়ে আছে এখানে। রোজকার জীবনের ঢে- কুচ-কুচ যেন আমাদের জন্যই তোলা আছে, আর এঁরা আছেন তাদের আমেজে।

খদ্দেরের অপেক্ষায় নেমেছে ক্লান্তি।

যাত্রার শুরুতে মুখ খুললেও, শেষ দিকে অরিজিতের তেমন বুলি ফোটেনি। তাই প্রচণ্ড খিদের তাড়নাতেই হোক বা অন্য কিছুতে, বাবু মুখ ফুটে কুঁই কুঁই করে বললেন- ‘চল, কোথাও থেকে কিছু একটা খেয়ে নিই, কোনও দোকান খোলা পাবো কিনা কে জানে?’। অগত্যা, খবারের দোকানকে গন্তব্য ধরে এগোতে শুরু করলাম। একটা ফাস্টফুডের দোকান ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম…এবং আড়চোখে দেখলাম, হাসি ফুটেছে একটা মুখে।

ঘরে ফেরার পথে ( ভোর-৪.৩০)

ঘড়ি জানান দিচ্ছে ভোর হয়েছে। তবে আকাশ নয়। আলো ফোটেনি তেমন। হাওড়া থেকে শিয়ালদাগামী বাসে উঠে বসেছি কিছু আগে। সারারাতের ক্লান্তি জমেছে শরীরে। ঘুমের অনুভূতি প্রায় পঙ্গপালের মত জাঁকিয়ে বসেছে মাথায়। হঠাৎ, বাস কন্ডাক্টরের এক চাপড় পড়ল বাসের গায়ে, উড়ে পালাল আমার পঙ্গপালের দল।

সঙ্গী সারমেয়।

জ্যামে আটকে পড়েছে বাসটি, বুকে শ্লেষ্মা জমা বৃদ্ধের মত একটানা গড়ড় গড়ড় শব্দ তুলে তিরতির কেঁপে চলেছে। চোখ গিয়ে পড়েছে জানলার বাইরে…ট্র্যাফিকের ব্যস্ততার ফাঁকে কিঞ্চিৎ গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন এক ট্র্যাফিক পুলিশ; ওদিকে, একপাল ছাগলকে, ভিড়ে আটকে পড়া গাড়িগুলির ফাঁক দিয়ে প্রায় পুঁতির মতো গলিয়ে রাস্তা পার করাচ্ছেন জনৈক…

পৌঁছে দেওয়াতেই এঁর পুজো পরিক্রমা।

ব্যস্ততার শেষ নেই এই শহরে। দূরে হোক বা কাছে, গন্তব্যে পৌঁছনই সবার লক্ষ্য। গাছের পাতাকে, হাতের পাতার মতো করে দেখবার সময় কোথায়?…আট কোটির শাড়ি আর ‘বিশ্বের দীর্ঘতম আলপনা’র মাঝে, এমন অনেক জগন্নাথ ঘাট ফুরিয়ে যায়। শিউলি আর কাশফুলের মাঝে, স্যাঁতস্যাঁতে এঁদো গলিরা বিরক্তি জাগায়।

ছবি— শুভ (কচি) বৈদ্য

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *