শুঁড়ে কালনা
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মোটা মিহিদানা আর বোকা ময়রার রসভান্ডার

দীপক দাস

দোকানের নামটা চোখ টানে। আসলে নাম ঠিকানা-সহ পুরো লেখাটাই। দাস মহাশয় মিষ্টান্ন ভান্ডার। প্রো: দেবীপ্রসাদ (বোকা ময়রা) দাস। নামের মধ্যে পরিচিতির আভাস। কোনও একটা কিছুর প্রভাব সম্ভবত। আর দ্বিতীয় অংশটায় মালিকের নামের তুলনায় ডাকনামের প্রভাব বেশি সেটা বোঝা যায়। ডাকনামটাই সম্ভবত ব্র্যান্ড। আর এই ব্র্যান্ড নাম দোকানের নামের থেকেই বেশি পরিচিত। আমরাও কিন্তু বন্ধনীর নাম, অর্থাৎ ব্র্যান্ড নাম, শুনেই এসেছি।

দল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি কালনার একটা মিষ্টির দোকানে। কালনা বললে অনেকেরই চট করে হাওড়া-কাটোয়া লাইনের অম্বিকা কালনা মনে হতে পারে। সম্ভবত এখানকার বাসিন্দারাও এই পরিচিতি সঙ্কটে ভোগেন। তাই গুলিয়ে ফেলা থেকে বাঁচতে বা অন্যদের বাঁচাতে কোনও বুদ্ধিমান বাসিন্দা। নামের আগে শুঁড়ে শব্দটা যোগ করে নিয়েছেন। শুঁড়ে পাশের এক গ্রামের নাম। প্রকৃত উচ্চারণ শুঁড়া। লোকমুখে শুঁড়ে হয়েছে। শুঁড়ে কালনা পূর্ব বর্ধমানে। থানা জামালপুর। এই জামালপুর কিন্তু বর্ধমানের আরেক প্রান্তে বুড়োরাজের থানে খ্যাত জামালপুর নয়।

সুন্দর সীতাভোগ।

এপ্রিলের ২৫ তারিখে একটা বাইক অভিযান হয়েছিল। হাওড়া-হুগলি পেরিয়ে পূর্ব বর্ধমান। চাঁপাডাঙার ছেলে দীপ্তেন্দুবিকাশ জানা ওদের এলাকায় ঘুরতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিল বহুদিন। একদিন সময় হতে বেরিয়ে পড়া গেল। দু’টো বাইকে চারজন। দীপ্তেন্দু, দীপু, বাবলা আর আমি। একটা বাহনকে বাইক বলতে রাজনৈতিক সত্যে বিশ্বাস লোকজনদের খুব আপত্তি। কারণ এটি স্কুটি।

বেরনোর আগে দীপ্তেন্দুকে অনুরোধ করা হয়েছিল, ভ্রমণ-পথ এমন ভাবে সাজাতে যাতে মিষ্টি-ইতিহাস ও প্রকৃতির ত্র্যহস্পর্শ হয়। দীপ্তেন্দু ভারী ভাল ছেলে। সে ভাবেই সফর-সূচি তৈরি করেছিল। আমরাও নদ-নদী-সাঁকো, নদী বাঁধ পেরিয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম শুঁড়ে কালনায়। পথে ধাপধাড়া নামে একটা গ্রাম পড়েছিল। পাশের গ্রাম হরগোবিন্দপুর। তা নিয়ে কিছু মশকরা হল কিছুক্ষণ। কোন পথে গিয়েছিলাম মনে ছিল না। বাইকে চেপে থাকায় নোট নিতেও পারিনি। বয়স হওয়ায় স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। ফলে দীপ্তেন্দুর দ্বারস্থ হতে হল। ও জানাল, হুগলির পুরশুড়া মোড় থেকে ডান হাতে বেঁকে দেউলপাড়া ভাঙামোড় হয়ে খুশিগঞ্জ খেয়াঘাট। খেয়াঘাটের বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে বাঁধের রাস্তা ধরে ধাপধাড়া। ধাপধাড়া থেকে হরগোবিন্দপুর। বাঁধের ডান দিকের ঢাল ধরে নেমে কিছুটা এগিয়ে শুঁড়ে কালনা বাজারে বোকা ময়রার দোকানে।

মোটা মিহিদানা।

রাস্তার উপরেই দোকান। জায়গাটার নাম বাসন্তীতলা। আলাপ জমিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল। কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা এ পথে যাবেন। তার আগে পুলিশ রাস্তা পরিষ্কারে বেরিয়েছে। জিপ থেকে অফিসার কিছু একটা বলেছিলেন। শুনতে পাইনি। দীপু শুনতে পেয়েছিল। ও বলল, ‘‘অফিসার বললেন, এখানে কোনও বাইক থাকবে না’’ পুলিশ ভাববাচ্যে কথা বলছে! নির্দেশ না দিয়ে? ভালই লাগল। শোনা উচিত। আমাদের বাবলা মানে ছোটা ডন বিরোধী রাজনৈতিক দল করে। দীপু ওকে চিমটি কাটল, ‘‘কী রে তোর দাদা আসছে তো, দেখা করে যাবি নাকি?’’

বোকা ময়রার দোকানের কথা দীপ্তেন্দু শুনেছিল ওর মামার কাছ থেকে। তিনি কর্মসূত্রে এখানে ছিলেন। কালনায় শ্বশুরবাড়ি ছিল। ফলে বোকা ময়রার মিষ্টির দোকানের গুণাগুণ সঠিক ভাবে জানতেন। দীপ্তেন্দু মামার কাছে শুনেছিল, এই দোকানের সীতাভোগ, মিহিদানা আর কালাকাঁদ খুব ভাল। বর্ধমান শহর ছাড়াও সীতাভোগ, মিহিদানা একই জেলার অন্য প্রান্তে সুনাম ছড়িয়েছে? এটাই প্রথম আকৃষ্ট করেছিল। সে জন্যই আসা।

জলভরা এবং দোকানের কর্মী নবকুমার।

শুরু হল স্বাদগ্রহণ পর্ব। সীতাভোগ, মিহিদানা দিয়েই শুরু হল। সুগন্ধী সীতাভোগ আর ঘি জবজবে মিহিদানা সত্যি ভাল খেতে। সীতাভোগে ব্যবহৃত সবেদা বা সফেদা নিয়ন্ত্রণ মোদকের বড় কৌশল। ভাল চাল ব্যবহার না করলে সুগন্ধ আসে না। আবার সবেদা ভাল করে মিহি না করলে খাওয়ার সময় জিভে দানা দানা ঠেকে। বোকা ময়রার দোকানের সীতাভোগ অতি মোলায়েম। মুখে দিলেই অল্প সময়ে মিলিয়ে গেল। মিহিদানার স্বাদও অপূর্ব লাগল। মিহিদানাতেও সবেদা লাগে। বর্ধমান শহরের পরিচয় জ্ঞাপক মিষ্টি দু’টোর স্বাদ নেওয়া হয়েছে। অনায়াসে টক্কর দিতে পারে। বোকা ময়রার দোকানে সবেদা তৈরিতে খাস চাল ব্যবহার করা হয়। খাস চাল হল গোবিন্দভোগ চালের আঞ্চলিক নাম। খাসের গোবিন্দভোগ হওয়ার পিছনে একটি প্রচলিত কাহিনি আছে। গোবিন্দপুর গ্রামের জঙ্গল পরিষ্কারের সময়ে হুগলির বসাক ও শেঠ পরিবার গোবিন্দ মন্দিরের খোঁজ পান। গঙ্গার তীরে তাঁরা সুগন্ধী খাস চালের চাষ শুরু করেছিলেন। খাস চালের ভোগ গোবিন্দকে নিবেদন করা হত বলে এটির নাম হয় গোবিন্দভোগ। এই জনশ্রুতি কলকাতা শহর পত্তনের সময়ে। (সূত্র আনন্দবাজার)।

বোকা ময়রার স্ত্রী মমতা দাসের সঙ্গে কথা বলছি আমরা।

এ বিষয়ে একটা তথ্য মনে পড়ল। প্রণব রায় তাঁর ‘বাংলার খাবার’এ লিখেছেন, বর্ধমান শহরের মিহিদানা ১৮৯৮ সাল নাগাদ পশ্চিমবঙ্গে খ্যাতি পায়। খুব সূক্ষ্ম এই দানা ‘খাস’ নামে পরিচিত ছিল। সূক্ষ্ম দানার জন্য ‘খাস’ নাকি খাস চালের সবেদায় তৈরি বলে খাস? উত্তর খুঁজতে হবে।

তিনটে মিষ্টি খাওয়াবে বলে দীপ্তেন্দু এনেছিল। কিন্তু কেন জানি না তৃতীয় প্রার্থী কালাকাঁদ ভোট পেল না। সঠিক কারণ মনে নেই। হতে পারে সীতাভোগ, মিহিদানার মোহে। নয়তো বোকা ময়রার রসভান্ডারের সমৃদ্ধি দেখে। এঁর মিষ্টির ভান্ডারের বৈচিত্র আছে।

ক্ষীরের পায়েস।

খেতে খেতে কথা বলতে বলতে দোকানের কর্মী নবকুমারের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছে। উনি পরামর্শ দিলেন রাজভোগ আর জলভরা তালশাঁস সন্দেশ খেয়ে দেখতে। রাজভোগ খেলাম। উপাদেয়। সাদা রাজভোগ। ক্ষীরের গুটি দিয়ে পাকানো রাজভোগের গোল্লা। ফলে গোল্লার ভিতরে রসাল খোঁদল। বাদামি রাজভোগটা একটু কড়া হয়। বোকা ময়রার রাজভোগ নমনীয়। নবকুমারের পরামর্শ মতো এবার জলভরা খাওয়ার কথা। জলভরার আবিষ্কারক সূর্য মোদকের দোকানে আমরা খেয়ে এসেছি। সে হুগলিতে। এবার অন্য জেলায়। কিন্তু জলভরা খেতে কেউ আগ্রহ দেখাল না। দীপ্তেন্দুর কালাকাঁদের মতোই। আসলে সকাল থেকে মোটামুটি মিষ্টির উপরেই আছি। দুপুরের খাবার কিছু জোটেনি। ইন্দ্র থাকলে এতক্ষণ গালাগাল শুরু করত। দীপ্তেন্দু শান্ত ছেলে বলে কিছু বলেনি।

আমরা শিঙাড়া নিলাম। উপর্যুপরি মিষ্টিতে স্বাদকোরকগুলোর একঘেঁয়েমি লাগছিল। ঝাল দিয়ে চার্জ করে নিলাম। বোকা ময়রার দোকানে নোনতার নানা পদও মেলে। জিভ জেগে ওঠার ফাঁকে বোকা ময়রার বিষয়ে একটু খোঁজখবর করা যাক।

ক্ষীরের পান্তুয়া।

দোকানে এক বৃদ্ধা বসেছিলেন। টুকটাক কথাও বলছিলেন আমাদের সঙ্গে। ইনি বোকা ময়রার স্ত্রী মমতা দাস। তিনি নানা তথ্য দিলেন। বোকা ময়রার প্রকৃত নাম দেবীপ্রসাদ দাস। প্রোপাইটার হিসেবে যে নাম রয়েছে। মিষ্টির কাজে হাতেখড়ি কলকাতার বিখ্যাত সেন মহাশয়ের দোকানে। সেন মহাশয়ের মালিক ছিলেন তাঁর খুড়তুতো মামা। একসময়ে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন বোকা ময়রা। মুদিখানার দোকান দেন। সেই সঙ্গে জিলিপি আর ফুলুরি ভাজতেন। দারিদ্র ছিল। ধীরে ধীরে দোকান দাঁড় করান। দোকান চালু হতে আস্তে আস্তে ছানার মিষ্টি তৈরি করতে শুরু করেন। বোকা ময়রার হাতের গুণে ছানার মিষ্টি জনপ্রিয় হয়। প্রথম দিকে জলভরা, সীতাভোগ, মিহিদানার কদর ছিল ক্রেতার কাছে। ধীরে ধীরে মিষ্টির সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। সংসারের হাল ফেরে। একসময়ে নতুন দোকান খোলেন। নাম দেন দাস মহাশয়। সেন মহাশয়ের প্রভাবেই এমন নাম। ভালবাসা বা শ্রদ্ধা থেকেই দিয়েছিলেন। যদিও জানতেন, তাঁর ব্র্যান্ড ডাকনামটাই। তাই দোকানের নামফলকে বোকা ময়রা শব্দটির উল্লেখ করতে ভোলেননি।

কাজ পাগল ছিলেন বোকা ময়রা। দোকানে কাজ করতে করতেই মারা যান। তবে তার আগে ছেলেদের মিষ্টি তৈরি ও ব্যবসায় উপযুক্ত করে দিয়ে যান। মমতা দাস বলছিলেন, ছেলেদের তাঁর স্বামী বলতেন, ভাল করে কাজ শেখ। না হলে খেতে পাবি না। বোকা ময়রা ও মমতা দাসের তিন সন্তান, রাজকুমার, সঞ্জয় এবং বাবলু। সঞ্জয় এই দোকানটা সামলান। বাবলু ঘোষপাড়ায় আরেকটি দোকান করেছেন। মিষ্টির দোকানের গল্প শোনাতে শোনাতে ছেলে সঞ্জয়কে ডেকে দেবেন বলছিলেন। আমি রাজি হইনি। তিনি তখন দোকান থেকে গিয়ে ঘুমোচ্ছেন। বিকেল কাজে বসবেন।পরিশ্রমীদের ঘুম অতি জরুরি বিষয়। তা আমাদের স্বার্থের জন্য নষ্ট হবে কেন? প্রয়োজনীয় তথ্য তো মমতা দাসের কাছেই মিলছে। নবকুমার সাহায্য করছেন। তাছাড়া ঘুম থেকে তুললে মেজাজ শরিফ থাকে না। রাবড়ি অভিযানের সেই অভিজ্ঞতাও রয়েছে।

সমৃদ্ধ শোকেস।

এখন দোকানের আধুনিকীকরণ ঘটেছে। সন্দেশ, রসগোল্লা হয় যন্ত্রে। মিষ্টির বৈচিত্রও বেড়েছে। আমরা যা খেলাম এবং আলোচনা করলাম সেগুলো ছাড়াও অনেক রকম মিষ্টি তৈরি হয়। নবকুমার ক্ষীরের পান্তুয়া চেখে দেখতে বলছিলেন। কিন্তু মিষ্টি আর নিতে পারছিল না জিভ-মন। আমরা শুধু দেখছিলাম আর শুনছিলাম। পরইচিত মিষ্টি তো রয়েছেই। রয়েছে সরপুরিয়া, কেশর মালাই, ক্ষীরের পায়েস। পায়েস বললে যে থকথকে ছবি ভেসে ওঠে ক্ষীরের পায়েস তা নয়। ক্ষীরের গোল্লা করে দুধের রসে ফোটানো।

আমরা কথা বলছি, এক বৃদ্ধ মিষ্টি কিনছিলেন। হয়তো আমাদের কথা শুনছিলেন। না হলে হঠাৎই তিনি পরামর্শ দেবেন কেন, ‘‘এঁদের দোকানের সীতাভোগ খেয়ে দেখতে পারেন।’’ বয়স্কদের মতামত গুণমানের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। কারণ তাঁরা দীর্ঘ সময়ের গুণগ্রাহী। এখনও প্রশংসা করছেন মানে গুণমান ভাল আছে। না হলে ‘আগের মতো আর নেই’ কথাগুলো বেরিয়ে পড়ত। আমরা তাঁকে জানালাম, সীতাভোগ, মিহিদানা খেয়েছি। এক বার নয় দু’বার করে। দীপু দ্বিতীয় রাউন্ডের দাবি জানিয়েছিল। ওর সঙ্গে আমরাও।

এবার ফেরার পালা। বাড়ির জন্য জলভরা নিলাম আমরা। সীতাভোগ, মিহিদানা নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমাদের ভ্রমণ তখনও শেষ হয়নি। বাড়ি ফিরতে কম করে রাত ন’টা হবে। প্রবল গরম। এতক্ষণ ব্যাগে বদ্ধ থাকলে সুগন্ধ নষ্ট হয়ে যাবে। বর্ধমানে সীতাভোগ, মিহিদানা কেনার অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। দীপ্তেন্দু অবশ্য সীতাভোগই নিল। ওর বাড়ি আমাদের তুলনায় কাছে।

দোকান থেকে বেরিয়ে আসছি, নবকুমার জানালেন, আমরা যে মিহিদানাটা খেলাম সেটা মোটা দানার। সূক্ষ্ম দানারটা এদিন হয়নি। মোটা দানা মানে কতটা মোটা সূক্ষ্মের থেকে? খেয়ে কিছু বুঝতে পারিনি। না বললে পারতামও না। একটা বিষয় বোঝা গিয়েছে, এই দানা ভাজার ঝাঁঝরির ফুটোগুলো তুলনামূলক বড়। তাই দানা একটু বড়। কিন্তু কতটা?

মিহি আর মোটার আঁক কষতে কষতে বোকা ময়রার রসভান্ডার থেকে বেরোলাম চার রসিক।

কভারের ছবি— বোকা ময়রার দোকান

ছবি— দীপু

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *