পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

সুন্দরী সিকিমের সঙ্গ-যাপন

স্মৃতিমাধুরী দাস

রিজার্ভেশন করা ছিল চার মাস আগেই। তবুও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনিশ্চিয়তা। গ্যাংটকে নয়, দার্জিলিংয়ে গন্ডগোল।

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন তাই ,”চল মন, বৃন্দাবন” করে বেরিয়ে  পড়লাম। রাতের পদাতিক  এক্সপ্রেস, শিয়ালদা স্টেশন, পরের দিন সকাল ৯-৩০ নাগাদ নিউ  জলপাইগুড়ি স্টেশন। রাতে জানালার কাচে নাক ঠেকিয়ে মায়াবী চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া গাছপালা, মাঠ, বাড়িঘর, স্টেশনের পিছনে সরে যাওয়া দেখতেও ভারি ভাল লাগছিল। নামলাম যখন, কটকটে রোদ চারদিকে। খালি চোখে তাকানো মুশকিল! ব্যাগ থেকে অতএব…রোদচশমা।

উচ্ছ্বল তিস্তা।

আমাদের প্রথম গন্তব্য গ্যাংটক। শেয়ার গাড়িতে সিট বুক হল। কিন্তু ড্রাইভারদাদা তো সাতজনের গাড়িতে দশজনকে না তুলে নড়বেন না। (এখন থেকে গোটা ভ্রমনপথে এটাই দস্তুর!)। অতএব ঘামতে ঘামতে, বিরক্ত হতে হতে অপেক্ষা করা ছাড়া আর একটা কাজ করা গেল। সেটাও দস্তুর এখন— সেলফি, গ্রুফি। ঘণ্টাদেড়েক কেটে গেছে এর মধ্যে। অবশেষে তিনি চললেন।

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে শালুগাড়া। সেখান থেকে ১০ নং জাতীয় সড়ক। পাড়ি দিতে হবে ১২০ কিমি। অথচ নড়তেচড়তে পারছি না। ছবি তুলব কী করে!

ডুয়ার্সের জঙ্গল ততক্ষণে ছায়া ঢাকা রাস্তা দিয়েছে। মন তো তার দিকে যাবেই। সেবক রোড ধরে গাড়ি ছুটছে তিস্তাকে ডানে রেখে। রাস্তায় কোথাও কোথাও ধসের চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। গাড়ির গতি কমছে স্বাভাবিকভাবে।

টানেল ধরে।

কিন্তু, ওই যে “আমরা চলি সমুখপানে, কে আমাদের বাঁধবে “-জীবনের  ধর্ম মেনেই  বিপর্যয়কে পিছনে ঠেলে ছন্দে ফেরা। ধস পেরিয়ে তিস্তার বিভঙ্গ আর পাহাড়ি রাস্তার  রূপ দেখতে দেখতে যাত্রা চলল। সেবক হয়ে ছুটছে মানুষ ঠাসা সুমো। দূরে দেখা দিল করোনেশন ব্রিজ। সেতুর আর্চটি নয়নলোভন। কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ হয়নি। দেখছি, তিস্তা কখনও কাছে কখনও দূরে। পেরিয়ে এসেছি কালিঝোরা, লোহাপুল, সুনতালে। বেলা গড়িয়েছে দুপুরের শেষদিকে। গাড়ি থামল। ড্রাইভারদাদার চেনা হোটেল। যাতায়াতের পথে এখানেই বোধহয় খাওয়াদাওয়া করেন। হোটেলের নামটা কোথাও দেখতে পেলাম না। তা হোক, নেমে পা-কোমরও তো ছাড়াতে হবে! আমার  পুত্রটি ভাত-ডাল-আলুর কোনও একটি পদ পেলেই খুশি। তার খাবার এল। আমরা নিলাম চা আর সেঁকা পাঁপড়। তিস্তা এখানে অনেক কাছে, রাস্তার একেবারে গা ঘেঁসে। জলের রং হাল্কা সবজেটে।

করোনেশন ব্রিজের বদলি।

বিরতির পর গাড়ি ছুটল তিস্তা ব্রিজ হয়ে চিত্রের দিকে। চলেছি ১০ নং জাতীয় সড়ক ধরেই, তবে রংপো ঢোকার পরে তার নাম গ্যাংটক-রংপো রোড। তিস্তা চলে এসেছে  বাঁদিকে। আমূল বদলেছে তার রূপ। সেবক রোডে তাকে দেখেছিলাম ধীর, শান্ত। এখানে সে উচ্ছ্বল, প্রাণচঞ্চল নৃত্যপটিয়সী কন্যে। মাজিটার, সিংতাম, রাণীপুল, তাডং  হয়ে গ্যাংটকের কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি শম্বুকগতি। স্কুলছুটির সময় তখন। কচিকাঁচা আর অপেক্ষাকৃত বড়রাও বাড়ির পথে। গ্যাংটক ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডে পৌঁছতে প্রায় বিকেল চারটে।

ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলের খোঁজ। ট্যাক্সিচালককে আমাদের চাহিদা জানিয়েছিলাম । উনি যেখানে নিয়ে গেলেন এক দেখাতেই ঠিকঠাক। চালক দীনেশভাই তার আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখিয়েছেন। কেমন একঝলক রৌপ্যমুকুটের ঔজ্জ্বল্যে আমাদের স্বাগত জানাল। যে কটাদিন গ্যাংটকে ছিলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘা মুখ লুকিয়েছিল মেঘের আড়ালে।

দেখা হল।

মখমলি সবুজ আচ্ছাদনে নিজেদের ঢেকে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে পর্বতশ্রেণী। খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়েছিলাম তার দিকে, অপলক। কর্তা তখন ফ্রেশ হচ্ছেন, ছেলে টিভির সামনে। নিসর্গের থেকে টিভিই এখন ওকে বেশি টানে। যদিও বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহ আঠারো আনা।…

ম্যালের পোশাকি নাম এম জি মার্গ। রাস্তায় ছোট গাড়ির লাইন, দু’ধারে একতলা দোতলা বাড়িতে হরেক কিসিমের দোকান, রেস্তোঁরা, শপিংমল, ক্যাসিনো। একধারে দোকানের পরে লম্বা দূরত্ব নিয়ে হাঁটা এবং বসার সুদৃশ্য জায়গা। অক্টোবরের সন্ধ্যায় জমজমাট ম্যাল। লক্ষণীয়, এখানকার বেশিরভাগ দোকানের কর্ণধার মহিলা। তা সে পোশাকের দোকানই হোক, কী মনিহারি অথবা খাবারের দোকান। একটা ফাস্টফুডের দোকানে ফুচকাও বিক্রি হচ্ছে! দাঁড়িয়ে পড়লাম লাইনে। হাতে এল শালপাতার বদলে প্লাস্টিকের বাটি। ফুচকা পাহাড়ে, সমতলে যেকোনও জায়গাতেই স্বাদু। তাই আলুর মশলায় পেঁয়াজকুচির উপস্থিতিও বেশ লাগল। ফুচকা পর্বের পরে মন্দগতিতে হাঁটা। অনেক ভিড়ের মধ্যে আমরা ক’জন।

তাশি ভিউ পয়েন্ট।

কিছুক্ষণ ম্যালে ঘোরাঘুরি, ছবি তোলা, মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো বেঞ্চ দখল করে আড্ডা দিয়ে ফিরলাম হোটেলে।

পরের দিন সকাল ৯টা নাগাদ বেরোলাম। দীনেশভাইকেই বলা ছিল। প্রথমেই গেলাম ফ্লাওয়ার এক্সিবিশনে। খানিকটা গ্রিন হাউসের আদলে ঢাকা জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ, ক্যাকটাস, ইনকা, পমপম, পিটুনিয়া ইত্যাদি চেনা নাম ছাড়াও অনেক অচেনা ফুল, এখানে। রয়েছে একটি কৃত্রিম ছোট্ট জলাশয় এবং একটি ছোট্ট সাঁকো।

ওখান থেকে বেরিয়ে যে জায়গায় পৌঁছলাম সেখানে গণেশজীর মন্দির আছে। গণেশ তক, জায়গাটার নাম। এই মন্দিরটিকে ওয়াচটাওয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এখান গ্যাংটক শহরটার বেশ পরিচ্ছন্ন প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায়। মন্দির দর্শনের পরে  স্থানীয় পোশাকে ফোটোসেশন পর্ব। ততক্ষণে খিদেও পেয়ে গেছে। সামনেই একটা খাবারের দোকানে গরম আলুপরোটা আচার, সবজি সহযোগে খাওয়া হল। সঙ্গে কফি  এবং জানালা দিয়ে পাহাড় দর্শন।

পরের গন্তব্য প্ল্যান্ট কনসার্ভেটরি। চোখ পড়ল রডোডেনড্রনে। এযাবৎ শুধু নাম শুনেছিলাম, এখন দেখলাম। তবে ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ’ দেখার সাধ পূরণ হল না। কেন না, এখন ফুলের সময় নয়। কনসার্ভেটরিতে সিকিমের স্বাভাবিক উদ্ভিদের অধিকাংশ রয়েছে।

প্রদর্শনীতে।

কনজার্ভেটরির ভিতরে একেবারে উপরের প্রান্তের দিকে রয়েছে একটি প্রাকৃতিক জলধারা। ছোট্ট, কিন্তু তাকেই বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। গাছপালার পরিচর্যায় এ জল কাজে লাগানো হয়।

বেরিয়ে আবার গাড়িতে। পথের পাশে পাহাড়ি ঝোরা। বেশ গতিতে লাফাচ্ছে অনেকগুলো ধাপে ধাপে। একটু স্পর্শ করে এলাম।…

তাশি ভিউ পয়েন্ট থেকে গ্যাংটক শহরটা আর কাঞ্চনজঙ্ঘা দুই-ই দেখা যায়।তবে মেঘপিয়নের বদান্যতায় ও রসে বঞ্চিত হয়ে খালি চোখেই ফিরতে হল। একেবারেই খালি চোখ নয়। এই যে মেঘের সান্নিধ্য পাওয়া, গোটা সফরে উপভোগ করেছি। আর কোথায় সে একেবারে আপাদমস্তক আমাদের লুকিয়ে ফেলেছিল তার মধ্যে, সেকথা ক্রমশঃ প্রকাশ্য।

গোনজাং মনাস্ট্রি।

সিকিম প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজ্য। তাই এখানে মনাস্ট্রির প্রাচুর্য। গোনজাং মনাস্ট্রির প্রবেশপথে সুদৃশ্য তোরণ। ঢালপথে হেঁটে বেশ খানিকটা নেমে তবে মূল মনাস্ট্রি। মেঘ হারিয়ে ততক্ষণে রোদ এসে পড়েছে। অপূর্ব কারুকাজের মনাস্ট্রি। প্রাঙ্গনটিও বিরাট। দু’জন করে লামা শিক্ষার্থী তখন বিরাট বিরাট কার্পেট রোদ্দুরে মেলতে, ঝেড়ে গুছিয়ে তুলতে ব্যাস্ত। আমার কর্তা উঠে গেলেন মনাস্ট্রির ভিতরে। আমি আর ছেলে বিরাট প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে পাহাড়ি সৌন্দর্যের দিকে হাঁ করে রইলাম।

‘মগ্ন হয়ে রইব কোথায়?

সময় ডাকে ঘড়ির কাঁটায়।’

সিকিম হ্যান্ডলুম ও হ্যান্ডিক্রাফটসের দিকে যেতে যেতে রাস্তায় পড়ে বাকথাং ফলস্। মনোলোভা তিনি আনন্দে ঝাঁপ দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন পুষ্পরেণু জলকণা। এঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে পৌঁছলাম হ্যান্ডলুম ও হ্যান্ডিক্রাফটে।

আমার দু’জন।

সেখানে তখন দ্বিপ্রাহরিক বিরতি চলছে। অগত্যা অপেক্ষা। এই ফাঁকে চিড়িয়াখানায় যাওয়া নিয়ে দর কষাকষি হয়ে গেল দীনেশভাইয়ের সঙ্গে।

কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে ঢুকলাম হ্যান্ডিক্রাফটের ভবনে। প্রথমেই সংগ্রহশালা। প্রধানত বুদ্ধদেবের বিভিন্ন ছবি, মূর্তি, পুরনো সিকিমের অস্ত্রশস্ত্র, বাসনপত্র, পোশাক, ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হয়েছে। সংগ্রহশালার ভিতরে কথা বলা মানা। জানা গেল, এখানে রাখা বুদ্ধদেবের কোনও কোনও ছবিতে ভেষজ রং এবং সোনার গুঁড়ো ব্যবহৃত হয়েছে। ছবিগুলো শতাব্দীপ্রাচীন। অন্যদিকে একটি ঘরে চলছে আঁকার ক্লাস। অন্য আর  একটি ঘরে মেয়েরা বিভিন্ন হাতের কাজ করছে। বাঁশের খোল দিয়ে পেনদানি, ফুলদানি তৈরি, কাগজের মণ্ডের মুখোশ, কাপড়ের ফুল, ব্যাগ ইত্যাদি। চলছে হস্তচালিত তাঁতও। তাৎপর্যপূর্ণভাবে কর্মচারীদের অধিকাংশই মহিলা।

জুওলজিক্যাল পার্কের জু।

আজকের শেষ গন্তব্য, হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক। এই জু-গার্ডেনের বিশেষত্ব হচ্ছে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবজন্তুদের রাখা। তবে বেশি জীবজন্তু এখন নেই। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বাসস্থানে এরা যথেচ্ছ ঘোরাঘুরি করে। কাজেই দর্শন পেতে  গেলে ধৈর্য রাখতে হয়। ক্যামেরাবন্দি করা আরও দুরুহ। দেখা পেলাম নীলগাই, চিতা, লাল পাণ্ডা, ঘরাল, ক্লাউডেড লেপার্ড, লেপার্ড ক্যাট, সজারুর। পাখিরালয়ে ছুটোছুটি ওড়াউড়ি করে বেড়াচ্ছে লেডি আমহার্স্ট ফেজেণ্ট, গোল্ডেন ফেজেন্ট, ময়ূর। পশুপাখিরা প্রত্যেকে রয়েছে বিভিন্ন পাহাড়ি উচ্চতার বাসস্থানে। সবথেকে উঁচু জায়গায় থাকার কথা স্নো লেপার্ডের। এখন তার জায়গা শূন্য। এখানেই রয়েছে ওয়াচটাওয়ার। সেটিও এখন তালাবন্ধ।

জু-গার্ডেনের রেস্টুরেন্টে মোমো, অমলেট আর ভেজ ফ্রায়েড রাইস দিয়ে বৈকালিক ভোজন সারলাম সপরিবারে।

এবার হোটেলে ফেরার পালা।

প্রচ্ছদের ছবি- কাঞ্চনজঙ্ঘা।

ছবি-লেখিকা

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *