পলাশি, ডেবরা। পশ্চিম মেদিনীপুর।
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ভারতের ক্ষুদ্রতম লুচির রহস্য সন্ধানে

দীপক দাস

হাতিপায়া লুচি। মালদহের সদুল্লাপুরে পাওয়া যায়। আকারটা বড়সড়। হাতির পায়ের মতো। তাই এমন নাম।

উত্তর কলকাতায় এক ধরনের লুচি হত। এ লুচি জামাই স্পেশাল। জামাই লুচি ছিঁড়ে খাচ্ছে, রাজধানীর অভিজাতগর্বী উত্তরাঞ্চলের শাশুড়িদের চোখে এমন দৃশ্য নাকি নান্দনিক নয়। তাই তাঁরা এমন মাপের লুচি তৈরি করতেন যা ছোলার ডাল, বাটি চচ্চড়ির সঙ্গে এক গালে পুরে দেওয়া যেত। সাধারণ বাড়িতে যে আকারের লুচি হয় তার থেকে কিছুটা ছোটমাপের ছিল জামাই স্পেশাল।

তা বলে ‘সেকালের গোল ডবল পয়সা’র আকারের লুচি? এমন লুচির সন্ধান দিয়েছেন প্রণব রায়। তাঁর ‘বাংলার খাবার’ বইয়ে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার রাধামোহনপুর স্টেশনের কাছে পলাশি গ্রাম। এই গ্রামের নন্দীদের ঠাকুরবাড়িতে এমন লুচি হয় বলে জানিয়েছিলেন তিনি। লুচির মাপ নিয়ে প্রণব রায় একটি হিসেব দিয়েছেন। ‘সাধারণত পল্লীগ্রামে চলতি লুচির ব্যাস ছয় ইঞ্চি থেকে আট ইঞ্চি, আর উক্ত পলাশী গ্রামের নন্দীবাবুদের ঠাকুরবাড়ির লুচির ব্যাস এক থেকে দেড় ইঞ্চি’। প্রণববাবুর সিদ্ধান্ত, ‘সম্ভবত এটিই ভারতের ক্ষুদ্রতম লুচি’। তাঁর তথ্য অনুযায়ী, তিনি যে সময়ে বইটি লিখছেন তখনও নন্দীবাড়িতে এমন ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র লুচি হত। অতিথিরা প্রসাদও পেতেন এমন লুচির। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৮৭ সাল। এই সময়েও তৈরি হত মানে কি এটাই নন্দীদের ঠাকুরবাড়ির রীতি? আশা জাগে, তা হলে হয়তো এখনও হয়। মালদহ বাসের সময় হাতিপায়া লুচি খেতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাত্রা হয়নি। উত্তর কলকাতার জামাই স্পেশাল খাওয়ার প্রশ্ন ও সম্ভাবনা, উভয়ই নেই। একমাত্র নন্দীবাড়িতে স্পেশাল লুচির স্বাদ নেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে কেন এমন ছোট লুচি তৈরি শুরু তার কারণও জানা যাবে।

নন্দীদের ঠাকুরবাড়ি। লক্ষ্মীজনার্দনের মন্দির।

অতএব লুচি অভিযান। যেতে হল একাই। দলের কারও সময় নেই। মেদিনীপুর জেলা ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে জায়গাটা এখন পশ্চিম মেদিনীপুরের অধীন। ডেবরা ব্লক। খড়্গপুর শাখার ট্রেনে চেপে বসলাম। রাধামোহনপুর স্টেশন থেকে টোটো নিয়ে পলাশি। বড় রাস্তা থেকে হেঁটে অল্প ভিতরে ঢুকলেই নন্দীবাড়ি। লম্বাটে সাদা রঙের বাড়ি। গেটের কাছে গিয়ে আমার সরু গলা যতটা সম্ভব মোটা করে হাঁক পাড়া গেল। এবং আমাকে হাঁকিয়ে দেওয়া হল। ভিতর থেকে যে পুরুষ কণ্ঠটি কথোপকথন চালাচ্ছিলেন তাঁকে আগমনের উদ্দেশ্য জানাতে হয়েছিল। প্রথমে লুচির কথা পাড়িনি। প্রায় দুপুর বেলায় কোনও গৃহস্থের দরজায় দাঁড়িয়ে ছোট লুচি দেখতে এসেছি বলা যায়! ভাবতে পারেন, খেতেই এসেছি। বলেছিলাম, ঠাকুরবাড়ির বিষয়ে জানব। ভিতর থেকে উত্তর এসেছিল, ‘‘যিনি বলতে পারবেন তিনি কলকাতায়। পরে আসুন।’’ পরে আসা মুশকিলের। এই সফরও অনেকদিনের চেষ্টার ফল। যদি কোনও ফোন নম্বর পাওয়া যায়? নিরুত্তর তিনি।

প্রসাদে লুচি। সেদিন আমাকে যা দেওয়া হয়েছিল। আকার সাধারণ লুচির মতোই।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরেই আসছিলাম। ফেরার রাস্তায় এক প্রৌঢ়কে দেখে থামি। নন্দীবাড়ির কারও ফোন নম্বর পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি নম্বর দিতে পারেননি। তবে রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যাওয়া এক ছেলেকে ডেকে দাঁড় করিয়েছিলেন। আমার আসার উদ্দেশ্য জানাতে ছেলেটা নিয়ে গেলেন একটি বাড়িতে। নন্দীদের সাদা বাড়িটার সামনেই সেটি। এঁরাও নন্দী পরিবারের। সাহায্যকারী ছেলেটিও নন্দীদের। তাঁর ডাকাডাকিতে বেরিয়ে এলেন আরেক কম বয়সি ছেলে। তাঁর নাম সুপ্রভাত নন্দী। সুপ্রভাত বেরোতে সাহায্যকারী ছেলেটি চলে গেল। ছেলেটির নাম শীর্ষেন্দু নন্দী। পরে জেনেছিলাম।

কাছারিবাড়ি। এর ভিতরে রয়েছে ঠাকুরবাড়ি।

সুপ্রভাতকে সরাসরি আসার উদ্দেশ্য বললাম। ঠাকুরবাড়ি নয়, ঠাকুরবাড়ির ছোট লুচিই আমার আগ্রহের কারণ। আমরা কথা বলছি ঘরের ভিতর থেকে এক মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল। তিনি সাদর আমন্ত্রণ জানালেন, ‘‘ঘরে আসুন, প্রসাদ খেয়ে দেখুন।’’ ঘরে গেলাম। ঘেরা দাওয়ায় বসার চেয়ার দিলেন সুপ্রভাত। তাঁর মা একটি প্লেটে এনে দিলেন প্রসাদ। প্লেটে ছিল দু’টো লুচি। শিম, বেগুন আর আলু ভাজা। শসার টুকরো আর ছানা। লুচির আকার সাধারণ। আমরা যা খাই সেরকম। খেলাম প্রসাদ। যেহেতু দেবতার ভোগ তাই লুচিতে নুন নেই। সৈন্ধব লবণ ব্যবহার করা হয়েছে, জানালেন বাড়ির লোক।

কথা বলতে বলতে এসে হাজির সুপ্রভাতের জেঠু প্রদীপবাবু। ক্ষুদ্রতম লুচির খোঁজে এসেছি শুনে তিনি বললেন, ‘‘এখনও প্রতি বছর বিভিন্ন পত্রিকায় এই ছোট লুচির কথা লেখা হয়। কেউ এসে দেখে খোঁজ করে লেখেননি। কোনও একটা বই থেকে লেখেন।’’ আমি বইয়ের ও লেখকের নাম বলতে উনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রণব রায়।’’ কিন্তু ‘ভারতের ক্ষুদ্রতম লুচি’র কথাটা ছড়াল কী ভাবে? সে কথা জানার আগে নন্দীদের বিষয়ে একটু জানা যাক। নন্দীরা পলাশির আদি বাসিন্দা নন। এঁরা পশ্চিম মেদিনীপুরেরই কেশপুরের আনন্দপুর থেকে এই গ্রামে আসেন কোনও এক সময়ে। ব্রিটিশ আমলে নুনের ব্যবসা করে অর্থবান হন গোলোকমোহন নন্দী। ধীরে ধীরে সম্পত্তি কিনে গ্রামের জমিদার হয়ে ওঠেন। তৈরি করেন বিশাল বসতবাটি। তৈরি করেন রাসমঞ্চ। তৈরি হয় কাছারি বাড়ি। কাছাড়ি বাড়ির কাছেই তৈরি হয় লক্ষ্মী জনার্দনের মন্দির। সেই মন্দিরের প্রবেশপথের কিছু উপরে লেখা সন ১২৩১। এই সনের হিসেবে মন্দিরের বয়স ১৯৮ বছর। নন্দীদের এই গ্রামে আগমন নিশ্চয় তারও আগে।

রাসমঞ্চ।

লক্ষ্মীজনার্দনের মন্দিরই ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত। এঁদের ভোগে তিন বেলা নানা পদ উৎসর্গ করা হত। জমিদারির রমরমার সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই পদের বাহুল্য ছিল। গ্রামের লোক মন্দিরে এলে প্রসাদ পেতেন। এখন বাহুল্য কমেছে। তবে তিন বেলা ভোগ এখনও দেওয়া হয়। সকালে বাল্যভোগে দেওয়া হয় কলা। দুপুরে নিত্যসেবায় দেওয়া হয় লুচি, তিন রকম ফল, তিন রকম ভাজা, ছানা, আখের গুড়। রাস, দোল, ঝুলন, জন্মাষ্টমীতে পদ বাড়ে। আগে রাতে লুচি, ক্ষীর দেওয়া হত। প্রদীপবাবুরা জানালেন, লক্ষ্মী জনার্দনের সেবার পুরোটাই ব্রাহ্মণদের দায়িত্ব। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা এত কিছু করতে চান না। তাই এখন রাতে তিন রকম ফল, ক্ষীর আর বাতাসা থাকে।

কথা বলার সময়ে হাজির হয়েছিলেন সাদা বাড়ির এক গৃহবধূ আর এক তরুণী। এঁরা নন্দীবাড়ির সদস্য শুভেন্দু নন্দীর স্ত্রী কাকলি এবং কন্যা কথা। ছিলেন আরেক ব্যক্তি। তিনি সুপ্রভাতের বাবা সপ্তদীপ নন্দী। সকলেই একই পরিবারের। সকলের সঙ্গেই কথা হল। তাঁরা জানালেন, লক্ষ্মীজনার্দনের সেবায় একসময় দু’বেলাই লুচি দেওয়া হত। কোনও সময়ে কি এই লুচিই ছোট ছোট তৈরি হয়েছিল? আমি বইয়ের অংশটাও প্রদীপবাবুদের দেখিয়েছিলাম। ওঁরা জানালেন, কোনও সময়েই এত ছোট লুচি তৈরি হত না। বইয়ে দেওয়া মাপ ধরলে তো লুচি ফুচকার থেকেও ছোট। এরকম লুচি কেন তৈরি হবে? তৈরি করাও তো ঝামেলা। তা হলে কেন ছড়াল ‘ভারতের ক্ষুদ্রতম লুচি’র কথা? বলতে পারলেন না প্রদীপবাবুরা। সুপ্রভাতের মা একটা কথা বলেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আপনি তো আমাদের খবর না দিয়ে হঠাৎ এসেছেন। আপনি তো দেখলেন লুচি কেমন হয়?’’

এটি ছিল নহবতখানা।

যুক্তিগ্রাহ্য কথা। কিন্তু তথ্য যে প্রণব রায়ের বইয়ের। তাঁর বইয়ের তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বের কথা বুঝেছিলাম ২০০৫-০৬ সালে। তখন ফ্রিল্যান্স লেখালেখি চলে। এক সংবাদপত্রের অতিথি কলামের দায়িত্বে ছিলেন গল্পকার এবং এক সময়ের ‘আনন্দমেলা’র সম্পাদক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাছে হাওড়া জেলার মাজুর খইচুর নিয়ে লেখা জমা দিয়েছিলাম। দেবাশিসবাবু বলেছিলেন, ‘‘খইচুর কি প্রণব রায়ের বইয়ে আছে?’’ চুপ থাকতে হয়েছিল। কারণ বই এবং লেখক কারও নামই তখন শুনিনি। তবে নামটা মনে থেকে গিয়েছিল। পরে প্রণব রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তখন ক্ষুদ্রতম লুচির কথা জানতাম না। এখন তিনি প্রয়াত। ফলে বিষয়টি যাচাইয়ের সুযোগ নেই।

কিন্তু এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বইয়ে ‘ক্ষুদ্রতম লুচি’ তথ্যের উৎস কী? উত্তর মিলল রাস্তায় বেরিয়ে। ঠিক উত্তর নয়, একটা আন্দাজ। রাস্তায় দেখা হয়েছিল এক প্রবীণের সঙ্গে। নতুন মুখ দেখে জানতে চাইছিলেন কোথায় এসেছি? বললাম। তিনি বললেন, এরকম ছোট লুচি কখনওই নন্দীদের ঠাকুরবাড়িতে হত না। তিনি একটা ঘটনার কথা বললেন। লুচি কি সবদিন সমান আকারে হয়? একদিন একটু ছোট হয়েছিল। পাড়ার যাদের জমিদার বাড়ির উপরে রাগ ছিল তারা লিফলেট ছাপিয়ে প্রচার করেছিল, নন্দীদের ঠাকুরবাড়ির লুচির আকার এখন তামার পয়সার মতো। সেটাই ছড়িয়ে যায়। তখন নন্দীদের অবস্থা একটু পড়তির দিকে।

ঠাকুরবাড়ির ভোগে লুচি। এর আকার সাধারণ লুচির মতোই। এই ছবি পরে নন্দীবাড়ি থেকে পাঠানো হয়।

ক্ষুদ্রতম লুচির রহস্য যেন কিছুটা পরিষ্কার হল। জমিদার ও প্রজাদের চিরন্তন টানাপড়েনে জন্ম ‘ভারতের ক্ষুদ্রতম লুচি’র। বাস্তবে যার কোনও অস্বিস্ত নেই।

কভারের ছবি— প্রসাদের লুচি ও অন্য পদ

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *