প্রকৃতি। কহালগাঁও।
অন্য সফর পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

স্টেশন পেরিয়ে পাহাড়তলির বাঁকে

সৌগত পাল

রোজের চলার পথে স্টেশন পার হতে হয় কত। ট্রেন থামলে স্টেশনের নাম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মনে হয়েছিল, কত অদ্ভুত অদ্ভুত স্টেশনের নাম আছে রেল মানচিত্রে। আমার চলার পথে কিছু নমুনা পেয়েছিলাম। যেমন ধমধমিয়া বা তালঝাড়ি। এরকম সারা ভারতের রেল মানচিত্রে কত অজানা স্টেশন ছড়িয়ে আছে। নদীর নামে স্টেশন যেমন আছে তেমনই পুকুর, গ্রামকে জড়িয়ে স্টেশনের নাম নেহাত কম নয়।

কোটালপুকুর নামে স্টেশনের আশেপাশে পুকুর নেই। তবে একটা ডোবা আর পুরনো একটা জমিদার বাড়ি আছে। ছোট বাজার আছে। একটা দোকানে দারুণ মুড়িমাখা পাওয়া যায়। আর অনেকদিন আগে এক বিকেলে স্টেশনের পিছনে সাপ্তাহিক হাটে গিয়েছিলাম। টাটকা আনাজ আর শিঙাড়া, জিলিপি। এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

পাহাড়তলির বাঁকে সড়ক।

পরে ঝাড়খণ্ডের কয়েকটা ছোট স্টেশনের হাট দেখেছি। বৈশিষ্ট কম বেশি এক। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া মুর্শিদাবাদের তিলডাঙ্গা স্টেশন যেমন। ফরাক্কা থার্মাল পাওয়ার আর বিড়লা সিমেন্ট কারখানার মালপত্র মালগাড়িতে নিয়ে গেলে এই স্টেশনে যেতে হয়। আর স্টেশনের রেস্ট রুমে থাকতে হয়। এই স্টেশনকে মজা করে ডাকতাম ডিমডাঙ্গা বলে। কারণ খাবার মধ্যে শুধুই ডিম। আনাজ পাওয়া যেত না। তাই ডিম আর বুলেটের তরকারি! না গোলাগুলি না। বুলেট মানে সয়াবিন। লোকাল সয়াবিন যেটা রান্না করলেও শক্ত হয়ে থাকত। তাই এ রকম নাম। তবে যেদিন হাট বসত সেদিন বিকেলে আনাজপাতি কিনে রান্না করতাম। ধূলিয়ান থেকে টাটকা আনাজপাতি এখানে হাটে আসে। এখানে মিষ্টির দোকানে দই ছিল অপূর্ব। চিঁড়ে আর দই তাতে রসগোল্লার রস মাখিয়ে সকালের টিফিন।

তিন পাহাড়
বৃষ্টি ভেজা দিনে।

তিলডাঙ্গায় আর একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। ছানা বিক্রি হয়। ছানার জল ঝরিয়ে ওই সাদা কাপড়ে নিয়ে এসে ওজন করে বিক্রি হচ্ছে। ও হ্যাঁ এখানেই প্রথম খেয়েছিলাম লম্বু। আকার আর নামের তারতম্য দেখে অবাক হয়েছিলাম। চৌকো দেখতে কোনও বিস্কুটের নাম যে লম্বু হতে পারে এখানে প্রথম জেনেছিলাম। পরে রামপুরহাট বর্ধমানে একই নামে আর একটি জিনিস খেয়েছি। গোলাকার বালুসাই আকারের বিস্কুট। ভিতরে মিষ্টি পুর দেওয়া। চায়ের সঙ্গে বেশ লাগে।

পলাশের দিনে।

বারহারোয়া স্টেশন পেরিয়ে একটু আগে গেলে পড়বে তিন পাহাড় স্টেশন। তিন বানরের মতো পাশাপাশি তিনটি পাহাড়ের অবস্থানের কারণেই এই নাম। এখানে জমজমাট দোকান বাজার। এই লাইনের সব স্টেশনের সঙ্গে পাথর খাদান সংযুক্ত। তিন পাহাড় থেকেই রাজমহল যাওয়ার ট্রেন পাওয়া যায়। স্টেশন থেকে গাড়িও পাওয়া যায়। ইচ্ছা থাকলেও রাজমহল আজও যাওয়া হয়ে উঠেনি।

পেকেছে ধান।

তিন পাহাড়ের পর স্টেশনের নামে পাহাড় না থাকলেও স্টেশনের আশেপাশে পাহাড়ের ছড়াছড়ি। সেই পাহাড়ের কোলে বিন্দুর মতো ঘরবাড়িগুলো দেখা যায়। চলন্ত গাড়ি থেকে দেখা যায় মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে মানুষ চলেছে বাড়ির পথে। মহারাজপুর বা করণপুরাতো স্টেশনের পাশে। হাট বারে হাট বসে। হাটে শাকসবজি জিলিপি পাঁপড়ের সঙ্গে আসর বসে সুরার। ঝাড়খণ্ড বা মানভূম প্রদেশে এটাই বোধহয় দস্তর। এর আগে দুমকা থেকে ফেরার সফরে অজগরপাড়ায় এইরকম হাট দেখেছিলাম। ছোট ছোট হাঁড়িতে হাঁড়িয়া নিয়ে খোলা আকাশের নীচে বসে পসরা।

যেতে আসতে তিন পাহাড়।

মহারাজপুর স্টেশনের পরের স্টেশন হলো সকরিগলি। ছিমছাম ছোটো বাজার বসতে দেখেছি। কোনওদিন ঘুরে দেখা হয়নি।

এর পরের স্টেশন সাহেবগঞ্জ। গঙ্গা তীরবর্তী ঝাড়খণ্ডের উল্লেখযোগ্য শহর। বর্তমানে উত্তরবঙ্গ যেতে প্রচুর ট্রেন। আর অনেক কম সময়ে পৌঁছনো যায়। কিন্তু স্বাধীনতার আগে উত্তরবঙ্গ যেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। কলকাতা থেকে ট্রেনে সাহেবগঞ্জ। সকরীঘাট থেকে নৌকা করে মণিহারি ঘাট, যেটা কাটিহারে। সেখান থেকে শিলিগুড়ি। কারণ তখন গঙ্গার উপর সেতু তৈরি হয়নি। পরে ফরাক্কা ব্যারেজ তৈরি হয়। তার পরও ছিল ন্যারো গেজ আর মিটার গেজের সমস্যা। সেই সব বাধা পেরিয়ে আজ বন্দে ভারত ছুটছে হাওড়া থেকে জলপাইগুড়ি।

টিংলিং টিংলিং করে চলেছে মালগাড়ি। দূরে শৈলমালা।

সাহেবগঞ্জের পর ভাগলপুর যেতে গঙ্গা নদী সমান্তরালে চলতে থাকে। বিক্রমশিলা স্টেশনের কাছে আছে শুশুক সংরক্ষণ কেন্দ্র। এর পর কহালগাঁও স্টেশনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। এখানকার আম গোটা বিহারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

কত জায়গা দেখা বাকি, ঘোরা বাকি। যত দিন যায় বকেয়া বেড়ে চলে জীবনের খাতায়। পাতা শেষ হয়ে আসে।

কভারের ছবি— কহালগাঁও স্টেশনের কাছে দেখা যায় এমন দৃশ্য।

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *