অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ঘরে ফেরার স্টেশন

সৌগত পাল

গালাগাল আর কত খাওয়া যায়। তাই পেন থুড়ি কি বোর্ডে টাইপ করতেই হল।

ক্যাপ্টেনের আবদার। তা-ও আবার গালাগাল দিয়ে। ক্যাপ্টেনের মতে, কোনও জায়গা একবার গেলে সম্পূর্ণ দেখা হয় না। অন্ততপক্ষে দু’বার যেতে হয়। আর দুই ভিন্ন ঋতুতে। যেমন আমরা মুরগুমা গেলাম পুজোর ছুটিতে। সেটাই একবার শীত বা বসন্তে ঘুরে আসা দরকার। ক্যাপ্টেন দু’টো আলাদা দল নিয়ে দু’বার ভালকি মাচান ঘুরেছেন। একটায় আমিও ছিলাম। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়, এই আপ্তবাক্য আমাদের জন্য খাটে না। এটা পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। সবার ছুটি একসঙ্গে হয় না। আর এখন তো ঘরের বাইরে পা দেওয়াই নিষেধ। তা-ও ফাঁকতালে ক্যাপ্টেনের আদেশ শিরোধার্য করে এক জায়গায় দু’বার ঘুরে নিয়েছি। মলুটি সদলবলে এসেছিলাম অনেকদিন আগে এক পুজোয়। এবার গেলাম শীতকালে। অন্যদল। অন্য সফর। এখন তো বলতে গেলে মলুটি ঘরের কাছে। রামপুরহাট থেকে কাছেই। সে লেখা আগেই হয়েছে। আমি তো এখন রামপুরহাটেই তাঁবু ফেলেছি।

গার্ডবাবুর কামরা থেকে।

আমার মলুটি তৎপরতা দেখে ক্যাপ্টেন উত্তেজিত হয়ে নতুন আবদার করে বসেছেন। একবার দু’বার নয়, বারবার যে সব স্টেশনের উপর দিয়ে যাওয়া আসা করি সেইসব স্টেশনের কথা লিখতে হবে। তো আমিও হাজির জবাব, ঝট করে বলে দিলাম কোন স্টেশনের কটা লাইন আর কটা সিগন্যাল আছে। এ আর এমন কী শক্ত কাজ! সিগন্যাল দেখেই তো রোজ এগোচ্ছি। জবাব শুনে ‘ক্যাপ্টেন কুল’ থেকে ক্যাপ্টেন হ্যাডক হতে গিয়ে সামলে নিল। তার পর বলল, ‘‘আড্ডা দিতে বসলে তো সব গল্পের মধ্যে ট্রেন নিয়ে চলে আসিস। সেই গল্পই লিখতে অসুবিধা কোথায়?’’ ঘন দাড়ি-গোঁফ আর রাতজাগা গোল্লা গোল্লা চোখের রক্ত জল করা চাহনি দেখে আর বলতে সাহস হল না যে, তোমরা যেগুলো জোর করে সহ্য করে নাও তা বাকিরা সহ্য করবেন কেন? মাথা নেড়ে ‘ঠিক আছে’ বলে দিলাম।…

চলন্ত কামরায় একাকী মন এমন রূপবতীদেরই সঙ্গ পায়।

‘নদীর নামে স্টেশন’এর লেখাগুলোর জন্য যখন ছবি তুলেছিলাম তখন কোপাই আর বাঁশলৈ ব্রিজ স্টেশনে নামতে পারিনি। চলন্ত ট্রেন থেকেই ছবি তুলতে হয়েছিল। আসলে আমাদের চাকরিতে নিজের অফিসঘর থুড়ি মালগাড়ির ব্রেক ভ্যানে বসেই সময় কেটে যায়। কোপাই স্টেশনে পরে নেমেছিলাম একবার। ভারী সুন্দর। নদীর মতোই। ছোট্ট শান্ত। স্টেশনের পাশেই একটা বড় মাঠ। খেলাধুলো হতে দেখেছি দিনের বেলা ট্রেন নিয়ে পাশ করার সময়। আর একটা স্টেশনের নাম বিশেষ ভাবে বলব। ঝাপটের ঢাল। রামপুরহাট থেকে মালগাড়ি নিয়ে বর্ধমান গিয়েছে আর ঝাপটের ঢালে দাঁড়ায়নি এমন গার্ড ড্রাইভার কেউ নেই। দু’পাশে শুধু চাষের জমি। কয়েকটা রেলের কোয়ার্টার ছাড়া জনবসতি নেই। শীতের রাতে লুপে গাড়ি দাঁড়ালে দু’দিকের দরজা বন্ধ করে লেপ-কম্বল চাপালেও কাঁপুনির হাত থেকে রেহাই নেই। এখন তো কিছু নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তুলনা করতে হয়। লকডাউনের আগে আর পরে। কিন্তু এই ঝাপটের ঢালের তুলনা সে নিজেই। এর কোনও পরিবর্তন লকডাউনে হয়নি। আগেও যা এখনও তাই।

সন্ধ্যে নামছে। তিনপাহাড় স্টেশন থেকে।

একই অভিজ্ঞতা হবে মালদা লাইনের খালতিপুর, জামিরঘাটা লাইনে। শীতের রাত। গাড়ি ঢুকল লুপ লাইনে। স্টেশন মাস্টারকে ওয়াকিটকিতে জেনে নেওয়া কত দেরি হবে। তিনি বললেন, খাওয়াদাওয়া করে নিন। এখন তো সরাইঘাট, তিস্তা তোর্সা আছে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে খেতে খেতে শোনা যায় শেয়ালের ডাক। সাহসী দু’একজন এসে সামনে এসে দেখেও যায়। তার পর এক্সপ্রেস গাড়ি চলে গেলে মালগাড়ির লাইন মেলে। গৌড় মালদার বাধা টপকাতে পারলে মালদা টাউন। ডিউটি শেষ আর রাতে রানিং রুমে ঘুম। বাধা পড়লে? গৌড় মালদা। ব্রেকভ্যানের টেবিলে মাথা রেখে ঝিমুনি।

গৌড় মালদা স্টেশনের একদিকে আমগাছ ছাড়া কিছুই নেই। শুধু আম। আমের মরসুমে চাষিরা স্টেশনের পাশে রাজ্য সড়কের ধারে পসরা নিয়ে বসেন। সারারাত ছোট ছোট ঝুপড়ির মধ্যে বসে থাকেন। গাড়ি থামিয়ে লোকে কেনেন। ভিড় করে কিনতে দেখিনি। বিক্রি হয় বলেই তো বসে থাকেন রাতভর। মালদা যখন এসেই পড়লো মালদা টাউনের কথা বলতে তো হবেই। স্বাভাবিক সময়ে মালদা স্টেশনে দিনের থেকে রাতের বেলা ভিড় বেশি হত। আর বেশিরভাগ ভিড় দার্জিলিং, গ্যাংটক, আসাম ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের। একের পর এক ট্রেন এসে দাঁড়ায় আর হকারদের ভিড় হয়। রুটি, তরকারি, মিষ্টি অথবা বিরিয়ানি— সবই পাওয়া যায়। অতিমারির পর এসব উধাও। মালগাড়ি নিয়ে মালদা পৌঁছে জনশূন্য মালদা স্টেশন দেখে মনখারাপ হত। আমাদের রানিং রুমও ফাঁকা। অন্য সময় রানিং রুম সব সময় সরগরম। তখন এক্সপ্রেস গাড়ি বন্ধ। তাই শুধু মালগাড়ির গার্ড ড্রাইভার। সংখ্যায় খুব কম। মালদা লাইনের কথা বললে ফরক্কা সেতু পেরনোর সময়ের সৌন্দর্যের কথা বলতেই হবে।

নগরনবী স্টেশন থেকে সূর্যাস্ত

এবার পড়শি রাজ্যে যাওয়া যাক। লুপ লাইনের সাহেবগঞ্জ যেতে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা স্টেশন পড়ে। রাতের বেলা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনের বেলা দেখা যায় স্টেশনের পাশে ক্রাশার মেশিন চলছে। পাথর ভাঙার আওয়াজ। সেই পাথর মালগাড়িতে ভর্তি হয়ে চলে যাবে নানা দিকে। রাজমহল পাহাড় যেতে গেলে তিনপাহাড় স্টেশনে নেমে যাওয়া যায়। আর মোতিঝরনা দেখতে নামতে হবে মহারাজপুর স্টেশনে।

মহারাজপুর স্টেশনের আশেপাশের প্রকৃতি আমার পুরানো কাজের জায়গা মনে করিয়ে দেয়। পালামৌ জেলা, কোয়েল আর কেঁচকি নদী আর পাহাড় এখানে যেন ‘কপি পেস্ট’ করে বসিয়ে দেওয়া। সন্ধ্যা হলে সব অন্ধকার আর পাহাড়ের কোলে দেশলাই বাক্সের মতো বাড়িগুলোয় টিমটিম করে আলো জ্বলে ওঠে। চলন্ত ট্রেন থেকে দেখতে দেখতে হঠাৎ গোটা পাহাড়টাই অদৃশ্য হয়ে যায়।

মালগাড়ি থেকে দেখা মালগাড়ি।

প্রকৃতি দেখতে দেখতে খাওয়ার কথাও খেয়াল রাখতে হবে। আমার লেখায় খাওয়ার কথা থাকতে হবেই। বাঁশলৈ ব্রিজ স্টেশনের বাইরে একটা বাজার আছে। স্থানীয় মানুষ আনাজ বিক্রি করেন। আর কলা। প্রচুর কলা। এখান থেকে হকাররা ট্রেনেও ওঠেন কলা নিয়ে।

নলহাটি স্টেশন অবস্থানের দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজিমগঞ্জ যাওয়ার ব্রাঞ্চ লাইনে যেতে গাড়ি বদলাতে হয়। এখানে একটা দোকান আছে ঘোষ টি স্টল। চা তো ভাল করেন সঙ্গে একটা ব্রেড টোস্ট বানান যেটা অপূর্ব খেতে। বাড়িতে তৈরি খোয়া ক্ষীর সেঁকা পাউরুটিতে মাখিয়ে টোস্ট বানান।

করোনা-কালে নলহাটি স্টেশন। শুনশান।

মালদা মানে আম আর আমসত্ত্ব। কিন্তু সে তো সারা বছর পাচ্ছি না। সারা বছর যেটা পাই সেটা হল মোমো। পাহাড়ি মোমো এখনও চেখে ওঠা হয়নি। তবে সমতলেরটা তো বিকেলে পেট ভরানোর জন্য ভালই লাগে। মালদা গেলে বিকেলে এটা খাবার জন্য অপেক্ষা করি। স্টেশনের পাশে রানিং রুমের সামনে ছোট্ট একটা দোকান। রীতিমতো লাইন দিয়ে খেতে হয়। এছাড়া মালদায় মিষ্টির মধ্যে রসকদম্ব, কানসাট মেলে। আর মেলে মকাইয়ের রুটি। উনুন জ্বালিয়ে গরমাগরম তৈরি করে দেন। সঙ্গে ধনেপাতার চাটনি। শীতকালে একজন নিয়ে আসেন হিমশীতল খেজুরের রস। বাঁকে করে। একদিনের কথা। স্টেশনের কাছে একটা ছোটো মিষ্টির দোকান আছে। সেদিন মিষ্টি খাচ্ছি আর গল্প করছি। এখানে মিষ্টির দাম কত কম। আমাদের গ্রামেও এরকম দামেই মিষ্টি পাওয়া যায়। একজন সহকর্মী শহরঘেঁষা এলাকার। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের ওখানে কোনও কোনও মিষ্টি এক পিসের দাম ২৫ টাকা। আর এখানে ২৫ টাকায় ৫ টা মিষ্টি পেয়ে যাই।’’ শুনে দোকানদার বললেন, ‘‘আমরাও পারি ওরকম মিষ্টি করতে। ওসব কলকাতায় চলবে। এখানে ২৫ টাকায় পেট ভরে ভাত খাওয়া হয়ে যায়। ২৫ টাকায় একটা মিষ্টি বিক্রি করলে লোক মারবে। দোকান উঠে যাবে।’’

বর্ধমান মানে সীতাভোগ আর মিহিদানা, এ তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সঠিক দোকান চিনে কেনা জরুরি। গণেশ মিষ্টান্ন ভান্ডার এখানকার পুরনো দোকান। স্টেশন থেকে নেমে বড়বাজার এলাকায় এই দোকান। এই দোকানের পথেই আরও একটা দোকান পড়ে। রাধাবল্লভ। স্বাদের দিক থেকে এঁদের সীতাভোগ আর মিহিদানা বেশ ভাল।

মালদার মোমো।

যদিও অতিমারির ধাক্কায় বাইরের খাবারের স্বাদ ভুলে যাবার মতোই অবস্হা। কিন্তু নেশার কবল থেকে মুক্তির উপায়? সবাই নিজের মতো করে উপায় বের করে নিয়েছেন। আমার এক সহকর্মী কথায় কথায় নিজের ব্যবস্হাপনা ব্যাখা করলেন। ওঁর ধোঁয়ার পিপাসা। দোকান থেকে কিনেই খেতে ভয় লাগছে। তাই কিনে জীবাণুনাশক ঢেলে দু’দিন রাখা থাকছে। তার পর তিনদিন রোদে ফেলে রাখা। তার পর সদ্ব্যবহার। তাঁর একটার অসুবিধার কথা বলেছিলেন যে দু’টো তিনটে প্যাকেট রাখতে হচ্ছে তো। মাঝে মাঝে গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে, কোনটা জীবাণুনাশক দেওয়া আর কোনটা রোদে পোড়া। লিখে রাখবেন বলে ভাবছেন। রসিকদের তো এত সমস্যা নেই। তাঁদের সোজা যুক্তি, আলাদা করে স্যানিটাইজার কিনে বাজে খরচের কোনও মানেই হয় না। হাত ধোওয়া, খাওয়া সব একটা জিনিসেই হয়ে যাবে।

ফরাক্কা সেতু থেকে দেখা।

এবার বহুদেশ ঘুরে ঘরের কথা বলি। আমার হোম স্টেশন রামপুরহাট। আসলে এর বিশেষত্ব বিশেষ নেই। আর পাঁচটা ব্যস্ত স্টেশনের মতো। সারাদিন ট্রেনের ভোঁ, মালগাড়ির পারাপার, এক্সপ্রেস গাড়ি আসা আর চলে যাওয়া। আর এখানে পর্যটকদের ভিড়। ভূ-পর্যটক নয় রসিকলালদের ভিড়। সপ্তাহ্নত কাটানো আর দেব-দ্বিজে ভক্তি, এক ঢিলে দুই পাখি মেরে শহরের লোকজন ফিরে যায়। করোনার ধাক্কা স্টেশনকে স্তব্ধ করে রেখেছিল। ট্রেন নেই। তাই টোটো-অটোর ভিড় নেই। হকার নেই। শুধু মাঝে মাঝে মালগাড়ি যায় আর পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন। আর স্টাফ স্পেশ্যাল। স্টেশনের বাইরের জমজমাট ভাবটাই উধাও। পাইস হোটেল থেকে চায়ের দোকান, দেওঘর যাবার বাসস্ট্যান্ড থেকে পাঁচমাথার মোড় সব সুনশান। খালি প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ মাথার বিগ বেন থেকে ঘণ্টার আওয়াজ। স্বাভাবিক সময়ে স্টেশন চত্বরে সকাল হতেই উনুনে আঁচ পড়ে যেত। ৮টার পরেই জমজমাট। মুড়ি, চপ, আলুরদম থেকে পরোটা, ঘুগনি সবাই ডাকতে শুরু করে। আর আছে ছাতু। মিষ্টির দোকানের কচুরি, মিষ্টিও। করোনা-কাল হয়তো একদিন শেষ হবে। আবার স্বাভাবিক হবে সব। কিন্তু কিছু ক্ষত রেখে যাবে। সে ক্ষত শরীরে হোক বা মনে।

রামপুরহাট। প্রাণচঞ্চল স্টেশনটার প্রাণ যেন কেড়ে নিয়েছে কোন রাক্ষসে।

মালদা স্টেশনে মালগাড়ির ব্রেক ভ্যানে বসে আছি। গাড়ি ছাড়বে সেই সময় এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, ‘‘আমাকে একটু পাকুড় পৌঁছে দেবে? এখানে এসে পড়েছি আর ফিরতে পারছি না।’’ বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন। বললাম, ‘‘গাড়ি তো পাকুড় দাঁড়াবে না।’’ বলতে পারলাম না যে মালগাড়িতে আমি নিতে পারি না কাউকে। কর্তব্য আর মানবিকতার দ্বন্দে আমিও অসহায়। ওই কান্না ভরা মুখ ক্ষতের মতো মনে গেঁথে যায়। আর ওঁদের সফর চলতে থাকে। এই সফরের শেষ কোথায় কেউ জানে না। এ সফর ‘যথা ইচ্ছার’ সফর নয়। এ সফর ঘরে ফেরার। এ সফর হয়তো বা ঘুমের ভিতর মালগাড়িতে পিষে গিয়ে শেষ হয়। নতুবা আইসোলেশন সেন্টার বা হোম কোয়রান্টাইনে।

প্রচ্ছদের ছবি— মহারাজপুর স্টেশন থেকে দেখা পাহাড়।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *