মন্দির কথা
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

দেবী বসুমাতার উৎস সন্ধানে

দীপক দাস

নজর ঘুরেছিল আচমকাই। ওই রাস্তা দিয়ে বারকয়েক গিয়েছি। ছাত্রাবস্থায় এবং সম্প্রতি। কিন্তু নজরে পড়েনি। ওইদিকে গেলে ভুলেশ্বর মন্দিরই চোখ টেনে নেয়। আর আমার দরকারও থাকে ভুলেশ্বর মন্দিরে। ডোমজুড়ে ৫৭ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে বাঁ দিকের রাস্তাটা ভুলেশ্বর মন্দিরের দিকে গিয়েছে, এটাই দিগনির্দেশ। একদিন হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে একটি প্রাথমিক স্কুল, বসুমাতাতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়।

নামটায় মন টানে। বসুমাতাতলা? মানে বসুমাতা নামে কোনও দেবী আছেন। তাঁর থান আছে অথবা মন্দিরে তিনি অধিষ্ঠাত্রী। কিন্তু আশপাশে তো এমন কোনও থান বা মন্দির নেই। যা আছে সেটা স্কুল থেকে আরও কয়েক পা এগোলে ভুলেশ্বরের মন্দির। ভুলেশ্বরের মন্দিরের গায়েই আরেকটা ছিমছাম মন্দির রয়েছে। নামটা আর পড়ার আগ্রহ হয়নি। সেদিন পড়লাম।

উত্তর ঝাপড়দহ।
সেই স্কুল। যা অনুপ্রাণিত করেছিল।

বসুমাতা নামে কোনও লৌকিক দেবী রয়েছেন হাওড়ায়, এমনটা শুনিনি। সব লৌকিক দেব দেবীর নাম শুনে ফেলেছি, এমন দাবি করাও বাতুলতা। কাজের সূত্রে যখন মেদিনীপুরের সঙ্গে যোগ বাড়ল তখন সেখানকার নানা লৌকিক দেব দেবীর নাম শুনে আশ্চর্য হয়ে যেতাম। নানা গরাম থানে নানা দেব দেবী। অজানা সব নাম। বাঘুত, শাঁকারি বুড়ি ইত্যাদি। লোককাহিনি এবং ভক্ত সমাবেশে জমজমাট সেই সব দেব দেবী। কিন্তু বসুমাতা?

খোঁজ নেওয়া যায় কী ভাবে? মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিল অভিষেক। আমার সহকর্মী। ওর শ্বশুরমশাই নবকুমার মুখোপাধ্যায় ভুলেশ্বর মন্দিরের পূজারী। অভিষেককে অনুরোধ করলাম, তথ্য যদি কিছু মেলে দেখতে। প্রাথমিক ভাবে তথ্য এল, আসলে ইনি বসুধা মানে পৃথিবী। অম্বুবাচীর দিনে পুজো হয়। সংকল্প হয় ধরিত্রী মাতার নামে। অম্বুবাচীতে কোনও পুজো হয় না। একমাত্র কামাখ্যা দেবীর অম্বুবাচী মেলা হয়। তাহলে কি ভিন রাজ্যের কোনও যোগ আছে? অভিধান খুঁজে দেখলাম। সুবলচন্দ্র মিত্রে বসুমাতা শব্দটি মিলছে। এর অর্থ পৃথিবী, বসুধা।

উত্তর ঝাঁপড়দহ
বসুমাতা মন্দির। আগের পাঁচিল ভুলেশ্বর মন্দিরের।

তথ্যের আদানপ্রদান কখনও ভায়া হয়ে হয় না। আরেকবার যেতে হবে। অভিষেককে অনুরোধ করতে ও শ্বশুরমশাইকে বলে এক মঙ্গলবার বিকেলে দিন ঠিক করল। মেসোমশাই জানালেন, ওইদিন মন্দির কমিটির লোকজনকেও ডেকে নেবেন। তবে ডাকতে হয়নি। মেসোমশাই কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বসুমাতা মন্দির কমিটির সদস্য সুদর্শন দাসকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। সুদর্শনবাবু সুন্দর হস্তাক্ষরে একটা খাতায় দেবীর উৎপত্তি, পুজো শুরু ও মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লিখে দিয়েছিলেন। খাতা রাখা ছিল মেসোমশাইয়ের কাছে। মঙ্গলবার বিকেলে গিয়ে সেই লেখা সংগ্রহ করলাম।

বসুমাতার প্রতিমা।

পুজো প্রচলনের সঙ্গে গ্রামের বা পুজোর উদ্যোক্তাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত জড়িয়ে থাকে। সমৃদ্ধ গ্রামের জমিদার দুর্গাপুজো শুরু করতেন। বারোয়ারি পুজোর কথা আলাদা। ওই জমিদারেরই কিছু প্রজা শীতলা, ধর্ম, মনসার পুজো আনতেন তাঁদের পাড়ায়। বসুমাতা পুজো প্রচলনেও আর্থ-সামাজিক ভূমিকাটি জোরদার। সুদর্শনবাবুর লেখা অনুযায়ী সেই ভূমিকাটির কথা উল্লেখ করছি। তিনি গ্রামের বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকে বসুমাতার পুজো শুরুর ইতিহাস শুনেছেন।

বসুমাতা মন্দিরটি ডোমজুড় থানা এলাকার উত্তর ঝাঁপড়দহ গ্রামের মাঝের পাড়ায়। উত্তর ঝাঁপড়দহ গ্রামটি এক সময়ে ছিল কৃষিপ্রধান। গ্রামের সকলেই কৃষিজীবী। এখানে ধান আর পানের চাষ হত। কিন্তু প্রধান চাষ ছিল পান। অনেক বরোজ ছিল। পান চাষ সারা বছর ধরেই হত। প্রচুর খাটতে হয় পান চাষে। ফলে অন্য কিছু চাষের সময় হত না। এখন যেখানে বসুমাতা মন্দির তার পাশেই একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছ। গাছের নীচে বহু পুরনো বেদি ছিল। কীসের বেদি তা জানা যায় না। তবে গ্রামের মহিলারা বিশেষ বিশেষ দিনে ফুল, ধূপ দিতেন। বেদির পাশেই ছিল বাঁশ ও টালির চালের একটা চালা। এই চালা আসলে রাত পাহারার আশ্রয়। পানের দাম আছে। চুরি যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই চাষিরা এই চালায় বসে রাতে পান বরোজ পাহারা দিতেন। পালা করে পাহারা চলত। দিনের বেলায় চাষের কাজ সেরে এই চালায় জিরিয়ে নিতেন চাষিরা।

সেজে উঠেছে মন্দির। পুজোর দিনে তোলা ছবি।

মন্দিরটি আশপাশ এলাকা ছিল বিস্তৃত জলাভূমি। পাড়ার শেষ সীমানা ছিল এখন যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সেখানে। যে বিদ্যালয়ের নামে বসুমাতাতলা শব্দটি প্রথম দেখি আমি। এখন অবশ্য ওই এলাকায় অনেক বাড়িঘর। সুদর্শনবাবু লিখছেন, চাষ সারা বছর হলেও বছরের চারদিন চাষের কাজে ছুটি মিলত। ৭ আষাঢ় অম্বুবাচী তিথি শুরু। চলে ১০ আষাঢ় পর্যন্ত। এই চারদিন জমিতে কোনও কৃষিকাজ হয় না। গ্রামবাসীরা অশ্বত্থতলায় বসে গল্পগুজব করে সময় কাটাতেন। তাঁরা আলোচনা শুরু করেন, এই চারদিন বসে না থেকে কোনও পুজোর আয়োজন করলে কেমন হয়? নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে পুজো সবসময়েই আনন্দ বয়ে আনে। কিন্তু অম্বুবাচীতে কোনও পুজোও যে হয় না। সব দেব-দেবীর মন্দির বন্ধ থাকে। একটু নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন চাষিরা। অম্বুবাচী শেষ হলে তাঁরা আবার চাষের কাজে মন দেন। পুজো শুরুর চিন্তা স্থগিত হয়ে যায়।

বসুমাতার ঘট। পাশে সেই পাথরের শিব। দেওয়ালে বসুমাতার মূর্তির ছবি।

নতুন করে ভাবনা শুরু হয় এক প্রবীণ চাষির কারণে। তিনি ছিলেন ধার্মিক। রাত পাহারার সময়ে অশ্বত্থতলায় বেদিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে ধ্যান ও জপ করতেন তিনি। কথিত যে, এক রাতে ধ্যানের সময়ে বসুমাতা তাঁকে দেখা দেন। পাঁচমুখো সাপের মাথায় পা রেখে পদ্মফুলে আসীন দেবী। চতুর্ভুজা দেবী। তাঁর এক হাতে পদ্ম, এক হাতে শঙ্খ, আরেক হাতে পান পাতা ও ধানের শিষ। চতুর্থ হাতে বরাভয় মুদ্রা। দেবীর দু’পাশে দুই সখী, জয়া ও বিজয়া।

প্রবীণ চাষির দৈবী আদেশ হয়, অম্বুবাচী তিথিতে বসুমাতা নামে পুজো করার। চাষি পরদিন গ্রামের সকলকে দৈবী আদেশ জানান। গ্রামের প্রবীণেরা সকল গ্রামবাসীকে ডেকে আলোচনায় বসেন। এবং সিদ্ধান্ত হয়, ওই বছরেই পুজো শুরু হবে। বসুমাতার পুজো শুরু হয় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের ৭ আষাঢ়। তখন প্যান্ডেলের প্রচলন ছিল না গ্রামে। এদিকে সময়টা ভরা বর্ষা। তাই গ্রামবাসীদের বাগানের বাঁশ নিয়ে দোচালা তৈরি হয়। ছাউনি দেওয়া হয় টালির। সেটাই বসুমাতার প্রাথমিক মন্দির। এদিকে পুজো শুরু হতে আরেক চাষির ভর হয়। ভর অবস্থায় তিনি জানান, মন্দিরের পাশের পুকুরে পাথরের শিব ঠাকুর রয়েছে। শিবও বসুমাতার পাশে জায়গা পান। পুজোর আগের রাতে গঙ্গা থেকে বাঁকে করে জল এনে শিবের মাথায় ঢালা হয়। পুজো শুরুর কয়েক বছর পরে বাঁশের দোচালা হয় পাকা। ১৩৯৯ সালে স্থানীয় বাসিন্দা গোবিন্দচন্দ্র সাধুখাঁ এখনকার মন্দিরটি তৈরি করে দেন। বর্তমানে মন্দির ও পুজো পরিচালনা করে একটি কমিটি।

বসুমাতা মন্দির।
মন্দির চত্বরে বসে পূজারী নবকুমারবাবু ও শম্ভুবাবু (মাঝে)।

নবকুমারবাবু অর্থাৎ মেসোমশাইয়ের সঙ্গে যখন আলোচনা করছি তখন এলেন শম্ভু দাস। ইনিও কমিটির এক সদস্য। জানালেন, পুজোর সময়ে বালি, উত্তরপাড়া থেকেও ভক্তরা আসেন। গ্রামে দুর্গাপুজোর থেকে বেশি আনন্দ হয় বসুমাতা পুজোয় প্রচুর লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।

পুজোর দিনে বসুমাতার প্রতিমা।

জনশ্রুতি, লোককাহিনি ও স্বপ্নাদেশ বহু দেব-দেবীর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে। বসুমাতার ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় হল, দেবীর হাতে পান পাতা আর ধানের শিষ। পুজোর উদ্যোক্তারা যেন চেয়েছিলেন, তাঁদের কষ্ট করে চাষ করা দুই ফসল বেঁচে থাকে। তাহলে তাঁরাও বাঁচবেন। পুজোর সময়ে দেবীর এই রূপই মৃণ্ময়ী হয়। বছরের বাকি সময়ে মন্দিরে ঘট বসানো থাকে। ঘটের পিছনের দেওয়ালে বসুমাতার প্রতিমার একটি ছবি বাঁধাই করে টাঙানো রয়েছে। কোন দেবীর আদলে বসুমাতার রূপ কল্পনা তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে জয়া-বিজয়ার উপস্থিতিতে মনে হয় পার্বতী বা দুর্গার প্রভাব রয়েছে।

বসুমাতা মন্দির ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। বসুমাতাতলাও একটি পরিবর্তনশীল জায়গা। আগে জায়গাটির পরিচয় ছিল অশ্বত্থতলা নামে। গাছটি মন্দিরের গায়ে এখনও রয়েছে। মন্দির তৈরি হতে জায়গার নাম হল, বসুমাতাতলা। এখন জায়গাটির পরিচয় ধীরে ধীরে ভুলেশ্বর মন্দিরের দিকে এগোচ্ছে।

কভারের ছবি— বসুমাতা মন্দির।

ছবি— নবকুমার মুখোপাধ্যায়, নূপুর দত্ত, নারায়ণী সাউ ও লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *