ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

দিনেমারদের ফ্রেডরিক নগরে এক দুপুরে

দীপক দাস

খেতে গিয়ে ঘোরা হয়ে গেল। ঘুরতে গিয়ে খাওয়াদাওয়ার বাহুল্য আমাদের থাকে না। আবার খেতে গেলে ঘুরতে পারা যায় না। তখন শুধু স্বাদ সন্ধান চলে। এবার একটু ব্যতিক্রমই হল বলা চলে। কিশোর কুমারের ‘যানা থা জাপান পৌঁছ গয়ে চিন’এর মতো পুরোপুরি না হলেও খানিকটা সেরকমই।

গুটকে সন্দেশ খেতে শ্রীরামপুর গিয়েছিলাম। তার আগে ভাই শ্রীধর বাঁড়ুজ্জে এবং প্রাক্তন সহকর্মী পৌলমী রক্ষিতের থেকে দর্শনীয় কিছু জেনে নিয়েছিলাম। আগ্রহ একটা ছিলই। মাহেশের রথের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল ডেনমার্কের উপনিবেশ হিসেবে। দিনেমারেরা এ দেশে তেমন দাঁত ফোটাতে পারেনি। মাত্র তিনটে জায়গায় ছিল তাদের উপনিবেশ। আর সেগুলোর একটা এই বাংলায়। আমাদের ঘরেই কাছেই। বাংলা সাহিত্য জগতেও তো শ্রীরামপুরের ভূমিকা কম নয়। যাওয়া উচিত।

রাজবাড়ি
শ্রীরামপুর রাজবাড়ির একটা অংশ।

এবার একাকী সফর। গোঁসাই পাড়ায় মহেশ চন্দ্র দত্তের দোকানে গুটকে সন্দেশের খোঁজ নিয়েছিলাম। দোকানের মালিক সুকান্ত দাসকে দুই শুভানুধ্যায়ীর দেওয়া তালিকা পড়ে শোনালাম। তিনি মোটামুটি মৌখিক একটা মানচিত্র এঁকে দিলেন। সেই মানচিত্র মনে এঁকে যাত্রা শুরু। পদযাত্রা। দোকান থেকে কিছুটা হাঁটলে শ্রীরামপুর রাজবাড়ি। একটা বাঁক ফিরে রাস্তার পাশেই। সামনে একটা মাঠ। তার পরে প্রাসাদের মতো বাড়িটা। ছবিটবি তুললাম। কিন্তু প্রবেশপথের উপরে লেখা ইংরেজি কয়েকটি শব্দে মনটা খচখচ করছিল। এটা রাজবাড়ি তো? দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে একটা বেসরকারি স্কুল। এক বয়স্ক ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, রাজবাড়ি আরেকটু এগিয়ে। এটা রাজবাড়িরই অংশ।

মূল রাজবাড়ির প্রবেশপথ।

এগিয়ে গেলাম। বিশাল অংশ জুড়ে রাজবাড়ি। মূল প্রবেশ পথটাও মিলল। এক ভদ্রলোক ঢোকার মুখে বসেছিলেন। তাঁর কাছে ভিতরে ঢোকার অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন, ‘‘যেতে পারেন। তবে তেমন লাভ হবে না। গায়ে রং পড়ে যাবে। ভিতরে রঙের কাজ চলছে।’’ রাজবাড়িতে নাকি ক’দিন ধরে নাকি সিনেমার শ্যুটিং চলছে। কী সিনেমা? ‘শ্বেতকালী’ না কী যেন একটা নাম বললেন ভদ্রলোক। কারা রাজা ছিলেন? কী তাঁদের ইতিহাস কিছুই জানা হল না। শুধু জানতে পারলাম, গোস্বামীরা ছিলেন রাজা। এটা তাঁদের প্রাসাদ। এখন অবশ্য, ‘রাজছত্র ভেঙে’ পড়েছে।

রাজবাড়ি থেকে গঙ্গার পার ধরে মানিকতলায়। সেখানে আরেক মহেশ চন্দ্র রয়েছেন। গুটকের আদি দোকান। এই সন্দেশের সঙ্গে রাধাবল্লভ মন্দিরের একটা যোগ রয়েছে (গুটকে সন্দেশ আর দুই কিংবদন্তী)। মন্দিরটির প্রসিদ্ধি আছে। মন্দিরের প্রভাব বোঝা যায় তার গায়ে দান ফলক দেখে। বহু ফলক রয়েছে। একটি ফলকে রয়েছে, মন্দিরটি ১১৭১ বঙ্গাব্দে ইংরেজি ১৭৬৪ সালে ‘কলিকাতা নিবাসী ধর্ম্মপ্রাণ’ নয়ান চাঁদ মল্লিক তৈরি করেন। তাঁর ছেলে নিমাই চরণ মল্লিক ১৮৩৭ সালে ‘বিগ্রহের নিত্য সেবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন’। মন্দির সামনের নাটমন্দিরটিও বেশ বড়। শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব রাধাবল্লভের ভক্ত ছিলেন। বহু অর্থ দিয়েছিলেন মন্দিরে।

রাধাবল্লভ মন্দির।

অপরিচিত জায়গায় রাস্তা চেনা না থাকলে অনেক সময় ঠকতে হয়। ঠকলাম। যাওয়ার চেষ্টা ছিল শ্রীরামপুর কলেজ, উইলিয়াম কেরির সমাধিস্থলে। কোনদিকে যেতে হবে জানি না। এক টোটোচালক এক মিনিট চাপিয়ে ১০ টাকা আদায় করে নিল। তার পর নামিয়ে দিয়ে বলল, এই গলি দিয়ে চলে যান টোটো পেয়ে যাবেন। ১০ টাকার শোক অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই কেটে গেল। রাস্তায় এক প্রবীণকে পেলাম। তাঁকে গন্তব্যের কথা জানাতে তিনি বললেন, ‘‘দু’টো দু’দিকে পড়ে। আপনি প্রথমে কেরির সমাধিটা দেখে আসুন। এই সামনেই উড়ালপুল যেখান থেকে শুরু হচ্ছে তার বাঁ হাতে চলে যাবেন। ব্রজ দত্ত লেনে কেরির সমাধি।’’ খুবই আন্তরিক ভদ্রলোক। মনে হল, তিনি প্রাচীন শ্রীরামপুর সম্বন্ধেও জানতে পারেন। দিনেমারদের স্থাপত্যের নিদর্শন যদি কিছু দেখতে চাই তাহলে কী ভাবে গন্তব্য ঠিক করতে হবে?’’ ভদ্রলোক জানালেন, আগে কেরির সমাধি দেখে নিতে। সেখান থেকে টোটো ধরে আদালতের কাছে চলে গেলেই হবে।

এই সমাধি ক্ষেত্রেই রয়েছে কেরির সমাধি। সামনে ওয়ার্ডের সমাধি।

কেরির সমাধিতে গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা। দরজা বন্ধ। এক পথচারী জানালেন, কাছেই কেয়ারটেকারের বাড়ি। তিনি যদি খুলে দেন তবেই দেখতে পাবেন। কেয়ারটেকারের বন্ধ দরজায় টোকা দিলাম। এক তরুণী দরজা খুললেন এবং সটান বলে দিলেন সমাধি ক্ষেত্রের দরজা খোলা যাবে না। ঢুকতে গেলে শ্রীরামপুর কলেজের অনুমতি নিতে হবে। ফিরে এসে বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে যতটা দেখা যায় দেখার চেষ্টা করলাম। সমাধি ক্ষেত্র এমনিতেই বিষণ্ণ হয়। আগাছার জঙ্গলে, ঝরা পাতা, শীতের পড়ন্ত দুপুর জায়গাটিকে আরও বিষণ্ণ করে তুলেছে। এক বিষণ্ণতায় ডুবে বাংলা গদ্যচর্চার পথিকৃত কেরি আর তাঁর সঙ্গী জন মার্শম্যান ও ওয়ার্ড শুয়ে আছেন অবহেলায়।

দেখা যাচ্ছে কেরির সমাধির অংশ।

উইলিয়াম কেরি বাংলা গদ্যচর্চার আদি পুরুষ। যদিও খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই তাঁর ভারতে আগমন। ১৭৯৩ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় ধর্ম প্রচারে তেমন সুযোগ দেয়নি। ফলে জন মার্শম্যান-সহ ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা দিনেমারদের উপনিবেশ শ্রীরামপুরে চলে আসেন। ১৮০০ সালে চলে আসেন কেরিও। তৈরি হয় শ্রীরামপুর মিশন। তিনি বাংলা শিখেছিলেন রামরাম বসুর কাছে। পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক হন তিনি। শ্রীরামপুর থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম মুদ্রিত সাময়িক ‘দিগদর্শন’। এবং সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। ইংরেজি সংবাদপত্র ‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’। যা পরে হয় ‘দ্য স্টেটসম্যান’ দৈনিক। কেরিদেরই উদ্যোগে। কেরি ও পঞ্চানন কর্মকারের যুগলবন্দি বাংলা গদ্য চর্চার অন্যতম নাম। তাঁরাই শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলা গদ্যের বই ছাপাতেন। ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর আনন্দবাজারে একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রলেখক কেরি ও মার্শম্যানদের সমাধি ক্ষেত্রের দুরবস্থা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। চার বছর পরেও সেই আক্ষেপ না করার কারণ দেখলাম না।

এই গির্জার ছবি তুলতে পেরেছিলাম।

কেরির সমাধির বিষণ্ণতা নিয়েই টোটোয় চাপা। গন্তব্য আদালত চত্বর ও গির্জা। কিন্তু টোটো চালক যে গির্জার সামনে নামিয়ে দিলেন সেটি ওলাফ গির্জা নয়। ইমাকুলেট কনসেপশন চার্চ। ওর পাশ দিয়েই আদালতের দিকে হেঁটে গেলাম। সেদিন আবার পুরসভার মনোনয়ন চলছে। রাস্তাঘাটে শাসক দলের পতাকা হাতে ভিড় চলেছে। মহকুমা আদালত এবং মহকুমা শাসকের অফিস একই চত্বরে। প্রবেশ তোরণ দেখলেই বোঝা যায় ইউরোপীয় রীতিতে নির্মিত। ইতিহাস বলছে, শ্রীরামপুরের মহকুমা আদালত আগে ছিল দিনেমার গভর্নরের বাসগৃহ। আদালত চত্বরে দেখা হল আরেক শুভানুধ্যায়ীর। তিনি মনোনয়নের জন্যই কোনও দলের সঙ্গে এসেছিলেন। তাঁকে কেরির মিউজিয়াম আর শ্রীরামপুর কলেজের পথ জানতে চাইলাম। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনি কি ইউটিউবার?’’ শুনে মনে হল, লেখালেখির দিন গিয়েছে। লোকে আর পড়ছে না দেখছে। উইলিয়াম কেরি মিউজিয়াম শ্রীরামপুর কলেজে। তিনি কলেজের পরিচিত কোনও কর্মীকে ফোন করে আমার যাওয়ার কথা বললেন।

আদালত।

আদালত চত্বরের কাছেই ওলাফ গির্জা। চুড়োটা দেখতে পাচ্ছিলাম। গির্জা হয়ে কলেজে যাব বলায় শুভানুধ্যায়ী ভদ্রলোক তাড়া লাগালেন। কলেজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ‘ফেরার সময়ে তুলে নেবেন’— পরামর্শ দিলেন। ফলে ওলাফ গির্জা দেখাই হল। ছবি তোলা হল না। ১৮০৫ সালে শ্রীরামপুর মিশনের চেষ্টায় সেন্ট ওলাফস গির্জা তৈরি হয়।

গঙ্গার পার ধরে হাঁটা। কিছুটা গিয়ে এক মোড়ে সংশয় উপস্থিত। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে একজন বলছেন এই তো সামনে। আরেকজন বলছেন, আরও হাঁটতে হবে। শেষে এক মহিলা পুলিশ কনস্টেবলের শরণাপন্ন। তিনি সাহায্য করলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘টোটো নিতে হবে?’’ তিনি বললেন, ‘‘হেঁটে যেতে পারবেন। ভাল লাগবে।’’ গঙ্গার পার দিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছিল না। পাতা ঝরা অশ্বত্থ গাছ, পাতা ভরা রাস্তা, ডান পাশে ইন্ডিয়া জুট মিলের বিষণ্ণ আবাসন মনকে ভারাক্রান্ত করছিল। তবে প্রাণের স্পন্দনও টের পাওয়া যাচ্ছিল। নদীর ধারে অনেক যুগলের আগমন। সঙ্গে কিছু অকাজে আসা ছেলে ছোকরাও।

আদালত চত্বরে আরেক ভবন।

যতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে কলেজে পৌঁছব ততক্ষণে শ্রীরামপুরের সঙ্গে দিনেমারদের সম্পর্ক খোঁজা যাক। শ্রীরামপুরে দিনেমারদের আগমন কেন? ইউরোপীয় দেশগুলো যে উদ্দেশ্যে এসেছিল। ব্যবসা করতে। ১৭৫৫ সালে দিনেমাররা শ্রীরামপুরে আসে। এসেছিল গোন্দলপাড়া থেকে। ব্যবসার সুবিধার জন্য তারা নবাবের থেকে ৬০ বিঘা জমি নেয়। জমি পেতে সাহায্য করেছিলেন ফরাসি এজেন্ট মঁসিয়ে ল। জমি পেতে ও ব্যবসার জন্য ফরমান সংগ্রহে তাদের ১৬ হাজার পাউন্ড খরচ করতে হয়েছিল। ১৭৫৫ সালের ৮ অক্টোবর দিনেমারদের পতাকা ওড়ে। পতাকা রক্ষা করতে ডেনমার্ক সরকার চারজন পাইক নিয়োগ করে। ব্যবসার অনুমতি দিয়ে বহু অর্থ পেয়েছিলেন নবাব সিরাজদ্দৌলা। শ্রীরামপুরে একটা চালাঘরে প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন দিনেমার ব্যবসায়ীরা। নতুন ইজারা পাওয়া শ্রীরামপুরের নাম রাখা হয় ফ্রেডরিক নগর। ডেনমার্কের রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকের নামে। শ্রীপুর, আকনা, গোপীনাথপুর, মোহনপুর ও পেয়ারাপুর নিয়ে গঠিত ছিল ফ্রেডরিক নগর। ব্যবসা আরম্ভ করার অল্পদিন পরেই সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন। তিনি দিনেমারদের থেকে জাহাজ চেয়েছিলেন। কিন্তু দিনেমাররা তা দেয়নি। কলকাতা আক্রমণের পরে ফেরার সময়ে দিনেমার ব্যবসায়ীদের ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন সিরাজ।

আদালত চত্বরে প্রবেশ পথ।

শ্রীরামপুর কলেজে গিয়ে তেমন লাভ হল না। সেই কর্মী ভদ্রলোকের সুপারিশেও কাজ হল না। একটা দরখাস্ত করতে বলা হয়েছিল। আমার পিঁপড়ে চলন অক্ষরে করেওছিলাম। কিন্তু অধ্যক্ষ অনুমতি দেননি। তিনি কোনও পরিচয়পত্র-সহ আবেদন করতে বলেছিলেন। আমার কাছে কোনও পরিচয়পত্র ছিল না। ফলে উইলিয়াম কেরি মিউজিয়ামে ঢোকার অনুমতি পেলাম না। এই কষ্ট নিয়েই শ্রীরামপুর কলেজের সমৃদ্ধ ইতিহাসটা একটু শুনিয়ে দিই। বাংলায় খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম কলেজ হল শ্রীরামপুর কলেজ। ১৮১৮ সালের ১৫ জুলাই কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। উদ্যোগে ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা। শ্রীরামপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড। এঁরা কলেজ কাউন্সিলের প্রথম সভ্য। তবে ব্রিটিশ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ও শ্রীরামপুরের দিনেমার গভর্নর কর্নেল কেফটিংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল কলেজ তৈরিতে। শিক্ষা বিস্তার ও খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের জন্য মিশনারিদের এই উপনিবেশে সুযোগ দিয়েছিলেন শ্রীরামপুরের দিনেমার গভর্নর। ১৮২০ সালে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা কলেজের বিভিন্ন বিভাগগুলো খোলে। ১৮২১ সালে ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডরিক কলেজে সাহায্য করেন। ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে কলেজ তৈরির ইচ্ছে ছিল মিশনারিদের। কিন্তু কয়েকটি মৃত্যুতে সেই ইচ্ছে বাস্তবায়িত হয়নি। ১৮২৩ সালে ওয়ার্ড সাহেব মারা গেলেন। ১৮২৪ সালে মারা গেলেন বঙ্গীয় শিক্ষা জগতের কিংবদন্তী উইলিয়াম কেরি সাহেব। তবে ১৮২৭ সালে ডেনমার্কের রাজার এক রাজকীয় সনদে শ্রীরামপুর কলেজ হয় ‘এশিয়ার সর্বপ্রথম ডিগ্রিদানের অধিকার প্রাপ্ত’ কলেজ। দিনেমাররা শ্রীরামপুর ছেড়ে চলে যায়। ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় কলেজ।

শ্রীরামপুরের গঙ্গা।

দিনেমারেরা তাদের সাধের ফ্রেডরিক নগর ছেড়েছিল ইউরোপে ব্রিটিশ-ডেনমার্ক যুদ্ধ ও সম্পর্কে অবনতির কারণে। ১৮৪৫ সালের ১১ অক্টোবর ডেনমার্কের রাজা শ্রীরামপুর, ট্রানকোয়েবার এবং বালেশ্বর সাড়ে ১২ লক্ষ টাকায় ইংরেজদের বিক্রি করে। ভারতে এই তিনটি স্থানেই দিনেমারদের উপনিবেশ ছিল। ডেনমার্কের রাজা যখন শ্রীরামপুর বিক্রি করতে চাইছেন তখন দুই গোস্বামী ভাই কেনার চেষ্টা করেছিলেন ১২ লক্ষ টাকায়। হরিনারায়ণ গোস্বামী দিনেমারদের দেওয়ান ছিলেন। তাঁর ভাই রঘুনাথ গোস্বামী কোম্পানির মুৎসুদ্দি হয়ে প্রচুর বড়লোক হয়েছিলেন। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাধা দেওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। শ্রীরামপুর হয় ব্রিটিশদের।

গঙ্গাপাড়ের শ্রীরামপুর, দিনেমারদের শ্রীরামপুর এক সুন্দর নগরী ছিল। বিশপ হেবার বলেছিলেন, শ্রীরামপুরকে ইউরোপীয় শহরের মতো দেখায়।

তথ্য সহায়তা: ১। হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ— সুধীরকুমার মিত্র ২। হুগলী জেলার ইতিহাস— সুধীরকুমার মিত্র সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয়— পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য

কভারের ছবি— শ্রীরামপুর কলেজ

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

4 thoughts on “দিনেমারদের ফ্রেডরিক নগরে এক দুপুরে

  1. ফরাসি উপনিবেশ হিসাবে চন্দননগরের যতখানি পরিচিতি, তার তুলনায় ড্যানিশ উপনিবেশ শ্রীরামপুরের পরিচিতি নেই বললেই চলে। এই লেখা সেই অভাবটা খানিক দূর করবে।

    1. শ্রীরামপুরের পুরো পরিচয় মাহেশের রথ দখল করে নিয়েছে। তবে সুধীর কুমার মিত্র শ্রীরামপুর নিয়ে অনেকখানি লিখেছেন।

  2. ২০২০ নাগাদ শ্রীরামপুরে ঘুরতে গিয়ে যা বুঝেছিলাম স্থানীয় মানুষ এখানকার ইতিহাস নিয়ে একদমই ভাবিত নন। তখন কোভিড চলছিল বলে পরে আরো দুবার গেছি। একটা বেসিক লেখা আমার ব্লগে তোলা আছে। আর ঠিকই বলেছেন লোকে এখন পড়ে না৷ শুধু দেখে।

    1. আপনার অনুভব সঠিক। ইতিহাস নিয়ে সচেতনতা খুব কম জায়গায় পেয়েছি। আর অনেক সময়ে অতি সচেতন মানুষ এত গালগল্প জুড়ে দেন তা থেকে ঘটনার কাছাকাছি কিছু ছেঁকে নেওয়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। লেখা পড়ে তা জানানোর জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *