ত্রিবেণী
পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ক্যাম্প…কমলালেবু…বরোলি…ভিস্তা ডোম

সৌগত পাল

আমার সহকর্মী দেবাশিস একটা কথা বারবার বলে, ‘‘আমার কোনও কাজ সহজে হয় না। একবারে হয় না।’’ দেবাশিসকে নিয়ে বলতে গেলে একটা গোটা লেখা হয়ে যাবে। আজ ওকে নিয়ে লেখার দিন নয়। আজ লিখব দীপুদাকে নিয়ে। না, ইনি আমাদের কালো বেড়াল দীপুবাবু নন। বাঙালির চিরকালীন দীপুদা।

দীপুদার সূত্রে দেবাশিসেরর কথাটা মনে পড়েছিল। দীপুদার দা মানে দার্জিলিংয়ে যাবার ইচ্ছে হয়েছিল একবার। ঠিক করেছিলাম চারজন মিলে দু-তিনদিনে ঘুরে চলে আসা যাবে। রামপুরহাট থেকে যাবার সুবিধা। রাতে খাবার খেয়ে ট্রেনে উঠে পড়ো আর সকাল সকাল নিউ জলপাইগুড়ি নেমে গাড়ি ধরে চলো দার্জিলিং।

শুকনা এলাকা।

কিন্তু সব কি সহজ! দেশ জুড়ে শুরু হল অতিমারি আর আমাদের পরিকল্পনা ধামাচাপা। ইতিমধ্যে একটা বছর কেটে গেছে আর মেস ভেঙে লোকজনও চলে গেল। তা হলে কি যাবো না দার্জিলিং? মুশকিল আসান করল দাদা। মানে রথীন সেন। রথীনদা জানাল, দার্জিলিং যাবার পরিকল্পনা হচ্ছে। কিন্তু একা লোকের জায়গা নেই। তো? ঘুরতে গিয়ে মুড়ি চানাচুর দিয়ে লাঞ্চ খেতে পেরেছি, ম্যাজিক গাড়িতে পুরূলিয়ার পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরেছি আর এ তো কিছুই না। একা থেকে দোকা হয়ে গেলাম। এবার দিল চাহতা হ্যায় নয়। হম সাথ সাথ হ্যায়।

এটাও শুকনা।

তার পর টিকিট করা হল। রথীনদা জানাল, দার্জিলিংয়ে থাকা-খাওয়া ঘোরা এসবের ব্যবস্থা বিকাশদা করছে। বিকাশদা রথীনদার পুরনো সহকর্মী। আদ্রা ডিভিশনের গার্ডবাবু। আনারা স্টেশন। এখানেই বেগুনকোদর স্টেশন। দাদার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মোটামুটি ১২ জনের দল হচ্ছে। তবে দু’চারজন বাড়তেও পারে।

তারিখ ঠিক হল নভেম্বরের ২৩। রাতের উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস। রামপুরহাট থেকে আমি আর রথীনদা মিলে মোট পাঁচজন। বাকি দল বর্ধমান থেকে উঠবে। যাওয়া আর আসার টিকিট হয়ে যাবার পর ঘোরাঘুরি কী ভাবে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা চলতে লাগল। ঠান্ডা কেমন হবে সেটা নিয়েও ভাবতে হচ্ছিল।

মিরিক গার্ডেন।

বিকাশদা জানাল নিউ জলপাইগুড়ি নেমে আমরা টয় ট্রেনে যাব দার্জিলিং। দার্জিলিংয়ে ঘোরাঘুরি করে আবার চলে আসব জলপাইগুড়ি। ওখান থেকে ভিস্তাডোমে চেপে চলে যাব আলিপুরদুয়ার। আলিপুরদুয়ার থেকে ফেরা। বিকাশদা ছবির মতো বুঝিয়ে দিল। কিন্তু সেই দেবাশিসের অমোঘ বাণী, ‘অত সহজ!’ গোটা সফর জুড়ে তাড়া করে গিয়েছে। তাড়ার শুরুটা শুরু থেকেই। ট্রেনে ওঠার এক মাস আগে বিকাশদার ফোন এল। পরিকল্পনা একটু বদল হচ্ছে। কারণ টয় ট্রেন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাতিল। সুতরাং নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ে যেতে গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। বাকি কিছু পাল্টাচ্ছে না।

মিরিক লেক।

কিন্তু রথীনদা জানিয়ে দিল গাড়ি করে গেলে ওরা বাদ। কারণ বৌদির গাড়ি করে গেলে সমস্যা হয়। পাহাড় পছন্দের জায়গা নয়। খালি ট্রেনে যাওয়া হবে বলেই রাজি হয়েছিল। ট্রেন যখন নেই ওরাও নেই। আমি পড়লাম ফাঁপরে। দলের বাকিরা কেউ চেনা নয়। না ভুল বললাম। চেনা থেকে অচেনা হয়ে যাওয়া কিরীটিদা। আমার প্রাক্তন মেস সহকর্মী। রামপুরহাট থেকে বর্ধমান গিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে আমার নামটাও বোধহয় ভুলে গিয়েছে। এখন উপায়? ব্রেন ওয়াশ! বৌদিকে বোঝানো শুরু হল, এতজন মিলে যাওয়া হচ্ছে। কোনও সমস্যা হবে না। সেই কবে একবার হয়েছে আর এখন কিছু হবে না। তারপর বলা হল, গাড়িতে সবথেকে ভাল জায়গাটা দেওয়া হবে। সামনে। তো যাই হোক মোটামুটি রাজি করিয়ে ২৩ নভেম্বরের অপেক্ষায় রইলাম।

গোপালধারা টি এস্টেট।

যাবার ঠিক দু’দিন আগে আবার ধাক্কা। এবার রথীনদা। ঠান্ডা লাগিয়ে গলা ফুলিয়ে ঢোল করেছে। এইসব দেখে একজনকে মনে পড়ছিল। সে এরকম কোথাও যাবার আগে আগে বাদ পড়ে যেত। সেটা ইচ্ছাকৃত। যাই হোক ২৩ তারিখ সকালে বিকাশদা ঘোষণা করে দিল মোট ১২ জনের দল। রথীনদাদের তিনজন শেষ মুহূর্তে বাদ পড়েছে। রামপুরহাট স্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। আপ উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। ট্রেন ঢুকছে। হঠাৎ কী মনে হল পাশ ফিরলাম। দেখি মিস ধৃতি সেন (ওকে আমরা বুড়ি বলে ডাকি) কেয়ার অফ রথীন সেন পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে! আর ভাবখানা কী কেমন দিলাম গোছের।

পশুপতি মার্কেট। নেপাল।

ট্রেন ঢুকে গিয়েছে। ভ্যাবাচাকা অবস্থা কাটিয়ে ট্রেনে উঠলাম। রথীনদা বলল, ভেবেছিলাম একদম ট্রেনে উঠেই জানান দেব। বিকাশদা জানত রথীনদা যাচ্ছে। সকালে শেষ সময়ে যাবে বলেই ঠিক করে। গোটা দলের এক জায়গায় সিট পাওয়া যায়নি। আমরা রামপুরহাটের পাঁচজন এক সঙ্গেই আছি। বাকিরা অন্য কামরায়। রাতের ট্রেনে আর বেশি গল্প হল না। শুয়ে পড়লাম। ট্রেন যখন ফরাক্কা ব্যারেজ পার হচ্ছিল তখন ঘুম ভেঙে গেল। মালদহ ছাড়ল রাত ০২:৩০। আধো ঘুমের মধ্যে স্টেশন পার হচ্ছিল।

বাতাসিয়া লুপে টয় ট্রেন।

ভোরের আলো ফুটছে। ট্রেন দাঁড়াল কিষানগঞ্জ। গাড়ি একটু লেট চলছে। আধ ঘণ্টা লেট করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামা গেল। স্টেশনে নেমে একদফা ফটোসেশন। নভেম্বরের জলপাইগুড়ি রীতিমতো গরম। আকাশ মেঘলা। বিকাশদা তাড়া দেওয়া শুরু করল। এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হবে। তার মধ্যে সাজগোজ সেরে খাওয়াদাওয়া করে গাড়িতে উঠতে হবে। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে সবাই চলে গেলাম। রেডি হয়ে স্টেশনের বাইরে এলাম। দু’টো গাড়ি অপেক্ষা করছিল। রুমবাদা আর সন্তোষদা। আমাদের পুরো সফরের চালক। গাড়িতে ব্যাগপত্র রেখে সবাই চললাম খাবার খেতে। পাশাপাশি সব দোকান। একটা দোকানে ঢুকে বসা গেল। পরোটা, রুটি দুই পাওয়া যাবে। আর একটু পর ভাত পাওয়া যাবে। আমাদের তাড়া আছে। তাই রুটি বা পরোটা যার যেটা ইচ্ছা খাবে। বেশির ভাগ ভোট রুটিতে পড়ল। বিকাশদা নিজেরটা বলেনি। খানিক বাদে বলল ভাত নেমে গিয়েছে। ভাতটাই খাই। দলে আরও দু’চার জনকে পেয়ে গেল। ভাত শুনে তারাও রুটি ছেড়ে ভাতে চলে এল। খেতে খেতে বিকাশদা বলল, ‘‘ভাত খাচ্ছ খাও। কিন্তু কাউকে বলার দরকার নেই বেড়াতে এসে সকালে টিফিনে ভাত খাচ্ছি।’’

ম্যাল রোড।

খাওয়া শেষে বিল মিটিয়ে দেখি বিকাশদা হাওয়া। রথীনদা বলল, ‘‘চলো গাড়িতে ওঠা যাক। বিকাশদা এসে যাবে। ও ভাত খেয়েছে। তাই হালকা হতে গিয়েছে। সব জায়গায় ঘুরতে গেলে এটা সাধারণ ব্যাপার ওর।’’ আমরা দু’টো গাড়িতে দু’টো দলে উঠে পড়লাম। তখন দেখি হেলতে দুলতে বিকাশদা এসে উপস্থিত।

গাড়ি চলছে আর প্রকৃতির পরিবর্তন টের পাচ্ছিলাম। বাজার, জনবসতি ছাড়িয়ে রাস্তার দু’ধারে গাছের সংখ্যা বাড়ছিল। দু’পাশে চায়ের বাগান চোখে পড়ছিল। শুকনা এলাকায় বিএসএফ এর ক্যাম্প চোখে পড়ল। বিএসএফ ক্যাম্পের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে শুরু হল টি এস্টেট। একটা ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল। আমাদের চালক সন্তোষদা জানালেন, ওটা বালাসন নদীর ব্রিজ। রাস্তার সমানে সমানে টয় ট্রেনের লাইনও চলছিল। প্রকৃতির বদল আরও ভাল বোঝা যাচ্ছিল। রাস্তার বাঁকের সংখ্যা বাড়ছে আর ইতিউতি পাহাড় চোখে পড়ছিল। তারপর এল মিরিক ভিউ পয়েন্ট। ভিউ পয়েন্ট থেকে ফেলে আসা রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। ফটোসেশন চলল কিছুক্ষণ। তারপর চললাম মিরিক লেকের উদ্দেশ্যে। সাজানো গোছানো একটা পার্ক আর লেক। তেমন কিছু বিশেষত্ব নেই। মিরিক লেকের উপর একটা সাঁকো পার হয়ে গেলাম অন্য পাশে। গাছগাছালি ঘেরা জায়গাটা বেশ ভাল লাগছিল। আস্তে আস্তে ঠান্ডা হাওয়া বাড়ছিল। সূর্যের দেখা সকাল থেকেই ছিল না। এখন তো মনে হচ্ছে, বৃষ্টি নামল বুঝি। এই আবহাওয়ায় চা ছাড়া কি জমে? চা খাওয়া হল একটা ছোট্ট ঝুপড়ি দোকানে।

আবার গাড়িতে বসা। এবার চলেছি একটা চা বাগান দেখতে। গোপালধারা টি এস্টেট। বাগান তো বন্ধ। বাইরে থেকে দেখা গেল। তারপর সোজা বিদেশ চলে গেলাম। মানে সীমান্ত পেরিয়ে নেপালে পা রাখলাম। সুকিয়াপোখরির কাছে নেপাল সীমান্ত এলাকায়। বাজারটার নাম পশুপতিমার্কেট। কিউরিও, ড্রাই ফ্রুট আর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে রঙিন জল। প্রবেশপথে সিকিউরিটি চেকপোস্ট আছে। ওখানে পরিচয়পত্র দেখে ছাড়া হচ্ছে। ওখানে ঘুরে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল লেপচাজগৎ। কিন্তু ঘোরার নেশায় কারও খিদের কথা মনে ছিল না। কচিকাঁচাগুলো দিব্যি ঘুরে ছবি তুলে চলেছে। শেষে পরিকল্পনা কিছুটা পালটে খাবার জন্য গাড়ি ছোটানো হল। প্রায় ৩০ মিনিট চলে গাড়ি পৌঁছল সান্টাবান্টা রেস্তরাঁয়। ও হ্যাঁ রাস্তায় এক ঝলক টয় ট্রেনের দেখা পেলাম। ব্যাটা আমাদের ফাঁকি দিয়ে এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তা ধসের কারণে ঘুম থেকে দার্জিলিং অবধি চলছে।

ঘুম স্টেশন।

ভাত আর চিকেন কষা অর্ডার করা হয়েছে। কিন্তু খাবার আর আসে না। এতক্ষণ খিদে মালুম হয়নি। এখন মনে হচ্ছে যা দেবে তাই খেয়ে নেব। আবার দেরি হলে বাতাসিয়া লুপে টয় ট্রেনের সঙ্গে ছবি তোলা হবে না। খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি, আবহাওয়া পুরো পাল্টে গিয়েছে। দারুণ ঠান্ডা। ঝটপট গরম জামা পরে গাড়িতে বসা গেল। টিকিট কেটে ঢুকলাম বাতাসিয়া লুপে। আর ট্রেনও ঢুকল। বেশ ভিড় করে লোকজন ছবি তুলছেন। গার্ডবাবুদের মন তো গার্ডভ্যানের দিকে যাবেই। তাই আমরা গার্ডসাহেবের খোঁজে গেলাম। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। এ ট্রেনে তো গার্ড নেই।

ঘুম মনাস্ট্রি।

অনেকক্ষণ পোজ দিয়ে অবশেষে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে গেলেন হিমালয়ের রানি। আমরা আরও খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম লুপে। দূরের পাহাড়ের কোলে আস্তে আস্তে জোনাকির মতো আলো জ্বলে উঠছে। ক্যামেরা বাগিয়ে শাটার টিপলাম। কিন্তু ফাঁকা আওয়াজ। ছবি উঠল না! ক্যামেরা দেখাচ্ছে মেমোরি ফুল! সফরের শুরুতে এ কী বিড়ম্বনা। দেবাশিসের দৈব বাণী কানে বাজছে। গাড়িতে উঠলাম। আজকের মতো ঘোরা শেষ। এবার হোটেলে পৌঁছব। কাল সকালে বেরনো হবে। আর সন্ধ্যা বেলা ম্যালে হাঁটাহাঁটি করতে বেরোব।

পিস প্যাগোডা

ঘরে ঢুকে সারাদিনের শেষে বিছানা টানছিল। কিন্তু এখন শুয়ে পড়লে আর সন্ধের বেড়ানো বা রাতের খাওয়া কিছুই হবে না। তাই গিজারের গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ম্যাল রোডেই আমাদের হোটেল। হোটেল অপ্সরা। হেঁটে বেরোলাম। বেরিয়ে ছিলাম একসঙ্গেই। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দল ভেঙে গেল। যাবে না কেন। এ তো পুরো মাছের বাজারের মতো ভিড়। দোকানগুলোতে ভিড় হয়েছে নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাটের। খানিক এদিক সেদিক ঘুরে মোমো খেয়ে শীতের জিনিসের দরদাম করে রাতের খাবার খেয়ে সোজা হোটেলের ঘর। তখন বিকাশদার নির্দেশ এল, কাল ভোরে উঠতে হবে না। আবহাওয়ার কারণে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে না। তাই একটু দেরিতে বেরোনো হবে।

লামহাটা।

পরদিন সকালে ৮টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম ঘুম মনাস্ট্রির উদ্দেশ্যে। বলা হয়নি, ক্যামেরার মেমোরি ইতিমধ্যে খালি করেছি ফোনে। তাই আজ মেজাজ ফুরফুরে। হেঁটে কিছুক্ষণের মধ্যে এসে গেলাম ঘুম স্টেশন। স্টেশনের পিছনেই মনাস্ট্রি। খানিক বাদে আবার ফিরে চললাম ম্যালের দিকে। রাস্তায় যেতে যেতে লক্ষ করলাম, গাড়ি করে রাস্তা ভেজাতে এসেছে। কাল সন্ধ্যায়ও দেখেছি। কারণটা জানি না। এখন বেশ ভাল করে খেয়ে বেরনো হবে। সবাই মিলে ঢুকলাম এখানকার ঐতিহ্যবাহী কেভেন্টার্সে। তারপর… যাকে বলে হেভি ব্রেকফাস্ট সেটাই হল। সসেজ, স্যান্ডউইচ সহযোগে সে একএলাহি ব্যাপার। আর সবশেষে দার্জিলিং চা তো আছেই। আমি ভাবছিলাম এখানে বিকাশদা ভাতের খোঁজ না করে বসে।

তিনচুলে।

খাওয়া শেষে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে হোটেল ছেড়ে দেওয়া হল। সন্তোষদা আর রুমবাদা হাজির।আজ গন্তব্য লামাহাটা। কিন্তু আজ রাস্তায় খুব জ্যাম। গাড়ি চলছে খুব ধীরে। তাই আমরা একটু হেঁটে এগিয়ে পিসপ্যাগোডাতে পৌঁছলাম। পাইন গাছে ঘেরা বৌদ্ধমন্দির। চারপাশে ঘুরে ছবি তোলা হল‌। এক খুদে মা বাবার সঙ্গে ঘুরতে এসেছে। তার দাবি ছবি তুলতে হবে। শুধু ছবি তুললেই হবে না। সেই ছবি তাকে দেখাতে হল। তবে আমরা ছাড় পেলাম।

কমলালেবু বাগান।

আবার গাড়িতে। রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে লামাহাটা পৌঁছলাম। পাইন গাছের বনে ঘেরা অঞ্চল। কিছুটা রাস্তা হেঁটে উপরে গেলে একটা জলাশয় আছে। যাত্রা শুরুর আগে একটু চা পানের বিরতি। চা খেতে খেতে লক্ষ এক করলাম, আমাদের দলের এক বৌদি কাপে চুমুক দিচ্ছে আর রুমাল দিয়ে কাপের কানা মুছছে। কী ব্যাপার জানতে চাইলে শোনা গেল কাল কেভেন্টার্সে চা খেতে গিয়ে কার মুখে বৌদি শুনেছে কাপে লিপস্টিক লেগে থাকলে জরিমানা হবে। তাই এই সাবধানতা।

টিংলিং ভিউ পয়েন্ট। মিরিকে।

পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গিয়েছে। সেই রাস্তা দিয়ে উপরে পৌঁছনো গেল। একটা ঝিল আছে। সুন্দর পরিবেশ। খানিকক্ষণ বসে নামা শুরু হল। ওঠার থেকে নামা কঠিন হয়। তাই নামতে বেশি সময় লাগল। নেমে সামনের একটা হোটেলে খাওয়াদাওয়া করতে ঢোকা হল। ভাত, ডাল, স্কোয়াশের তরকারি, পাঁপড় আর ঝাল ঝাল আচার। খাওয়াদাওয়া সেরে আবার চলল গাড়ি। এবার যাব তাকদা পেশক আর তিনচুলে।

পেশক ভিউ পয়েন্ট থেকে।

তিনচুলে পৌঁছে আমরা সবাই আত্মহারা। ইঁট, কাঠ পাথর আর ভিড় পেরিয়ে প্রকৃতির কাছাকাছি। এই কারণে দার্জিলিং ছেড়ে আজ চটকপুর, সিলেরিগাঁওয়ের মতো জায়গাগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। কারণ এখন দার্জিলিংয়ের ম্যাল রোড আর তার আশপাশ অনেক ঘিঞ্জি। মনের আশ মিটিয়ে ছবি তুলেছি। কিন্তু তখন কি জানতাম আবার ক্যামেরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

যাক দুঃখের কথা থাক। তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট থেকে আমরা চললাম কমলালেবুর বাগানে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি এরকম অনেক বাগান এদিকে আছে। আর তার সঙ্গে হোম স্টে তো আছেই। কমলা বাগানে লেবু আছে। কিন্তু সেরকম চাহিদা নেই। তাই বাগানে যত্নের অভাব। বিকেল হয়ে আসছে তাই ঝটপট গাড়িতে ওঠা গেল। লাভার্স মিট ভিউ পয়েন্ট। আহা কী দেখিলাম। পাহাড়ের সারি আর নীচে বয়ে চলেছে তিস্তা। আমাদের গন্তব্য আজ ওখানে শেষ হবে। নদীর পাড়েই আজ রাত্রি যাপন। ওখান থেকে দেখার পর মনে হচ্ছিল কতক্ষণে পৌঁছব। মোটামুটি আধঘণ্টা গাড়ি করে পৌঁছলাম ত্রিবেণী। আমাদের ক্যাম্পের ব্যবস্থা করেছেন পালিয়া আ্যডভেঞ্চার গ্রুপ।

ত্রিবেণীতে বার বি কিউ।

জানা গেল, আমাদের দরকারি জিনিসপত্র একটা ব্যাগে নিয়ে বাকি জিনিস ক্যাম্প অফিসে জমা রাখতে হবে। সেই মতো জিনিস গুছিয়ে চললাম। গোটা এলাকায় আরও অনেক সংস্থা আর তাদের টেন্ট। আমাদের ছটা টেন্ট পাশাপাশি একদম নদীর সামনেই। সামনে পিছনে পাহাড়। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিস্তা। পাশ থেকে এসে যোগ দিয়েছে রঙ্গিত। টেন্ট চুলোয় যাক। এই নদীর পাড়েই আমি রাত কাটিয়ে দিতে পারি। কতক্ষণ চুপচাপ শুধু বসেছিলাম। শুধু নদীর জলের আওয়াজ। সময় যেন এখানে এসে থমকে গিয়েছে। রথীনদা এসে পাশে বসল। বলল, এই পরিবেশে নিজেকে আদিম ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে।

ক্যাম্পের লোক এসে কাঠ সাজাতে শুরু করল। বার্বিকিউ হবে। বার্বিকিউ খেতে খেতে ভাবছিলাম, কোনও টেস্ট ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দিন। দু’দিন ম্যাচের রাশ যারা রাখতে পারে তারাই সাধারণত ম্যাচ নিয়ে যায়। আমাদের সফরের দ্বিতীয় দিন পুরো জমে গিয়েছে।

তিস্তা পারে ক্যাম্পের বাসিন্দারা।

রাতের মেনু একদম সাধারণ। ভাত, ডাল, কপির তরকারি আর মুরগির মাংস। দারুণ রান্নার হাত। চেটেপুটে খেলাম। খেয়ে ক্যাম্প অফিসে গেলাম। ক্যাম্প চালান যে দাদা তার সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। জানালেন বর্ষার সময় ক্যাম্প পুরো বন্ধ থাকে। বাকি সময় খুব ভিড় হয়। ওঁদের ক্যাম্প চলছে প্রায় ২৫ বছর ধরে। এখন আরও অনেক সংস্হা হয়েছে। ওঁদেরটা অনেক পুরানো। অতিমারিতে এক বছরের বেশি সব কিছু বন্ধ ছিল। এখন আবার মানুষ আসছেন।

গাড়িচালক সন্তোষদা।

টেন্টে ফিরে এসে দেখলাম, জল বাড়ছে নদীতে। ভাবলাম রাতে যদি জল বেড়ে আমাদের টেন্টগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

অনেক রাতে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। সব চুপচাপ। শুধু একটানা নদীর কুলকুল বয়ে চলার শব্দ। কী মনে হল, টেন্টের চেন খুলে বাইরে তাকালাম। চাঁদের আলোতে তিস্তা বয়ে চলেছে। জল আরও অনেকটা বেড়েছে। দূরে জঙ্গলে তাকিয়ে মনে হল, একটা ভালুক বা একটা লেপার্ড যদি নেমে আসে নদীতে জল খেতে।

ঘুম স্টেশন থেকে তোলা ছবি।

ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। ধুপধুপ করে শব্দ হচ্ছে। মনে হল মাটি কাঁপছে। কিছুক্ষণ পর বাইরে বেরোলাম। বালি ভিজে দেখলাম। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। আরও দু’একজন উঠে গিয়েছে। তারা বলল, একটু আগে মাটি কাঁপছিল। তখন বুঝলাম, আমার মনের ভুল নয়। ভূমিকম্প হয়েছে।

কভারের ছবি— লাভার্স মিট ভিউ পয়েন্ট থেকে ত্রিবেণী।

ছবি- রথীন সেন, বিকাশ সরকার ও লেখক

(আগামী সপ্তাহে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *