পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

আদি মানবের লালজলে গরবিনী ময়ূরী

দীপক দাস

‘‘ময়ূরগুলো আপনাদের চিনতে পারছে না। বাইরের লোক ভাবছে। ওই যে আপনারা প্যান্ট-জামা পরে আছেন।’’ বলছিলেন পথচারী এক প্রৌঢ়।

অবাক হয়ে গেলাম চারজন। গাড়ির চালক শিবু কতটা অবাক হল বোঝা গেল না। তবে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সেটা বুঝতে পেরেছি। কারণ শিবুই প্রথমে ‘মোর’, ‘মোর’ চিৎকারে আমাদের শেষ বিকেলের ঝিমিয়ে পড়া সফরটাকে আবার চাঙ্গা করে তুলেছে।

কিন্তু ময়ূরের এ কী স্বভাব! রাজনীতিতে বহিরাগত তত্ত্ব খুব খায়। তা বলে সহজ সরল বন্যপ্রাণ এমন করে হেনস্থা করবে? একটু আঁতে লাগে। জিজ্ঞাসা করি, ‘‘আপনাকে কী করে বুঝল আপনি এলাকার লোক?’’ প্রৌঢ় জবাব দিলেন, ‘‘আমি ধুতি পরে আছি। একটু আগে যে লোকটা গেল সে লুঙ্গি পরেছিল। আপনাদের জামাকাপড়েই তো বোঝা যাচ্ছে আপনারা বাইরের লোক।’’ জামাকাপড় দেখে ময়ূর বুঝছে না এই প্রৌঢ় বুঝছে, কে জানে? চুপ করে গিয়ে ময়ূর খুঁজতে শুরু করলাম। তখনই আবছা মনে পড়ল রাজহাটের উপেনদাও ময়ূরের এই বহিরাগত তত্ত্বটা বলেছিলেন। হুগলির রাজহাটেও খোলা জায়গায় ময়ূর দেখা যায়। সেই ময়ূরগুলোকে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন উপেন কল্লা। আমরা একবার ময়ূর দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু উনি বলেছিলেন, ওরা কিন্তু আপনাদের দেখছে। বুঝতে পারছে বাইরের লোক এসেছে।’’

লালজল গ্রাম।

এবার আমরা ঝাড়গ্রামে। না ঠিক ঝাড়গ্রামে নয়। পুজোর সময়ে গিয়েছিলাম বাঁকুড়ার ঝিলিমিলি। সেখানে গিয়ে দেখি, আমরা তিন জেলার সীমানায় হাজির হয়েছি। পুরুলিয়া হয়ে গিয়েছে। সফরের শেষ ভাগে এসেছি লালজলে। আদিম মানবের গুহা দেখতে।

লালজলে কেন এলাম? অনেক কারণ। প্রথমত, জঙ্গলমহলের রূপ কখনও একঘেঁয়ে হয় না। আমরা প্রতি বছরই বেরোই। প্রতি বছরই নতুন করে প্রকৃতিকে খুঁজে পাই। নতুন নতুন রূপে। ঝাড়গ্রাম আগের বছরেই এসেছিলাম। বেলপাহাড়ি থেকে ঝাড়খণ্ডের ঝাঁটিঝর্না পর্যন্ত ঘুরেছি। মুগ্ধ হয়েছি। এবার আবার হলাম। তা ছাড়া আদিম মানবের গুহা একটা বড় আকর্ষণ তো বটেই। আমরা নরম গদি, আলো, পাখা, চেয়ার টেবিলে অভ্যস্ত উত্তর পুরুষেরা একবার দেখব না আদি পুরুষেরা কেমন করে, কোথায় জীবন কাটাতেন!

সেই পাহাড় প্রতিষ্ঠার বোর্ড।

লালজল এলাকায় ঢুকতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। দু’দিন ধরে টানা যাত্রা চলেছে। শরীর একটু ক্লান্ত ছিল। কিন্তু এলাকা চাঙ্গা করে দিল। মেঠো রাস্তা। বাড়িঘরের বালাই নেই। দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাড়া। রাস্তার চারপাশেই প্রচুর গাছপালা, জঙ্গল। দূরে প্রচুর গাছপালা ভরা শ্যামল পাহাড়। একটা জায়গায় ছোট ডোবা মতো দেখলাম। তাতে মাছ আছে বোঝা গেল। জলে অনেক বাঁশ ডগলা দেওয়া। দেখালাম বাবলাকে। ওর মতোই মেছুড়েদের ঠেকাতে বাঁশ দেওয়া। যাতে কেউ জাল ফেলে মাছ ধরতে না পারে। বাবলা বলল, ‘‘আমি জাল ফেলি না। ছিপে মাছ ধরি।’’

লালজল পাহাড়ের পাদদেশের আগে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। বোর্ডে লেখা ‘লালজল দেবী পাহাড়, প্রতিষ্ঠাতা রামস্বরূপ দেবশর্মা’। কোনও পাহাড় কেউ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন? খোদার উপরে খোদকারি করা রামস্বরূপ কে? ওখানে খোঁজ মেলেনি। পরে গুগলের শরণাপন্ন হওয়া গেল। আনন্দবাজারে ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটা লেখা পেলাম। লেখকের নাম নেই। নিজস্ব সংবাদদাতা দেওয়া। তবে ছবি তুলিয়ে লোকটার নাম পরিচিত। আমারই সহকর্মী দেবরাজদা (ঘোষ)। তার মানে লিখেছে কিংশুকদা (গুপ্ত)। দুই ঝাড়গ্রামবাসী সহকর্মীর জেলাকে গৌরবান্বিত করা প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, রামস্বরূপ এলাকার কিংবদন্তি সন্ন্যাসী। আগে লালজলে চিতাবাঘ ছিল। রামস্বরূপ নাকি চিতাবাঘের সঙ্গে ওই গুহায় থাকতেন। তিনি ১৯৮৩ সালে লালজলে বাসন্তী পুজো চালু করেন। বাসন্তী পুজোর সময়ে এখানে পাঁচদিনের মেলা বসে। ’৯৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে দেওপাহাড়ের কোলে সমাধি দেওয়া হয়।

পাহাড়ে ওঠার পথ। সব পথটা এমন ধাপের মতো নয়।

বুঝলাম বোর্ডে লেখা লালজলদেবী পাহাড়ের প্রকৃত নাম দেওপাহাড়। রামস্বরূপ ও এলাকাবাসীর কল্যাণে তা লালজলদেবীর নাম ধরেছে। ধর্মের অপার মহিমা। যদিও দেওপাহাড়ের সঙ্গেও ভক্তিই জুড়ে। নিশ্চয় দেও শব্দটার দেব থেকে উৎপত্তি।

আমরা একটি মন্দিরের পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। অল্প কিছুটা উঠেই ইন্দ্র থেমে গেল। ওর দম শেষ। বরাবরই দেখেছি, ছেলেটা মোটেও উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়। উঁচুতে উঠতে বললেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। সফরে বারবার ঘটে। ও নাকি আবার ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট। এত কম দমে কী ভাবে লড়ে কে জানে! ও বোধহয় আর্জেন্তিনা দলের মতো। সমতলে দারুণ খেলে। আর বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং ম্যাচে বলিভিয়ার সঙ্গে পড়লে প্রতি বছরই ভোগায়। বলিভিয়ার সঙ্গে ম্যাচটা যে স্টেডিয়ামে হয় সেটা নাকি অনেক উচ্চতায়।

এটাই শেষ চেষ্টা ইন্দ্রকুমারের। তার পর উল্টো পথে।

ইন্দ্রকে রেখে বাবলা, আমি আর দীপু পাহাড় বাইতে শুরু করলাম। আমাদেরও যে প্রচুর দম, তা নয়। মাসটা অক্টোবর বটে। কিন্তু ভীষণ গরম। আগেই ঘামছিলাম। এই জংলা এলাকা, তার উপর পাহাড় চড়ায় ঘেমেনেয়ে একসা। কিন্তু চড়া থামাইনি। গুরুবাক্য অমান্য করেই উঠছি। গুরু মানে শিব্রাম চকরবরতী। তিনি মোটেও পাহাড় চড়তে ভালবাসতেন না। বলতেন কী হবে উঠে! সেই তো নেমে আসতে হবে। কথাটা ঠিক। উঁচুতে ওঠার জন্য হাঁকপাক করার মানেই নেই। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি সহজে যাওয়ার?

একটা ধাপ, দু’টো ধাপ করে অনেকটা উঠলাম। কিন্তু গুহা কোথায়? বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই এদিক ওদিক, এর-ওর ঘাড়ে অবিন্যস্ত সাজানো। এভাবেই বহু বছর ধরে রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে ক্ষয়েছে। কিন্তু রয়ে গিয়েছে। এরকম একটা পাথরের চাতাল ছিল। যার শেষের অংশটা শূন্যে ঝুলছে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখা হল। চারদিকেই পাহাড়। রানিপাহাড়, সিংলহর পাহাড়, নাম সব।

এই সব প্রস্তর খণ্ডকে সাক্ষী রেখে উঠছি আমরা।

গুহা খুঁজে না পেয়ে আবার চড়াই শুরু। খুব কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ একটু উঁচুতে কী যেন একটা নড়ে উঠল। দীপু ইশারায় চুপ করতে বলল আমাদের। তিনজনেই থেমে গেলাম। শুনেছি এখানে বুনো জন্তু আছে। হুড়াল থাকতে পারে। মানে ভারতীয় নেকড়ে। রামস্বরূপ সাধুর চিতাবাঘের কোনও বংশধর যদি লুকিয়ে থেকে যায়? ইন্দ্রটাও নেই যে একটা ফাইট দেবে! আমরা তিনজনে মিলে কাবু করতে পারব? এখন জিতলেও আঁচড় কামড়ে যে ক্ষত তৈরি হবে তার চিকিৎসা করাতে যে দেরি হবে ততক্ষণে বিষিয়ে যাবে ক্ষত। না হলে জলাতঙ্ক। বেশিক্ষণ ভয় পেতে হল না। পাহাড়ের উপর দিকে থেকে একটা ছাগল ছানা তিড়িং তিড়িং করে নাচতে নাচতে নেমে এল। আমাদের পাত্তা না দিয়েই নীচের দিকে নেমে গেল।

আমরা ‘ধুস ছাগল’ বলে আবার উঠতে শুরু করলাম। উঠতে উঠতে একেবারে শীর্ষে। আমরা তিনজনে যে চাতালটায় গিয়ে থামলাম সেটাই পাহাড়ের শীর্ষ পাথর। দূরে শুধু সবুজ আর সবুজ। পাহাড়ের মাথায় ঘন জঙ্গল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি গাছের মাথার সমান সমান হয়ে। সে এক আশ্চর্য অনুভূতি। কত রকম ভাবেই যে ছবি তোলা হল। কত পোজে। নামতে ইচ্ছে করছিল না। এদিকে বিকেল গড়িয়েছে। এবার নামা উচিত। তার পর গুহাটা খুঁজতে হবে।

শীর্ষজয়ী দুই সিংহবালক।

পাহাড়ে ওঠা আর নামার আলাদা আলাদা সমস্যা। উঠতে গেলে হাঁফ ধরে। নামতে গেলে হড়কে পড়ার ভয়। ধীরে ধীরে নেমে এলাম সেই চাতালটার কাছে। ওর কাছেই একটা সুড়ঙ্গ মতো। আমরা সাব্যস্ত করলাম, এটাই আদি মানবের গুহা। কিন্তু গুহার মুখ এতটা সরু কেন? আমাদের পূর্বপুরুষেরা কি আকারে ছোট ছিলেন? এ মুখ দিয়ে তো ছোটা ডন বাবলাই শুধু ঢুকতে পারবে। দীপু আর বাবলা বোঝাল, হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভিতরে গিয়ে বড় জায়গা। এরকমই আশ্রয় খুঁজত তখন। যাতে একটা লোক গুহার মুখে দাঁড়ালেই বুনো জন্তু বা শত্রুদের রুখে দিতে পারে।

শীর্ষ সেলফি।

দুই গুহা বিশারদের কথা মেনে নিয়ে নামতে শুরু করলাম। ঢোকার চেষ্টা করে লাভ নেই। ঝিলিঝিলি ছাড়িয়ে পোড়াডির যে হোটেলে আমরা উঠেছিলাম তার মালিক মনোরঞ্জনদা গুহায় ঢুকতে বারণ করেছিলেন। সাপ থাকতে পারে। ঝাড়গ্রামে রক পাইথন বেরোয় মাঝে মাঝেই। একবার পেঁচিয়ে ধরলে আমার দম আটকে যাবে।…

শীর্ষ থেকে দূর দিগন্ত।

নীচে ইন্দ্র নেই। ও তখন গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে চারপাশের ছবি তুলছে। ইন্দ্র একটা আশ্চর্য জিনিস দেখাল আমাদের। একটা নলকূপ মাটিতে পোঁতা। জল বেরনোর নলের সঙ্গে মাটির আধ বিঘত তফাৎ নেই। হ্যান্ডেল মাটিতে ঠেকে যাবে। এমন কবর দেওয়া কলের জন্য সরকারকে প্রচুর গালাগাল করে আমাদের বোতলে জল ভরলাম। তার পর এদিক সেদিকে ঘোরা শুরু হল। একটু দূরে মাঠে কিছুজন চাষ করছেন। সামনে শীতকাল আসছে। খেজুর গাছগুলো ছুলে রসের জন্য তৈরি করা শুরু হয়েছে দেখলাম। দু’টো সাইকেল গেল। গুহার পাদদেশের মন্দির থেকে একজন লম্ফ জ্বেলে বেরোলেন। ওই জায়গাটা অন্ধকার।

আদি মানবের গুহা।

কিংশুকদার লেখা থেকেই জেনেছি, লালজল এক আদিম সভ্যতা বুকে বয়ে নিয়ে চলা এলাকা। এখানে আদি প্রস্তর থেকে লৌহ প্রস্তর যুগের নমুনা মিলেছিল। সেসব ভারতীয় জাদুঘর এবং দিল্লির জওহরলাল নেহরু মিউজিয়ামে রাখা আছে। এখন ডিজিটাল যুগ। তার কোনও নমুনা আমরা অবশ্য এলাকায় দেখেনি।

সেই আশ্চর্য নলকূপ।

এবার ফেরার পালা। গাড়িতে বসে বুনো জন্তু দেখতে না পাওয়ার বরাবরের দুর্ভাগ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম, কত যুগ ধরে এলাকাটা প্রকৃতিকে আগলে রেখেছে। সভ্যতার একেকটা পর্বের চিহ্ন নিয়ে টিকে আছে। ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ আমাদের গাড়িচালক ভাই শিবুর ‘মোর মোর’ চিৎকারে তন্দ্রা ছুটল। প্রথমে মোর-শব্দের মানে বুঝতে পারিনি। শিবু বলেই চলেছে, দু’টো মোর রাস্তা পার করল। এবার বুঝলাম, ময়ূর। দ্রুত গাড়ি থেকে নামলাম। তখনই একটা উড়ে রাস্তার একপাশ থেকে আরেক পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল। আমরাও খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। আর তখনই বহিরাগত তত্ত্ব নিয়ে সেই প্রৌঢ় হাজির। জানালেন, একটু আগে তিনি তিনটে ময়ূরকে চরতে দেখেছেন।

এমনই সুন্দর গ্রামখানি।

ইন্দ্র জঙ্গলে ঢুকতে চাইছিল। বলেছিলাম ও সমতলে ভাল খেলে। কিন্তু অচেনা জায়গায়, সন্ধের আগে জঙ্গলে ঢুকতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। তা ছাড়া বুনোপ্রাণীদের বিরক্ত করা ঠিক নয়। সেটা নিয়ম বিরুদ্ধ। তাই গাড়িতে উঠলাম। এখানে বহু প্রাণ সেই আদি মানবের যুগ থেকেই রয়েছে।…কিছুটা এগিয়েছি। হঠাৎ দীপু বলল, ‘‘ওই তো ময়ূর।’’ তাকিয়ে দেখি, পাশের ধান খেতে একটা ময়ূরী। ডিনার সারছে। শিবু গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। তার পর ছবি তোলা শুরু হল। ময়ূরীর কোনও হেলদোল নেই। সে ঘাড় উঁচিয়ে খেতে ব্যস্ত।

সেই তিনি।

ময়ূরী তো! প্রবল গর্বিত। প্রকৃতির এই এক অদ্ভুত নিয়ম। সকল বন্য স্ত্রীজাতি অহং সর্বস্ব! নির্বিকার।

ছবি— দীপু, ইন্দ্র

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *