অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

চিংড়ি আর নদের পারে ক্ষণিক জীবন

দীপক দাস

ছিপ নিয়ে বসেছিলেন লোকটা। সে আর এমন কী দৃশ্য। আমাদের বাড়ির পাশের পুকুরের দিকে তাকালে প্রতিদিনই দেখা যায় কেউ না কেউ ছিপ হাতে ঘাটে বসে। বর্ষার জল জমলে বড় রাস্তার পাশে খালেও দেখা যায় বঁড়শেলদের। তফাৎ একটাই, লোকটা নদীর পারে বসেছিলেন। নদী নয়, নদ। দামোদর।

তফাৎ আরও ছিল। সেটা নজরে এল যখন লোকটার পাশে মাছ রাখার প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগটা দেখলাম। তাতে চারটে চিংড়ি। আকারে খারাপ নয়। এই আকারের মাছ জ্যান্ত বাজারে এলে চারশো টাকার নীচে দাঁড়িতে তুলবে না মাছওয়ালা। তার উপর নদীর, ইয়ে নদের, টাটকা চিংড়ি। সার নেই, মাথায় সিসা জমে কালচে ভাব নেই ঝকঝক করছে চিংড়ির শরীর। আমাদের ভাল লাগল। দাঁড়িয়ে গেলাম।

ধরা পড়েছে একটি।

ছিপে চিংড়ি ধরা দেখিনি কখনও। কুঁড়োজালি করে পুকুরে একসময়ে প্রচুর চিংড়ি ধরেছি। হাতে করেও। মাটির বাড়ি। টালির চাল। কাঠামো বদল করতে হয় বাঁশ খারাপ হয়ে গেলে। কাঁচা বাঁশ শক্ত করতে পুকুরে ভিজিয়ে রাখতে হয় কয়েকদিন। সেই সময়ের ফাঁকে চিংড়ি বাসা করে ফেলে বাঁশের ফাঁকে। বাঁশ তোলার সময়ে ধরা যায়। সন্ধেবেলায় পাড়ের কাছে চলে আসে। তখন পুকুরের জল ছিল স্বচ্ছ। লম্ফ বা টর্চের আলোয় জলের নীচে দেখা যেত পোকাগুলোকে। উঠে আসত জলে ডোবা ঘাটের পৈঠেয়। দু’চারটে ধরে শুঁড় ছাড়িয়ে তরকারিতে ছেড়ে দিলে সেই ব্যঞ্জনের স্বাদ বদলে যেত। কিন্তু ছিপে? লোকটাকে আশ্চর্য ক্ষমতাধর বলে মনে হল।

সবুজ সমুদ্রের মাঝে।

একদিন বেরিয়েছিল আমাদের দল। কাজ নিয়েই। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই প্রকৃতি এসে ধরা দিচ্ছিল আমাদের কাছে। কিংবা পরমা প্রকৃতির দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছিলাম আমরা। গিয়েছিলাম উদয়নারায়ণপুর ব্লকের কানুপাট-মনশুকার দিকে। নারায়ণচক থেকে একটা রাস্তা কানুপাটের দিকে গিয়েছে। সামনের পাড়াটা ছাড়ালেই বিস্তীর্ণ মাঠ। সে মাঠে আশ্চর্য আশ্চর্য সব দৃশ্যের অবতারণা। রাস্তার মাঝে বেশ উঁচু একটা সাঁকো। সংলগ্ন রাস্তার কিছুটা অংশ তখনও কাঁচা। বৃষ্টির জল পেয়ে কাদা হয়েছে। বাইক নিয়ে ওঠাটা ঝুঁকির। তাই আমরা চারজনেই হেঁটে উঠলাম। ইন্দ্র আর দীপু বাইক ঠেলে। আমি আর রাজা হেঁটে। সাঁকোয় উঠেই নজরে এল দৃশ্যটা। এক চাষি মাথায় ধানের চারা নিয়ে আলপথে হেঁটে চলেছেন। যেদিকে তিনি এগিয়ে চলেছেন সেদিকে সার দেওয়া তিনটি সৌর প্যানেল। মাঠে বর্ষার জলে বোনা ধানের কচি চারা, সৌর প্যানেল আর চারা মাথায় চাষি আশ্চর্য ভাললাগার এক চিত্রকল্প তৈরি করেছিল। সৌর প্যানেলের আধুনিকতা আর চাষের প্রাচীনতা মিলেমিশে কী রকম যেন প্রভাব ফেলেছিল মনে।

সেই শেয়াল।

সৌর প্যানেলের ডান পাশের চিত্রকল্পের সৌন্দর্যও কম নয়। আদিগন্ত চাষের জমির সবুজের সমুদ্র। তার মাঝে মাঝে মাথা তুলেছে তাল গাছ। চাষের জমিকে সমুদ্র কল্পনা করলে তালগাছগুলোকে নানা কিছু ভাবা যেতে পারে। জাহাজের মাস্তুল। কোনওটা লাইট হাউস। মাঠের মাঝে গাছগাছালি ঘেরা একটা দু’টো বাড়ি। তারা যেন এক একটা দ্বীপ। সৌর প্যানেলগুলো কীসের জন্য? সাঁকোর সামনের খালে একটা বাচ্চা ছেলে ছিপে মাছ ধরছিল। জিজ্ঞাসা করা হল তাকে। বলল, জল তোলার জন্য। মানে জমিতে জলসেচের কাজে লাগে।

মধুমক্ষিকার ফেলে যাওয়া চাক।

বাইকে এগিয়ে গেলাম পুরপাটের দিকে। আশ্চর্য ঝিম ধরা সৌন্দর্য গ্রামগুলোয়। টুকরো টুকরো নানা দৃশ্য কুড়োতে কুড়োতে এগোচ্ছিলাম। সে দৃশ্যে মানুষ, প্রাণী, প্রকৃতি মিলেমিশে তৈরি। রাস্তায় একটা লোককে গন্তব্য জিজ্ঞাসা করেছিলাম। লোকটি রাস্তার পাশে পাটকাঠি গুছোচ্ছিলেন। অবাক করা তাঁর শরীর। হাতের গুলি বড় মুখী কচুর মতো ফুলে উঠেছে। পায়ের ডিমগুলো আমেরিকান রুইয়ের পেটের মতো। শরীরের প্রতিটি পেশির সদ্ব্যবহার হয়, দেখেই বোঝা যায়। কোনও পেশি বসে খায় না। কাজ করে। লোকটির দেহশ্রী চোখে পড়েছিল ইন্দ্রও। ও বলল, ‘এ সবই হল খাটুন্তে শরীর। জিমটিম লাগে না। সারাদিন মাঠে খাটে। ডাক্তারও দেখাতে হয় না।’’

আখ-বক-চাষের ক্যানভাস।

কিছুটা এগিয়ে গিয়েছি, দীপু আর রাজার চোখে পড়ল একটা শিয়াল। দুই পাট খেতের মাঝের আলে বসে আছে। দু’টো কুকুর রাস্তার উপর থেকে শিয়ালটাকে দেখছে। কিন্তু আওয়াজ বা তাড়া, কিছুই করছে না। জায়গাটা নির্জন। তাই শিয়াল নির্ভয়। ইন্দ্র বাইক থেকে নেমে ছবি তুলতে শুরু করল। ভাল ভাবে ছবি নেওয়ার জন্য একটু এগোতেই সাহসী শিয়াল পাটখেতে সেঁধিয়ে গেল। আমরাও বাইকে। একটা খোঁজের দরকার ছিল। সামনেই একটা পাড়ায় ঢোকার রাস্তা। রাস্তার মুখেই একটা ক্লাব। কাছেই একটা বিশাল বটগাছ। গাছের উঁচু ডালে প্রমাণ আকারের মৌচাক। চাকে কি মৌমাছি আছে? রেডিয়ো হাতে একজন আসছিলেন। তিনি জানালেন, এখন উড়ে চলে গিয়েছে। তিল ফুল ফুটলে আবার ফিরে আসবে সব।

সেই শ্মশান।

যত এগোচ্ছিলাম ততই মুগ্ধ করছিল প্রকৃতি। একেক রূপে সামনে চলে আসছিল। সেই রূপের সৃষ্টি হয়েছে তুচ্ছ কোনও কারণে। এক জায়গায় মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা আঁকাবাঁকা। পাকা রাস্তা। সর্পিল কালো পিচের রাস্তা আর বাঁকে বাঁকে সবুজ ধান জমি, বর্ষার জল দিয়ে প্রকৃতি নিজে নিজেই ছবি এঁকেছে। আরেকটু এগিয়ে আরেক ল্যান্ডস্কেপ। একটা আখের জমি। কয়েকটা করে আখগাছ জড়ো করে উপরের দিকে বাঁধা। তাতে আখপাতাগুলোকে ঝুঁটির মতো দেখাচ্ছে। এরকম বন্ধনই আখ চাষের রীতি। আখের জমিতে ট্রাক্টর দিচ্ছেন একজন। ট্রাক্টরের কারণে জমির পোকাগুলো বাস হারা। নিশ্চয় উড়ছে সেসব। কারণ অনেকগুলো বক ট্রাক্টরের কাছাকাছি উড়ছে, বসছে, ঘুরছে। ওই পোকাগুলোয় উদরপূর্তি করছে। দূরে ধান জমিতে কিছু হাঁসের নড়াচড়া। কাছের পাড়ার পোষা হাঁস সেসব।

ভরা দামোদর।

এসব দেখতে দেখতেই বাঁধের রাস্তা ধরে নারায়ণচকে ফিরলাম, আবার। বাঁধের রাস্তার দু’ধারে তাকালেই বোঝা যায় এলাকাটা ডুবো জায়গায়। দামোদর ‘দুখের নদ’ ছিল। এখনও সুযোগ পেলে সে এলাকার মানুষজনকে কাঁদায়।

নারায়ণচকে একটা শ্মশান আছে। দামোদরের কোল ঘেঁষেই। শ্মশান বললেই কেমন যেন গা ছমছমে অনুভূতি হয়। এ শ্মশানে ঢুকতেই মনটা সুন্দর এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। স্নিগ্ধ পরিবেশ। প্রচুর গাছগাছালি। বেশ কিছু মহীরুহ হয়ে উঠেছে। গাছে প্রচুর পাখি। নানা ধরনের। টিয়া, বউ কথা কও, বুলবুলিদের দেখতে পেলাম। শ্মশানের শেষপ্রান্তে একটা ঝুঁকে পড়া বটগাছ। ডালপালার ফাঁক দিয়ে দামোদরের বয়ে চলা দেখতে বেশ সুন্দর লাগছিল। শ্মশানভূমি দামোদর গর্ভ থেকে বেশ উঁচুতে। সম্ভবত বর্ষায় দাহকাজে অসুবিধা যাতে না হয় তার ব্যবস্থা। শ্মশানের আরেক প্রান্তে বাঁশ ঝাড়ও রয়েছে। রাজা আগেই সেখান দিয়ে নদের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। আমরাও নামলাম।

গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা দামোদর।

দেখা হয়ে গেল চিংড়ি ধরা লোকটার সঙ্গে। তাঁর প্যাকেটে তখন চারটে চিংড়ি। গল্পগাছা শুরু করেছিলাম আমরা। লোকটির পরিবারের সদস্য তিনজন। স্বামী-স্ত্রী আর এক ছেলে। তাহলে চারটে চিংড়ি হয়ে গেল যে! লোকটি বললেন, ‘‘একটা সন্ধেবেলাতেই ছেলেকে ভেজে দিতে হবে।’’ আমরা বলে রাখলাম, এবার ছিপে চিংড়ি খেলে যেন বঁড়শি থেকে না খুলে আমাদের ডাকেন। বঁড়শি গাঁথা চিংড়ি দেখতে চাই। তার পর আমরা দামোদর দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠা দামোদর। জল পাক খেতে খেতে চলেছে। সেই পাক থেকে মাঝে মাঝে খলবল করে উঠছে জলের আওয়াজ। সেই আওয়াজ শুনে ইন্দ্র হঠাৎ বলে উঠল, ‘‘ঘাই মারছে।’’ সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রশ্ন, ‘‘কী দেখে?’’ ও তখন প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিচ্ছিল। দামোদরের পাক খাওয়া জলের আওয়াজকে ভেবেছে মাছ ঘাই দিচ্ছে।

দূরে সেই চিংড়ি ধরা লোকটি।

হঠাৎ চিংড়ি ধরা লোকটার ডাক শুনলাম, ‘‘উঠেছে উঠেছে।’’ আরেকটা চিংড়ি। তাহলে যে পাঁচটা হয়ে গেল? দু’টো করে ভাগ করলে একজনের একটা কম পড়বে। জিজ্ঞাসা করা হয়নি লোকটাকে, কার পাতে একটা চিংড়ি কম পড়বে? বুঝতে পারছিলাম, সন্ধে হওয়ার পর্যন্ত লোকটি চিংড়ি ধরবেন। যতগুলো হয়। এখানে জীবন বড় ধীর লয়ে চলে। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। সময় কাটাতে কেউ আড্ডা মারে। যেমন শ্মশানের সিমেন্টের বসার জায়গায় আড্ডা জমিয়েছে টিউশন ফেরত কতগুলো ছেলে। বড়টা সুভাষ চকের হাটতলায় আড্ডা দিচ্ছেন, দেখেছি। ইনি চিংড়ি ধরছেন। নদীর ওপার আরেকজন।

দামোদর শুধু বয়ে যায় আপন মনে। ঋতু ভেদে শীর্ণ-স্ফীত হতে হতে।

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ, দীপশেখর দাস

কভারের ছবি— সৌর প্যানেল আর চাষি।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *