ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

কুলগাছিয়ার পুতুল পাড়ার আত্মীয় স্বজনেরা

দীপক দাস

সোশ্যাল পাড়ায় সংবাদটা মিলেছিল। মাটির পুতুল তৈরি হয় কুলগাছিয়ার এক গ্রামে। চণ্ডীপুরের পটুয়াপাড়ায়। পুতুল নিয়ে ইদানীং আগ্রহ বেড়েছে। পুতুলেরও ইতিহাস থাকে যে! অনেক পরত সেই ইতিহাসের। উৎসের ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস, কালের ধারায় বিবর্তন— কত কী যে জানা যায়!

খোঁজ যখন মিলেছে তখন খবর নেওয়াটা কর্তব্য। অবশ্য কর্তব্যবোধ জাগার পিছনে দীপুবাবুর অনুপ্রেরণা ছিল। আমাদের বটানিবাবু, মিস্টার ঘাসপুস। এক মঙ্গলবার ইনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। বেরোবেই। কোথাও না কোথাও। অতিমারিতে অনেকদিন বেরনো হয়নি। গ্রুপের সদস্যরা সকলেই এখন অমল। কিন্তু দইওয়ালার দেখা নেই। তাই নিজেদেরই মুক্তির বাতাস আনা দইওয়ালার খোঁজের চেষ্টা।

পটুয়া পাড়ায় তৈরি হচ্ছে বিশ্বকর্মার মূর্তি। কুলগাছিয়া, চণ্ডীপুর।

পুতুল পাড়ায় যাওয়াই সিদ্ধান্ত হল। বাগনানে অন্য খোঁজখবরের দরকার ছিল। সেখান থেকে কুলগাছিয়া আর কত দূর! এক মঙ্গলবার চেপে বসলাম দীপুর বাইকে। বাগনান থেকে কুলগাছিয়া পৌঁছতে সমস্যা হল না। রেলস্টেশন পেরিয়ে এগনো চণ্ডীপুরের দিকে। ফাঁকা স্টেশন। হাওড়া-খড়্গপুর শাখার ব্যস্ত লাইনের স্টেশন কুলগাছিয়া। করোনা অতিমারির ধাক্কায় ‘শূন্য তা’। স্টেশন ঘেঁষা দোকান আর খাবারের ঠেলাগুলো শুধু জায়গার মান রেখেছে। আমরা সামনে অবশ্য রেলগেটের বাধা পেয়েছিলাম। কোনও স্পেশাল ট্রেন। এসি কোচের গেরামভারী আচরণ তার। আমাদের সামনে দিয়ে গমগম করে চলে গেল। আমরাও চায়ের দোকান, ফলের ঠেলা, পথচারীদের জিজ্ঞাসা করতে করতে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

চিনতে অসুবিধা হল না পটুয়াপাড়া। শনাক্তকরণের প্রকট বৈশিষ্ট্য নিয়ে পটুয়াপাড়া সামনে এল। বাড়ির সামনে সারি সারি অর্ধসমাপ্ত প্রতিমা। আকার দেখে বোঝা যায়, বিশ্বকর্মা। এরকমই এক বাড়ির দোরগোড়ায় বাইক থামাল দীপু। গৃহকর্তার নাম সোমদেব চিত্রকর। বছর পঁয়ষট্টির মানুষটি জানালেন, তাঁরা প্রতিমা শিল্পী। বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকেই। পুতুল তাঁরা তৈরি করেননি কখনও। প্রতিমা গড়ার বরাত নিয়ে কলকাতা বা ভিন রাজ্যে চলে যান। সবরকমের প্রতিমাই গড়েন। তা হলে কি সোশ্যাল পাড়ার খবর ভুল? সোমদেববাবু জানালেন, এই চণ্ডীপুরেই কুমোর পাড়ায় এখনও পুতুল তৈরি হয়। আর তৈরি হয় বামুনহাটিতে।

চণ্ডীপুরের পালপাড়ার হাতে টেপা পুতুল।

বাইকের মুখ আবার ঘুরল কুলগাছিয়ার দিকে। পটুয়াপাড়া থেকে কিছুটা আসতে হয়। রাস্তা থেকে পাড়া দেখা যায়। কিন্তু পাড়ায় ঢোকার রাস্তা একটু ঘুরে। পাড়ায় ঢুকে যাঁকে প্রথম জিজ্ঞাসা করলাম তাঁর বাড়িতেই পুতুল তৈরি হয়। ভদ্রলোকের নাম স্বপন পাল। স্বপনবাবুর বোন আর স্ত্রী পুতুল তৈরি করেন। উনি প্রথমে নিয়ে গেলেন বোনের বাড়ি। কিন্তু তাঁদের কাছে কোনও পুতুল নেই। রথের মেলায় বিক্রি হয়ে গিয়েছে সব। পুতুল মিলল স্বপনবাবুর স্ত্রী আলপনাদির কাছে। ভাঁড়ার থেকে দু’রকম পুতুল বার করলেন তিনি। বউ পুতুল আর টেপা পুতুল। বউ পুতুল বেশি ছিল না। স্মারক হিসেবে আমি আর দীপু একটা করে নিলাম। টেপা পুতুল এক জোড়া করে। তার পর পুকুর পাড়ে পণের পাশে দাঁড়িয়ে শুরু হল পুতুলের ইতিবৃত্ত জানা। পুতুল সাধারণত কুম্ভকার বাড়ির মেয়েরাই তৈরি করেন। মাটির হাঁড়ি, সরা, ঘটও তৈরি হয়। মেয়েরা সেসবও পারেন। আলপনাদির বাপের বাড়ি হাওড়া জেলারই আমতায়। বাপের বাড়িতেও পুতুল তৈরি হত। এখানেও তিনি তৈরি করেন।

চণ্ডীপুরের পাল পাড়ার বউ পুতুল।

কিন্তু শুধুই কি পুতুল তৈরি করেন তাঁরা? আলপনাদির সঙ্গে কথা বলার সময়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন স্বপনবাবুর দুই বোন, ছবি পাল আর মালতি পাল। মালতিদি কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তিনিই পুতুল তৈরি করেন। জানা গেল, এই কুমোর পাড়ায় বউ পুতুল বা টেপা পুতুল ছাড়াও তৈরি হয় বাচ্চাদের খেলার নানা উপকরণ। হাঁড়ি, কলসি, শিল-নোড়া, বালতি, ফ্যান ঝড়ানোর গামলা। ছোট আকারের সব। আর তৈরি হয় মাটির পালকি, চাকা লাগানো নৌকা। আলপনাদির কাছে এগুলো আবার ছিল না। তাই আবার আসতে হল মালতিদিদের বাড়িতে। আমি আর দীপু এক জোড়া করে নিলাম খেলনাবাটি, পালকি, চাকা লাগানো নৌকা।

মাটির পুতুলের এখনকার অবস্থা কী রকম? শিল্পীরা জানালেন, ভাল বিক্রি হয়। রথের মেলায় প্রতি বছর তাঁরা পুতুলের পসরা নিয়ে বসেন। বাড়ি থেকেও কিছু বিক্রি হয়। ভাল বিক্রি হয় কথাটা বেশ আশা জাগাল। মাটির জিনিসের খোঁজখবরে কখনও এমন আশার কথা শুনিনি। তবে হতাশার কথাও আছে। সেটা পুতুলের ভবিষ্যৎ। নতুন প্রজন্ম কেউ এ কাজে আগ্রহী নন। আলপনাদির ছেলে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করেন। তিনি পারিবারিক পেশায় আসতে চান না। পটুয়া পাড়ার সোমদেববাবু বলছিলেন, চণ্ডীপুরের বামুনহাটিতে মাটির পুতুল তৈরি করেন কয়েকজন। সে কথা জিজ্ঞাসা করাতে আলপনাদি বললেন, তাঁরা বামুনহাটিরই লোক। কয়েক পুরুষ আগে এখানে উঠে এসেছেন। বামুনহাটিতে যাঁদের কথা সোমদেববাবু বলেছেন আপলনাদিরা তাঁদের পরিবারেরই বৃহত্তর শাখা। বামুনহাটির আত্মীয়রাও পুতুল তৈরি ছেড়েছেন।

মাটির তৈরি বাচ্চাদের খেলনার নানা উপকরণ। কুলগাছিয়া, চণ্ডীপুর।

চণ্ডীপুরের কুমোরপাড়ার পুতুল কী ধরনের? তারাপদ সাঁতরা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে কুম্ভকারদের পুতুল তৈরির নিজস্ব ঘরানা রয়েছে। এই কুমোরপাড়ার পুতুল সেই ঘরানার। হাতে টেপা পুতুল অনেক জেলার কুমোরেরাই তৈরি করেন। এখন অবশ্য তৈরিতে বদল এসেছে। ছাঁচ ব্যবহার করছেন আলপনাদিরা। জানালেন, ছাঁচে তৈরি হলেও ‘ফিনিশিং’ দেওয়ার কাজ হাতেই হয়।

পুতুলের গল্প শোনা। (বাঁদিক থেকে) স্বপনবাবু, আলপনাদি, মালতিদি আর ছবিদি।

চণ্ডীপুরের পুতুলের সঙ্গে আমাদের পাতিহালের কুমোরদের তৈরি পুতুলের কিছু মিল পেলাম। পাতিহালের কুমোরারাও টেপা পুতুল তৈরি করেন। একসময়ে পালকি, চাকা লাগানো নৌকা তৈরি করতেন। সেই সঙ্গে তৈরি করতেন চাকা লাগানো হাতি, ঘোড়াও। এখন শুধু হাতে টেপা পুতুলই তৈরি হয়। আর তৈরি হয় মাটির ঘোড়া। মূলত পাতিহালের গুমোরাজ আর মুন্সিরহাটের ফতে আলির দরগায় উৎসর্গ করার জন্য। কিছু বিক্রি হয় বাচ্চাদের খেলনা হিসেবে। চণ্ডীপুরের মতো পাতিহালেও মেয়েরাই মাটির পুতুলের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। দু’জায়গাতেই নতুন প্রজন্ম মাটির কাজে আগ্রহী নন। দু’জায়গাতেই ছাঁচের ব্যবহার চালু হয়েছে।

পাতিহালের পুষ্প পালের তৈরি পুতুল, পালকি ও নৌকা।

চণ্ডীপুরের পুতুলের সঙ্গে পাতিহালের পুতুলের আত্মীয়তা খুঁজে পেয়ে বেশ আনন্দই হল। কিন্তু আরেকটি আত্মীয়তা সূত্র অভাবনীয় ভাবে আবিষ্কার হয়েছিল সেদিন। আলপনাদি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমরা কোথা থেকে আসছি? পাতিহাল শুনে বললেন, ওখানকার কুমোরপাড়ায় যাঁদের রেশন দোকান আছে তাঁদের কাউকে চিনি কিনা। অবশ্যই চিনি। চিনিদেরই তো রেশন দোকান। চিনি মানে অভিজিৎ পাল। আমাদের গ্রুপের সদস্য। ওর ডাকনামটা ওদের রেশন দোকানের চিনির জন্যই। বন্ধুদের দেওয়া উপহার। চিনির আমাদের সঙ্গে সেদিন বেরনোর কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেনি। আলপনাদি জানালেন, চিনির এক মাসির মেয়ে তিনি।

পুতুল ও শিল্পী, উভয়ের সঙ্গেই আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হল।

ছবি— দীপশেখর দাস ওরফে দীপু

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *