সফর।
জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

নির্জন সৈকত দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুরে

ইন্দ্রজিৎ সাউ

কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজটা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর। নাহ শুনতে আর বলতে যতটা সহজ লাগল ব্যপারটা মোটেই ভিনি ভিডি ভিসি নয়। সময়ে বেরনো নিয়ে বরাবরই আমার একটা ‘সুনাম’ আছে। নিন্দকেরা অবশ্য দুর্নাম বলে থাকে। যতই চেষ্টা করি কোনও না কোনও অজ্ঞাত কারণে দেরি হয়ে যায় প্রায়শই।

কিন্তু এবারে দেরি হয়নি। প্রায় ঠিক সময়ে হাজির সুব্রতর কাছে। বাইচুং আর দিব্যেন্দু আগে থেকে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে। গিয়ে দেখি, সুব্রত তখনও গভীর নিদ্রায়। বহু ডাকাডাকিতেও কোনও সাড়া শব্দ নেই। এদিকে বাবুর ফোনও সুইচ অফ। শেষে ওর দিদি ডেকে তোলে। উঠেই বলল, ‘‘তুই দেরি করিস তাই উঠিনি।’’ ওকে সবার শেষে ডেকে তুলব, এটা আগে থেকেই ঠিক ছিল। কারণ আগের দিনই ডায়লিসিস করে ফিরেছে। এভাবেই আজ প্রায় বছর চারেক চলছে।…

ধীরে ধীরে ধীবর পল্লি পার করে।

রানিহাটি থেকে হাইওয়ে ধরে নন্দকুমার-কাঁথি বাইপাস হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম কাঁথি। মাঝে কোলাঘাটে জলযোগের জন্য আর এক জায়গায় বৃষ্টির জন্য বেশ খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাঁথি মোড় ঘুরেই আমি চালু করলাম গুগল ম্যাপ। দেখেই তো সুব্রত রেগে কাঁই। কারণ নেভিগেটর হিসাবে আমি প্রায় কলম্বাস। আজ পর্যন্ত গুগল ম্যাপ দেখে ভুল হয়নি এ রকম খুব কম জায়গাই আছে। তাই ও খেপে গিয়ে বলল, ‘‘তোকে কিছু করতে হবে না, আমি রাস্তা জানি।’’

প্রকৃতির খেয়ালে আঁকা ছবি।

একদম তাই। যখনই ওর সঙ্গে কোথাও যাই চোখ বন্ধ করে যাওয়া যায়। কারণ ও পুরো পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ খোঁজ নিয়ে তবেই বেরোয়। আমি কি ওর কথা থোড়াই পাত্তা দেওয়ার ছেলে? কোনওদিন কারও কথায় দিয়েছি! না হলে ঘুরতে বেরোলেই লোকে কেন আমার উপরে খেপে যায়? ধরলাম গুগল দেখানো রাস্তা। জাতীয় সড়ক ছেড়ে বাঁদিকে সাবাজপুর পৌঁছে গেলাম সমুদ্রপুর। মাত্র কয়েক কিলোমিটার। কিন্তু যা রাস্তা! দেখে আক্কেলগুড়ুম। ওই রাস্তা দিয়ে বাইক যাবে না। ভাল হলে খুব কাছেই হত আমাদের গন্তব্য।

বীথি।

অগত্যা আমরা ফিরে আসছি আগের রাস্তা ধরব। বাইচুং পিছনে ছিল। এসে দেখি ও চুপ করে দাঁড়িয়ে। পিছনের সিট খোলা আর দিব্যেন্দু ওখানে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। আমরা কিছু বলার আগেই বাইচুং বলল বাইক স্টার্ট নিচ্ছে না। নতুন বাইক ডমিনোর ২৫০ বিএস-সিক্স। এ বাইকের আমরা কেউ কিছুই বুঝি না। তবুও আমাদের বাইকের সীমিত জ্ঞান নিয়ে ঠিক করার মরিয়া চেষ্টা চলল। হতোদ্যম হয়ে আমি আর সুব্রত বেড়িয়ে পড়লাম মেকানিক খুঁজতে।

কেউ কোত্থাও নেই।

জায়গাটা প্রত্যন্ত গ্রাম। একটাই বাজার আসার সময় দেখে এসেছি। ওখানে এসে একটা গ্যারেজ দেখতে পেলাম। কিন্তু উনি যাবেন না। বাজারে আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কিছু দূরে আর একটা গ্যারাজ আছে। গিয়ে দেখলাম একটি অল্প বয়সি ছেলে। আমাদের গাড়ি আর তার সমস্যা বলতেই সে-ও যেতে অস্বীকার করল। অবশ্য কারণটা সঙ্গত। এই নতুন বাইকের সম্পর্কে প্রশিক্ষিত মেকানিক ছাড়া কেউ জানে না। তবুও এক প্রকার জোর করে তুলে নিয়ে গেলাম। কিন্তু সে-ও অনেক চেষ্টা করেও প্রথমে স্টার্ট করতে পারল না। হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে সে একটা ফিউজ খুলে নতুন করে লাগাল আর আমি সেলফ দিতেই বাইক বাবাজি স্বমহিমায়। আমরা সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ছেলেটি আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দিল। আমরা অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আর পারিশ্রমিক দিয়ে আমাদের গন্তব্যে এগিয়ে চললাম।

আমার তিন সঙ্গী।

এতক্ষণ টেনশনে আমরা কেউ খেয়াল করিনি জায়গাটা এত সুন্দর। বেশ কিছু চিংড়ির ভেড়ি সবুজ ধান, চাষের মাঠ, প্রচুর গাছ আর পাখির কলতান। কিন্তু টেনশনে ছবি তোলার কথা কারও মাথাতেই আসেনি। একটা নাম না জানা নদীর বাঁধ বরাবর এগিয়ে গিয়ে ইছাবনি দিয়ে আবার জাতীয় সড়ক ধরলাম। এবারে আর কোনও ভুল নয়। চাউলখোলা হয়ে মন্দারমণির দিকে।

এই সৌন্দর্যের বর্ণনার সাধ্য কী আমার!

আসলে দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর জায়গাটা মন্দারমণি যাওয়ার মুখ থেকে বাঁদিকে দেড় কিলোমিটারের একটু বেশি। ঢোকার সময়ই দেখলাম বেশ কিছু হোগলার ঘর। যত এগোতে থাকলাম তত ছবির মতো মনে হতে থাকল আশেপাশের প্রকৃতি।

গিয়ে উঠলাম শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির বিবেকানন্দ মঠের অথিতি নিবাসে। আমরা আগে থেকেই মহারাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে গিয়েছিলাম। আমরা যখন সমুদ্রপুরে আটকে ছিলাম তখন উনি অনেকবার ফোন করেছিলেন আমাদের বিলম্ব দেখে। করোনা-কালের আগেই আমরা এই জায়গারটার সন্ধান পেয়েছিলাম। এবং জায়গাটার আসাধারণ সৌন্দর্য সম্পর্কে শুনেছিলাম। এতটুকুও মিথ্যা নয়। এ কোনও তৈরি করা পর্যটনকেন্দ্র নয়। নিজের সৌন্দর্যেই পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে কোনও সময়ে। লোকমুখে ছড়িয়েছে জায়গাটির অসাধারণ সৌন্দর্যের কথা। ছবিই তার প্রমাণ।

সৈকতে লাল কাঁকড়ার পল্লি।

মহারাজকে আমাদের করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজের শংসাপত্র দিয়েই উদর পূর্তি করে নিলাম। রসদ আমাদের সঙ্গেই ছিল। তার পর সমুদ্রের দিকে দৌড়। আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগের প্রথম বোল্ডারহীন একদম সমতল নিউদিঘাকে যেন পেলাম। সঙ্গে বাড়তি পাওনা একটা গোটা দ্বীপে আমরা ছাড়া কেউ নেই।

জাল বোনার কাজ চলছে।

এক দেড় ঘণ্টা সমুদ্রে কাটিয়ে মঠে ফিরে এলাম। মুরগির ঝোল দিয়ে দুপুরের তোফা আহারাদি সেরে ঘুম। বিকাল ৫টা নাগাদ বেরলাম আশপাশটা ঘুরতে। জায়গাটা পুরোটাই মৎস্যজীবীদের গ্রাম। সেই সঙ্গে খুব ভাল চাষ হয়। গেলাম পাশেই মাছের আড়তে। মানে চাতালে। দেখলাম, ওখানে জাল সারাই চলছে। বেউটি জাল। ছোট ফাঁদের জাল। কথা বললাম রবীন্দ্রনাথ পাত্র আর সেখ ইনসানের সঙ্গে। এঁদের প্রধান জীবিকা মাছ ধরা আর কিছু চাষ। তবে তা বেশির ভাগটাই শীতের সময়। কারণ ওই সময় এঁরা যে মাছ ধরেন তা সবটাই শুঁটকি করেন। আর আমরা আসার সময় যে হোগলার ঘর দেখেছিলাম ওগুলো সবই শুঁটকির আড়ত। সন্ধ্যেয় একবার ফিরেছিলাম মঠে, রসদের জন্য। আবার সমুদ্রের পাড়ে। গিয়েই তো হতবাক। মোবাইলের আলোয় দেখি শয়ে শয়ে লাল কাঁকড়া ভর্তি। ওদের কোনও রকম বিরক্ত না করে আমরা চারজনে নোনা হাওয়া উপভোগ করতে লাগলাম।

কন্যাকে নিয়ে সমুদ্র তীরে।

পরদিন সকাল সাড়ে পাঁচটায় মঠের গেট খুলতেই আবার সমুদ্রে। আমরা কয়েকজন আর ধুধু চর ছাড়া কেউ কোত্থাও নেই। শুধু একজনকে দেখলাম মীন ধরতে। এক বাবা তাঁর কন্যাকে এনেছেন সমুদ্র দেখাতে। এখানে শুধু প্রকৃতি প্রকৃতি আর প্রকৃতি। সৌন্দর্য সৌন্দর্য আর সৌন্দর্য। এতটুকু অতিরিক্ততা নেই। যা বহু পর্যটন কেন্দ্রের চরিত্র নষ্টে সহায়ক হয়।

শুঁটকি মাছের আড়ত।

একটু বেলার দিকে গেলাম তাজপুর সি বিচে। কিন্তু রাস্তা ভীষণ খারাপ। জায়গাটাও সৌন্দর্যায়ন নামে আধুনিক কৃত্রিমতায় ভরে গিয়েছে। আমাদের কারওই ভাল লাগেনি। ফিরে এলাম পুরুষোত্তমপুর। পরদিন রাতে যখন সমুদ্র পাড়ে বসে আছি একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে আলাপ করলেন। সুকুমার বেরা স্থানীয় বাসিন্দা। এখানে আসা পর্যন্ত সুব্রত আমাকে বারবার বলছিল, এখানে যে চাষের জমি আছে সেই মাঠটা কোথায়। উনি আমাদের সেই কৌতূহল নিরসন করলেন। আমরা যে রাস্তা দিয়ে আসছি তার দু’পাশটাই চাষের জমি যা ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের দাপটে নোনা জল আর নোনা বালি ঢুকে ডোবায় পরিণত হয়েছে। তাই আমরা বুঝতে পারিনি।

জমিতে ভরেছে সমুদ্রের নোনজল।

ইয়াসের ক্ষত এখনও ছড়িয়ে চারিদিকে। বহু বাড়ির ভগ্নাংশ দেখেছি আমরা। নির্জন সৈকতের সৌন্দর্যে মন ভরেছে। এই ক্ষত থেকে কিছুটা মন খারাপ।

ছবি— লেখক

প্রচ্ছদের ছবি— মীন ধরার সরঞ্জাম

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *