অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ইতিউতি হাওড়ার জীবজগৎ— অষ্টম পর্ব

যথা ইচ্ছা তথা যা

১। চামচিকে

যেন কোনও ভয়ের সিনেমা।

ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচতে মশারির ভিতরে থেকে পড়াশোনা করছি। রাত তখন মধ্য বা গভীর। হঠাৎ অন্যরকম একটা আওয়াজে চটক লাগল। আওয়াজটা যেন কাছ থেকেই আসছে। ও বাবা! দেখি মশারির ছাদে ডানা মেলে শুয়ে আছেন তিনি। ছুঁতে না পেরে বোধহয় রাগ হয়েছিল বাবুর। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।

২। লার্ভা

তিনি আহারে মগ্ন।

পাতিহালের ফিডার রোড। ১০০ দিনের কাজের বরাতে পঞ্চায়েতের তরফে রাস্তার দু’পাশে বেশ কিছু গামার গাছ বসিয়েছে। গাছগুলো সবে আমার মাথা ছাড়িয়েছে বোধহয়। লক্ষ্য করলুম, গামার গাছের পাতাগুলো শতছিদ্র। বোঝা গেল, পাতাগুলো কোনও ক্ষুদ্র শাকাহারীর অত্যন্ত প্রিয় খাবার। শাকাহারীর খোঁজে ওৎ পেতে ছিলুম। একদিন দেখা মিলে গেল। কীসের লার্ভা বুঝতে পারিনি। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারীর সংযোজন— ‘ইনি যে সে লার্ভা নন, ইনি হলেন tortoise beetle এর লার্ভা। ইনি এক বিশেষ ধরনের বিটলে পরিণত হবেন’।

৩। মাছের খুশি

নানা মাছ। পাতিহালে।

প্রতি বছর বর্ষায় আমাদের বাড়ির পাশের মাঠে মাছ ওঠে। ভারী বৃষ্টি হলেই মাঠ জলে ভরে যায়। বাড়ির পাশের পুকুর টইটুম্বুর হয়। কই, ল্যাটা, শোল পুকুর থেকে লাফিয়ে জমিতে যাওয়ার চেষ্টা করে। আরেকটু বেশি বৃষ্টি হলে মাঠের সাঁকো দিয়ে জল যাওয়ার গতি বাড়ি। মাছেরা জলের তোড়ে দূরান্তে ভেসে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেউ কেউ জাল পাতে ওই সাঁকোয়। এ বছরের বর্ষায় তো প্রবল জলের স্রোত। ছাঁকনি জাল পেতেছিল পাশের পাড়ার একটি ছেলে। তার বালতিতে জমা মাছের ছবি তোলা গেল। বেশ কয়েক ধরনের মাছ। দু’টো মাছ দেখে খুব ভাল লাগল। একটা খলসে। আরেকটা পাঁকাল। পুকুরে প্রচুর পাঁকাল ছিল। সন্ধের পরে ধারে ধারে চলে আসত। এখন কমে গিয়েছে। আর ঘুনি দিয়ে কত খলসে মাছ ধরেছি একসময়। এখন বেশ কমে গিয়েছে মাছ দু’টো। বালতিতে পুঁটি আর তেলাপিয়াও ছিল। আরেকটা মাছও ছিল। যেটা চিনতে পারিনি। বালতির সামনের দিকে পাঁকাল মাছের সঙ্গে ল্যাজ ঠেকিয়ে থাকা মাছটা। দেখতে অনেকটা মৌরলা মাছের মতো। চেলা মাছ কি? নাকি মৌরলাই? (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।

৪। কাদাখোঁচা

কাদাখোঁচা পরিবার।

কিছুদিন আগে আমি আর দীপু বাইকে বাগনান যাচ্ছিলাম। আশা ছিল, আমতা-বাগনান পথে কিছু না কিছু পাখি মিলবে। অত জমি, গাছপালা, ফাঁকা মাঠ! আমতা ছাড়াতেই দেখি জলা জায়গাগুলো বর্ষার জলে ডুবে আছে। ওইরকমই এক জায়গায় একটা পাখি উড়ে এসে খালের কচুরপানায় বসল। অচেনাই লাগল। দু’জনে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করলাম। পাইনি। আমাদের বাড়ির পাশের মাঠেও একদিন বিকেলে ওই রকমই দু’টো পাখিকে উড়ে এসে জমিতে বসতে দেখেছিলাম। হাতে ক্যামেরা ছিলই। তক্কে তক্কে ছিলাম। কিন্তু সুবিধে হল না। জমিতে প্রচুর ঘাস। সে সবের ফাঁক দিয়ে শুধু মুণ্ডুটা দেখা যাচ্ছে। ক্যামেরা ফুল জুম করেও ভাল ছবি হল না। সেই ফাঁকে পাখিরা উড়ে আরেকটু দূরে ধান জমিতে গিয়ে বসল। সেই জমির কাছাকাছি যেতেই আবার উড়ান। অনুসরণ করলাম। অবশেষে ক্যামেরার জুমে বোঝা গেল পাখিটার অবয়ব। কিন্তু ভাল ছবি হচ্ছিল না। শেষে ঘেসো জমি ছেড়ে ধান জমিতে কর্তা-গিন্নি নামলেন। ক্যামেরায় ফুল জুমে মোটামুটি একটা ছবি এল। কাদাখোঁচা পাখির জোড়া। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)

৫। হলুদ মাথা মথ আর সবুজ মথ

হলুদ মাথা মথ।

লকডাউনে ঘর বন্দি হয়েছি। মাঠে যাওয়াও বন্ধ। ঘোরাঘুরিও আটকে। আমি অনেকদিন বাইরের কাউকে দেখিনি। বাইরের কেউও আমায় দেখেনি। কি বোর্ড আর কম্পিউটারের এলইডি পর্দাটাই এখন যেন একমাত্র বন্ধু। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মন ভাল করতে গভীর রাতে ওরা এল।

প্রথমদিন এল হলুদ মাথা মথটা। এসেই ঝুপ করে কম্পিউটারের উজ্জ্বল পর্দায় বসে পড়ল। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বোঝার চেষ্টা করল আমার মতিগতি। বিরক্ত হলুম না দেখে সেও খানিক আশ্বস্ত হল। জীবনের ভয় নেই বুঝে ঘরময় ওড়াওড়ি করতে লাগল। অনেকদিন পর আমিও একজন সঙ্গী পেলুম। লেগে পড়লুম বন্ধুত্ব পাতাতে। অনেক চেষ্টায় সফল হলুম। পরে খুশি হয়ে আমার মডেলও হল।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারীর সংযোজন— ‘এটি ট্রপিক্যাল টাইগার মথ (Asota cf caricae), যেকোনো ধরনের ডুমুর, বট জাতীয় গাছে এদের আস্তানা’।

ঝটপটে সবুজটি।

সবুজ মথটা এল কদিন পরে। হলুদ মথটা এসেছিল চুপিচুপি। এ এল জানান দিয়ে। সশব্দে। সোঁ করে এসেছিল। তার পরে শক্ত কিছুতে ধাক্কা লাগলে যেমন আওয়াজ হয় সেরকম আওয়াজ হল। কম্পিউটারে ধাক্কা মেরেছিল। বোধহয় হলুদ মথের কাছে খোঁজ নিয়েই এসেছিল। মাথার উপর দিয়ে রকেট গতিতে এসে ইনিও বসলেন কম্পিউটারের পর্দায়। ছবি তুলতে যেতেই সাঁই করে উড়ে পালালেন নাগালের বাইরে। খানিক পর আবার এলেন। ছবি তুলতে গেলুম আবার পালালেন। অনেকক্ষণ পর বন্ধুত্ব হল। এবার পোজ দিলেন। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারীর সংযোজন— সবুজটি একধরনের হক মথ। এরা একটু আকারে বড় আর শক্তপোক্ত হয়। নাম Green Pergesa Hawkmoth (Pergesa sp.)

৬। শামুকখোল

মাঠের শোভা। শামুকখোল।

আমাদের গ্রামে শামুকখোলের আনাগোনা বেশ বেড়েছে। আগে দু’একটা দেখতে পাওয়া যেত। সেই ফিডার রোডের আশপাশের জমিতে। এখন গ্রামের অনেক ভিতর দিকেও চলে এসেছে। ঝাঁক বেঁধে। দুপুরে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকালে একটা না একটা শামুকখোল উড়তে দেখা যায়। কিছুদিন আগে দুপুরে অভ্যাস মতো মাঠের দিকে যেতেই দেখি, এক ঝাঁক শামুকখোল বসে আছে জমিতে। ক্যামেরা ছিল না হাতে। ছুটে গিয়ে নিয়ে এলাম। একসঙ্গে পাঁচটা শামুকখোলের ছবি তোলা গেল। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)

৭। প্রজাপতি-ক

কী বাহার!

বাড়ির দরজার কাছে যেতেই বকুনি খেলুম। ‘‘কতবার বলেছি, এখানে এলে ক্যামেরা আনবি!’’ যথা ইচ্ছার ক্যাপ্টেন দীপকদা বকা দিল। প্রায় দু’মাস পর একটু বেরিয়েছিলুম আড্ডা দেব বলে। ভরদুপুরে ক্যাপ্টেনের এমন মেজাজ দেখে ঘাবড়ে গেলুম। ক্যাপ্টেনকে শান্ত করে ব্যাপারখানা বোঝার চেষ্টা করলুম। খুব সামান্য ব্যাপার। ক্যাপ্টেনের এক সুন্দরী প্রজাপতিকে মনে ধরেছে। তার ছবি চাই। আশ্বস্ত করলুম, এ সুন্দরীর ছবি তুলতে আমার মোবাইলই যথেষ্ট। একেবারে পোজ দিইয়ে ছবি তুলে দিয়েছিলুম। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারীর সংযোজন— এই প্রজাপতিটির নাম খাগড়া (Common mime). এদের বাংলা নাম হয়েছে এদের কাঠি আকৃতির পিউপার জন্য। আমাদের এখানে আবার এদের দুরকমের ফর্ম পাওয়া যায়। এটি ফর্ম ডিসিমিলিস। 

৮। প্রজাপতি-খ

মাটিতে বসেছিলেন তিনি।

ডানা মেললে উপরিভাগ কালো বলেই মনে হল। ডানা মুড়ে বসলে বাদামি কালো ছোপের প্রজাপতি। পুকুর পাড়ে হয়ে থাকা কচু পাতার উপরে উড়ছিল, বসছিল। তার পর হঠাৎ এসে বসল মাটিতে। ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম যদি ডানা মেলে! কিছুতেই মেলল না ডানা। কিন্তু এতক্ষণ ধরে মাটিতে বসে কী করছে প্রজাপতিটা? মাটিতে এতক্ষণ বসতে তো দেখিনি? ভাল করে লক্ষ্য করতে দেখলাম, শুঁড় বাড়িয়ে ধুলোয় উপরে বুলোচ্ছে। এ কেমন প্রজাপতি? জানি না। নামও নয়, এমন ব্যবহারও নয়। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারীর সংযোজন— এর নাম কমন পামফ্লাই। পাম জাতীয় গাছে জীবনচক্র সম্পন্ন করে বলে এরকম নাম।

৯। প্রজাপতি-গ

ডানায় চিহ্ন চোখের।

বেশ সুন্দর দেখতে। ছোটবেলায় যে রংটা ‘নস্যি কালার’ বলতাম সেই রকম ডানার রং। ডানার নীচের দিকে চোখের মতো গোলাকার ছোপ। উপরের দিকে লম্বাটে ছোপ। মাঠে রোজকারের পদচারণায় পেয়েছিলাম। একটা ফড়িংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বনতুলসির ঝোপের কাছে কচুপাতায় পাতায় বসেছিল। নট নড়নচড়ন। নাম জানি না। প্রজাপতি ইজ প্রজাপতি। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারীর সংযোজন— পিকক প্যান্সি, খুব সুন্দর দেখতে।

১০। লম্বা গলা বক

দম্পতি ব্যস্ত খাবারের জোগাড়ে।

বেশ কয়েক ধরনের বক দেখেছি পাতিহালের বিভিন্ন মাঠে। ছোট চেহারা। লম্বা গলা। মাথায় ঝুঁটি। কালো রঙের। মাথা-পিঠে বাদামি ছোপ। কিছু ছবি তুলেছি। একদিন লম্বা গলা এক জোড়াকে ধান জমিতে পেয়ে গেলাম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত গলা বাড়িয়ে খুঁটে খাচ্ছে। প্রজাপতির মতো বকেরও অনেক রকমফের আছে। আমি গো বক আর নাইট হেরনের নাম জানি। এই বক দম্পতির ছবির সঙ্গে আধার কার্ড লিঙ্ক করা নেই।

পরিবেশকর্মী তথা ‘হাওড়া জেলার প্রজাপতি’ ও ‘প্রেয়িং ম্যান্টিসদের কথা’ বই দু’টির অন্যতম লেখক সৌরভ দোয়ারীর সংযোজন— এটি ‘Little egret, বাংলায় অনেক নাম আছে। ছোট বক বা ছোট ধলা বকও বলে। এদের চেনার উপায় সাধারণত ঠোঁট হবে কালো আর গো বক হলে ঠোঁট হবে হলুদ। তবে এই সবের ব্যতিক্রমও আছে’।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *