বিভূতিভূষণের স্মৃতিধন্য।
অন্য সফর ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

একটি মিষ্টির দোকান ও বিভূতিভূষণের স্মৃতিপথ

দীপক দাস

খোঁজ শুরু হয়েছিল পান্তুয়ার। পথ গিয়ে মিলল ‘পথের কবি’র পদপ্রান্তে। তার পর তাঁর পদচিহ্ন ধরে সফরের আয়োজন। এ সফরের স্বাদ অনেক রকম। মিষ্টি, কষায়।

সফরের শুরুটা কিন্তু আকস্মিক। দলের সকলেই ব্যস্ত। একা একা ‘হেথা নয় অন্য কোথা’ করে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ একদিন দীপুবাবুর ফোন, ‘‘কচি আসবে। একটা জায়গা ঠিক করো। মঙ্গলবার বেরোব।’’ কচি মানে শুভ বৈদ্য। আমাদের গ্রুপের শহর শাখার সদস্য। ওই শাখাও প্রায় উঠতে বসেছে। শাখা-সদস্যরা ব্যস্ত ও দেশান্তরি। দুই শাখার অনেকদিন পরে যৌথ সফর হবে। ভেবেই মন খুশ।

জায়গা ঠিক হল। হুগলির জাঙ্গিপাড়া। প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসে সমৃদ্ধ। অল্প সময়ের মধ্যে হয়েও যাবে। এখন কোনও জায়গায় গেলে একটু খোঁজখবর আগে থেকে করার চেষ্টা করি। সেই খোঁজেই মিলল পান্তুয়া। জাঙ্গিপাড়ার পান্তুয়া নাকি বিখ্যাত ছিল। বলে গিয়েছেন সুধীরকুমার মিত্র। কিন্তু কোথায়, কোন দোকান কিছুর উল্লেখ নেই। সুতরাং পথই ভরসা। প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ জাঙ্গিপাড়া-কৃষ্ণনগরে। এক কৃষ্ণনাগরিক জানালেন, জাঙ্গিপাড়া বাজারে হাটুইদের দই আর দুর্গা মোদকের মিষ্টি ভাল।

দুর্গা মোদকের দোকানের পান্তুয়া।

বিস্তর সন্ধান করতে হয়নি। অল্প আয়াসেই জাঙ্গিপাড়া তিন মাথার মোড়ে। মোড়ের মাথাতেই হাটুইদের দোকান। পদবি শুনলেই মনে হয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কোনও হাসির গল্পের চরিত্র। দোকানের মালিক কমলাকান্ত হাটুইয়ের মুখখানাও বেশ হাসি হাসি। আমাদের কচির হাসিমুখের সঙ্গে বেশ মিল। দই তো খাব। কিন্তু তার আগে পান্তুয়ার পথটা জেনে নেওয়া যাক। প্রবীণ কমলাকান্তবাবু জাঙ্গিপাড়ার পান্তুয়ার খ্যাতির কথা কখনও শোনেননি জানালেন। তবে নিজেদের মিষ্টি নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তাঁদের দোকানের পান্তুয়া খেয়ে দেখতে বললেন। খেলাম এবং ভাল ভাল লাগল। ধীরে ধীরে কালাকাঁদ, মাখা সন্দেশ আর নিখুঁতিও চাখা হয়ে গেল। দীপু আর বাবলা, কচি প্রত্যেকেই ভাল বলল।

ভালর পরে মন্দ। সিনেমার আর জীবনের চিত্রনাট্যে অনিবার্য। টেরটি পেলাম। আমাদের আরও কয়েকটি জায়গায় যাওয়ার ছিল। দীপুর প্রস্তাব, ‘‘ফেরার পথে দই খাব। দুর্গা মোদকের মিষ্টির দোকানে যাব।’’ গণতান্ত্রিক দল। একজন ক্যাপ্টেন নামে থাকেন। কিন্তু ভোটে তিনি প্রায়ই কচুকাটা হন। ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমরা বাইকে এগিয়ে গেলাম। সফরে বেরিয়ে এ ভুল কখনও করা যায় না। চোখে ও চেখে দেখার যা কিছু হাতের কাছে এসে পড়ে তার যথাবিধি সদগতি করতে হয়। ফেরার পথে হাটুইদের দোকানে আবার ঢুকলাম। এবং কমলাকান্ত হাটুই হাসি হাসি মুখেই জানালেন, দই শেষ। দীপুর দিকে তাকানোর ইচ্ছে হল। দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে, দই-সই হতে না পারার দায় তোকেই নিতে হবে। সাহসে কুলিয়ে ওঠা গেল না। নতুন প্রজন্ম। ওদের হাতেই গ্রুপের ভবিষ্যৎ।

এখানেই ছিল মার্টিন রেলের জাঙ্গিপাড়া স্টেশন।

গুটি গুটি চাকায় দুর্গা মোদকের মিষ্টির দোকানে। তখনও ইচ্ছে, পান্তুয়া নিয়ে একটি তুলনামূলক সফরনামা সৃষ্টির। তাই পান্তুয়া খাওয়া ও নেওয়ার আয়োজন। বড় ভাল খেতে দুর্গা মোদকের পান্তুয়া। ভাল পান্তুয়ার যা গুণ, ছাল হবে গাঢ় খয়েরি। ভিতরের পুর সুন্দর নরম। আর তাতে রসের একটি খোঁদল। এ পান্তুয়া সেই গুণে গুণান্বিত। দোকানে ছিলেন সুদর্শন আর মাধব মোদক। দুর্গাবাবুর দুই ছেলে। বড় ভাই হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘‘বিভূতিভূষণ আমার দাদুর কাছে থাকতেন। এই দোকানের মিষ্টি খেতেন।’’ শুনে মনটা মিষ্টি হয়ে গেল। ভাল মিষ্টি জিভের স্পর্শে এলে মন যেমন ভাল হয়ে যায় সেরকম অনুভূতি। তিনি দেওয়ালের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, ‘‘আমার দাদু।’’ তাকালাম। হাতে আঁকা একটা সাদা-কালো ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। ছবির নীচে একটা ছড়া, ‘হাটের ফকির মোদক ময়রা মানুষ। মিষ্টি নিয়ে কারবার। বিভূতি মাস্টারের কথায়-বার্তায়, ব্যবহারে কী এক রসের সন্ধান পেয়েছিল সে’। একটা উদ্ধৃতি। এর উৎসের সন্ধানও দেওয়া রয়েছে ‘পথের কবি’, কিশলয় ঠাকুর।

পদ্মপুকুর। এখনকার অবস্থা।

এ বই আমার চেনা। যখন টিউশন করতাম তখন আমার ছাত্রী সঙ্গীতা ওর বাবার থেকে এনে বইটা পড়তে দিয়েছিল। সঙ্গীতার বাবা গণেশবাবু গ্রামে একটি গ্রন্থাগার চালান। কিন্তু বইটি ভাল করে পড়া হয়নি তখন। দুর্গাবাবুর বড় ছেলে বললেন, ‘‘‘পথের কবি’র ৮৪ পৃষ্ঠায় আছে দাদুর কথা।’’ আবার গণেশবাবুর শরণ। ‘পথের কবি’ পড়তে পড়তে পরতে পরতে রোমাঞ্চ। জাঙ্গিপাড়ার পথে পথে বিভূতিভূষণের স্মৃতিচিহ্ন ছড়ানো। সে চিহ্ন ধরেই তো একটা সফর সম্ভব।

তথ্যতল্লাশ শেষ হতে আবার দল পাকানো শুরু। দীপু এবার আর সময় দিতে পারবে না। কচি ফিরে গিয়েছে কর্মস্থল চেন্নাইয়ে। দ্বিচক্রযান চালনার ছাড়পত্র নেই আমার। বাবলা আমাকে বাইকে নিয়ে যাবে বলল। কাজকর্ম সামলে শেষ মুহূর্তে দ্বিতীয় সফরে যোগ দিল ইন্দ্র। বিভূতিভূষণ মার্টিন রেলে জাঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। তাই প্রথম কাজ হল মার্টিন রেলের চিহ্ন খোঁজা। সে জন্যই বাইক দাঁড় করিয়েছিলাম কৃষ্ণনগরে। সেই কৃষ্ণনগর যেখানে হাটুই আর দুর্গা মোদকের দোকানের সন্ধান পেয়েছিলাম।

বিভূতিভূষণ স্মৃতি ভবন।

কৃষ্ণনগরে দেখা হয়ে গেল সমীর চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাঁকে আগ্রহের বিষয়টি জানাতে তিনি বললেন, ‘‘বিভূতিভূষণ তো আমাদের বাড়িও এসেছিলেন।’’ কী সূত্রে? সমীরবাবুর ঠাকুরদা সতীশ চক্রবর্তী কলকাতা কর্পোরেশনে কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে বিভূতিভূষণের পরিচয় ছিল। দাদুর মুখে তিনি শুনেছেন, তাঁদের বাড়িতে কাউকে পড়াতে এসেছিলেন বিভূতিভূষণ। কথা বললে সূত্র মেলে। সমীরবাবু আরও কিছু সূত্র দিলেন। যেমন, কিছুটা দূরে কালীতলায় বিভূতিভূষণের নামে একটি সেবাকেন্দ্র হয়েছে। আর জাঙ্গিপাড়া ঢোকার আগে চন্দনপুরে মার্টিন রেলের কিছু চিহ্ন মিলতে পারে।

সেবাকেন্দ্র পেয়েছিলাম। কিন্তু অনেক খুঁজেও মার্টিন রেলের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাইনি। খোঁজাখুঁজি করতে করতে এক ভাল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি পান্নালাল বিশ্বাস। ঘুরে ঘুরে লটারির টিকিট বিক্রি করেন। তাঁর সঙ্গে শুরু হল বিভূতি-স্মৃতি পথে সফর। সফর শুরুর আগে জাঙ্গিপাড়ার সঙ্গে বিভূতিভূষণের যোগসূত্রটি একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

হাটুইদের দই।

সাহিত্যে আগ্রহীরা জানেন, জাঙ্গিপাড়া দ্বারকনাথ হাই স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। এলাকার ব্যবসায়ী মাখনলাল দে-র অর্থে নতুন তৈরি স্কুল। স্কুলটির অস্থায়ী প্রধান শিক্ষক ছিলেন বৃন্দাবন সিংহ রায়। জাঙ্গিপাড়ার কাছেই শ্রীরামপুরে বাড়ি ছিল তাঁর। বৃন্দাবনবাবু ছিলেন বিভূতিভূষণের ‘মেস-বন্ধু’। সেই সূত্রেই চাকরি। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সন্ধ্যায় জাঙ্গিপাড়ায় পৌঁছন বিভূতিভূষণ। তাঁকে দিতে এসেছিলেন বন্ধু ননীমাধব চক্রবর্তী। দু’জনে এসেছিলেন হাওড়া ময়দান থেকে মার্টিন রেলে। ‘জগৎবল্লভপুর, সীতাপুর, ইছানগরী, ডোমজুড়, প্রসাদপুর ছুঁয়ে ছুঁয়ে’। স্টেশনের নামগুলো একটু আগে পরে হয়ে গিয়েছে ‘পথের কবি’তে।

তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে একটা প্রশ্ন জাগে। জাঙ্গিপাড়া ক’বার এসেছিলেন বিভূতিভূষণ? ‘অভিযাত্রিক’এ বর্ণিত স্মৃতি ধরলে দু’বার। আর সেটা সম্ভবত স্কুলের শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার আগে। সঙ্গী ছিলেন নীরদ সি চৌধুরী। কোথাও বেরিয়ে পড়ার প্রণোদনায় নীরদ সি-র সঙ্গে তাঁর বেরিয়ে পড়া। হেমন্তকালের কোনও এক দিন বিকেলে ৩টের সময়ে তিনি নীরদ সি-কে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। আর ‘পথের কবি’তে স্কুলে যোগ দেওয়ার মাস বলা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারি। প্রথমবারের সফরেও তিনি একটি মিষ্টির দোকানে গিয়েছিলেন। নাম উল্লেখ করেননি। দোকানে দেখেছিলেন, ‘কলঙ্ক ধরা পেতলের থালায় সাজানো চিনির ডেলা সন্দেশ, তেলে-ভাজা, বাসি জিলিপি, কুচো গজা, চিঁড়ে মুড়কি আর বাতাসা’। গ্রামের দিকে মিষ্টির দোকানে এইধরনের মিষ্টির চলই ছিল বেশি। আর যেহেতু স্টেশন সংলগ্ন এবং বাজার এলাকা তাই বোধহয় জলখাবারের আয়োজনে তেলে ভাজা ছিল। দুর্গাবাবুর ছেলেরাও বলছিলেন, দাদুর আমলে তাঁদের দোকানে সন্দেশ, গজা, রসমুণ্ডি, রসকরা, মুড়কি থাকত। এগুলো বাংলার আদি মিষ্টি। ছানার আর রসের মিষ্টির ব্যাপক প্রচলন গ্রামাঞ্চলে তখন হয়নি অতটা।

অযোধ্যা পুল।

প্রথমবারের আগমনে এক পাঠশালার গুরুমশাইয়ের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। সেই গুরুমশাইয়ের সাতটি ছেলে মেয়ে। এক মেয়ে এক বছর আগে ম্যালেরিয়ায় মারা গিয়েছিলেন। জাঙ্গিপাড়ায় প্রকোপ ছিল প্রবল। ময়রা জানিয়েছিলেন, ‘ম্যালেরিয়ায় উচ্ছন্নে গেল সব বাবু…ভেতরে ঢুকে দেখুন কি অবস্থা গাঁয়ের’। কী অবস্থা তারই একটি প্রমাণ গুরুমশাইয়ের মেয়ের মৃত্যু। বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘বাংলায় ম্যালেরিয়া-বিধ্বস্ত দরিদ্র গ্রামের এমন একখানি ছবি সেই আসন্ন হেমন্তসন্ধ্যায় সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিলাম, যা চিরদিন আমার মনে আঁকা রয়ে গেল। ছবি নিরাশার, দু:খের অপরিসীম নি:সঙ্গতার ও একান্ত দারিদ্র্যের। সেই বনজঙ্গলে ভরা গ্রামখানির ওপর ধ্বংসের দেবতা যেন উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর করাল কালো ডানার ছায়ায় সারা গ্রাম অন্ধকার। আমাদের মন কেমন দমে গেল— যেন এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচি’। বিভূতিভূষণ গুরুমশাইয়ের নাম লেখেননি। তাঁর কিশোরী মেয়েকে একটি পত্রিকা পড়তে দিয়েছিলেন।

শিক্ষক বিভূতিভূষণ উঠলেন শশিভূষণ দীর্ঘাঙ্গির বাড়ি। তিনি ছিলেন স্কুলের সভাপতি। তাঁর বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া। ছেলে সমরেন্দ্রকে পড়ানো। কিন্তু পথে পথে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসেন তিনি। ফিরতে রাত হয়। গৃহস্থের বাড়িতে তো সব সময়ে বাঁধা। ফলে দীর্ঘাঙ্গি বাড়ি ছেড়ে তাঁকে উঠতে হল নৃসিংহ ডাক্তারের ডিসপেনসারি সংলগ্ন ঘরে। কিন্তু হোমিওপ্যাথিক ওষুধের গন্ধে ঘুম আসত না বিভূতিভূষণের। স্কুল ছুটির পরে ঘুরে বেড়াতেন। হাটের মধ্যে স্টেশন। রেললাইনের ওপারে একটি জলাশয়। নাম পদ্মপুকুর। তার বাঁধানো ঘাটে বসে থাকতেন চুপ করে। কোনওদিন চন্দনপুর, তারাজোলের মধ্যে দিয়ে আরও গ্রামের গভীরে। কখনও সন্ধেবেলা অযোধ্যা পুলের কাছে।

নৃসিংহ ডাক্তারের ওষুধের গন্ধে বাসা বদল করতে বাধ্য হলেন বিভূতিভূষণ। মাস্টারকে ভাল লাগত হাটের ফকির ময়রার। তাঁর দোকানের পাশেই একটি ঘর ছিল। ডাক্তারখানা ছেড়ে উঠলেন ফকির ময়রার ঘরে। নিজের মতো ঘুরে বেড়ানোর, থাকার সুযোগ বাড়ল। দুই ছাত্রও তাঁর সঙ্গে থাকতে এলেন। একজন গজেন মুখার্জি আরেকজন সতীশ চক্রবর্তী। গজেনের বাড়ি ভান্ডারহাটি। কিন্তু এই সতীশ চক্রবর্তী কি কৃষ্ণনগরের সমীর চক্রবর্তীর দাদু সতীশ চক্রবর্তী? যিনি কলকাতা কর্পোরেশনে কাজ করতেন? সমীরবাবু কী সূত্রে দাদুর সঙ্গে বিভূতিভূষণের পরিচয় তা বলতে পারেননি। শুধু বলতে পেরেছিলেন, একবার, দু’বার এসেছিলেন পড়াতে। পড়াতে নাকি ছাত্রের বাড়ি? ‘পথের কবি’ তা লেখেনি। শুধু লেখা, ‘সতীশের বাড়িও কিছুটা দূরে’। আর গজেনরা রান্না করে খাওয়াতেন বিভূতিভূষণকে। কখনও কখনও ফকির ময়রাই গরম দুধ-মুড়ি দিয়ে যেতেন।

ফকির ময়রা।

তবে জাঙ্গিপাড়া বাস বিভূতিভূষণের সুখের হয়নি। তিনি তখন পরলোকতত্ত্ব, প্ল্যানচেট করেন। একদিন কথায় কথায় বলে ফেললেন জনৈক ত্রিপুরাবাবুকে। তার পর স্কুলবাড়িতে প্ল্যানচেট। বন্ধু বৃন্দাবনবাবুও তাতে যোগ দিয়েছিলেন। ক্রমে কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গেল। শ্রীরামপুরের মহকুমা শাসকের কাছে লেখকের বিরুদ্ধে আবেদন জমা পড়ল। স্কুলে শুরু হল অন্য গোলমাল। কমিটির একটি অংশ স্থানীয় রাজকুমার ভড়কে প্রধান শিক্ষক চাইল। তিনি এমএ পাশ। বিভূতিভূষণ বিএ। এদিকে বৃন্দাবনবাবুও আইন পড়তে চান। ফলে রাজকুমার ভড় প্রধান শিক্ষক হলেন। কিছুদিন পরে নানা গোলমালে বিভূতিভূষণের চাকরি গেল। তিনি ছেড়ে চলে আসছিলেন। কিন্তু ছাত্ররা পথরোধ করে দাঁড়ান। তাঁরা স্কুল ত্যাগের হুমকি দেন। ছাত্র না থাকলে স্কুল উঠে যাবে। কমিটি বৃন্দাবনবাবুর কাছে গেল। তখনকার মতো রয়ে গেলেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু তার দু’মাস পরে ১৯২০ সালের ৮ মে জাঙ্গিপাড়া ছাড়লেন বিভূতিভূষণ।

এবার আমরা বিভূতি-স্মৃতিপথে ঘোরা শুরু করলাম। পান্নালালবাবু নিয়ে গেলেন পদ্মপুকুর দেখাতে। হাটের কাছেই। তবে পাড়টি এখন বড়ই নোংরা। তার পর নিয়ে গেলেন স্কুলে। স্কুলে বিভূতিভূষণের নামাঙ্কিত ভবন তৈরি হয়েছে ২০১৩ সালে। স্কুলের পাশেই একটি সরকারি গ্রন্থাগার। সেখানে দেখা হল শিক্ষক গৌরচন্দ্র কোলের সঙ্গে। দ্বারকানাথ স্কুলেরই শিক্ষক। এবং বিভূতিভূষণের ভক্ত। জনপদ নিয়ে গবেষণা করেন। গ্রন্থাগারে অনেকটা সময় কাটে তাঁর। গৌরবাবু জানালেন, স্কুলে লেখকের নামাঙ্কিত ভবন উদ্বোধনে এসেছিলেন বিভূতিভূষণের পুত্রবধূ, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী মিত্রাদেবী। জানালেন, নৃসিংহ ডাক্তার সিংহ রায় পরিবারেরই সন্তান। বিভূতিভূষণের বন্ধু তথা সহকর্মী বৃন্দাবনের পরিবারের। তাঁর ডিসপেনসারি আর ফকির মোদকের দোকান পাশাপাশি ছিল। এখন বাড়িটির রূপ বদলেছে। ডিসপেনসারির জায়গায় এখনও ওষুধের দোকান আছে একটা। শিক্ষক গৌরচন্দ্রও বিভূতিভূষণের দু’বার জাঙ্গিপাড়া আসার কথা বললেন। প্রথমবারে আসার স্মৃতিকথায় যে মোদকের উল্লেখ রয়েছে তা ফকির মোদকের দোকানের উল্টোদিকে একটি দোকান হতে পারে বলে তাঁর অনুমান। দোকানটি এখন আর নেই। তবে পাঠশালার গুরুমশাইয়ের সঠিক পরিচয় তিনি উদ্ধার করতে পারেননি বলে জানালেন। আর জানালেন, বিভূতিভূষণের ছাত্র গজেন সম্ভবত জগৎবল্লভপুর হাইস্কুলের একসময়ের এক প্রধান শিক্ষকের বাবা।

কালীতলায় বিভূতিভূষণ সেবা সদন।

শিক্ষককের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার পথে। হাটুইদের দোকানে দই খেলাম। হেঁটে যেতে যেতে পান্নালালবাবু একটা মন্দির এবং কতকগুলো বাড়ি দেখালেন। যেগুলো একসময়ে মার্টিন রেলের সম্পত্তি ছিল। এখন বেদখল হয়ে গিয়েছে। আবার বিভূতি-স্মৃতি ধন্য ফকির মোদকের দোকানে ফেরা। তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া এমন এক রোমাঞ্চকর ইতিহাসের সন্ধান দেওয়ার জন্য। তার পর যাত্রা অযোধ্যা পুলের দিকে। যেখানে বিভূতিভূষণ অন্ধকারে চুপটি করে বসে থাকতেন। আমরাও অন্ধকারে পুল দেখলাম। সে পুল কাঠের ছিল। এখন পাকা। পুলের ওপারে এখনও কিছুটা বাঁশঝাড় রয়েছে।

সমকাল কখনও প্রতিভাকে গুরুত্ব দেয়নি। বিভূতিভূষণও জাঙ্গিপাড়ার কাছে পাননি। আক্ষরিক অর্থেই তাঁকে ‘তাড়ানো’ হয়েছিল এখান থেকে। ভাগ্যিস তাড়িয়েছিলেন। না হলে ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’ সৃষ্টি হত! আমাদের মনে হচ্ছিল, বর্তমান যেন পূর্বপুরুষদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে শুরু করেছে। তাই স্কুলে তাঁর নামে ভবন। গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে তাঁর নামে সেবা কেন্দ্র। সে কথা মানতে চাইলেন না সিংহ রায় পরিবারের এক সদস্য। তিনি ‘তাড়ানোতেই’ বেশি জোর দিলেন মনে হল। আর মনে হল, সে জন্য বিভূতিভূষণই দায়ী। কারণ তিনি প্ল্যানচেট করতেন। আর এখন তাঁকে নিয়ে এখানে ‘লাফালাফি’ নেহাতই অর্বাচীনদের। যাঁরা কিছুই জানেন না।

জাঙ্গিপাড়া ছেড়ে আসার সময়ে ছোট ছোট কিছু ছবি মনে ভাসছিল। ছুটির সকালে মার্টিন রেললাইনের ধারে বসে চেয়ার পেতে তেল মাখছেন বিভূতিভূষণ। অযোধ্যা পুলের কাছে জোনাকি জ্বলা বাঁশঝাড়ের কাছে বসে রয়েছেন আত্মস্থ ‘পথের কবি’। কিংবা স্কুল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বিভূতিভূষণ। ছাত্ররা পথ আটকেছেন।

‘যেতে নাহি দিব’।

তথ্যসূত্র— ১। পথের কবি- কিশলয় ঠাকুর, ২। অভিযাত্রিক- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

কৃতজ্ঞতা: গণেশ সাঁতরা, পান্নালাল বিশ্বাস, গৌরচন্দ্র কোলে

কভারের ছবি— ফকির মোদকের দোকান

ছবি— শুভ বৈদ্য, দীপশেখর দাস ও ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

5 thoughts on “একটি মিষ্টির দোকান ও বিভূতিভূষণের স্মৃতিপথ

  1. দীপকবাবু , বিভূতিভূষণকে নিয়ে আপনার প্রতিবেদনটি পড়লাম। জাঙ্গিপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সূত্রে এবং বিভূতিভূষণ কে পড়ার সুবাদে এসব ইতিহাস আমার জানা । তবুও নতুন করে ভালো লাগল।
    প্রসঙ্গত জানাই ফকির মোদকের পেন্সিল ড্রয়িং আমারই। আর বিভূতিভূষণ সেবাসদনের আমি একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

    1. আপনার প্রতিক্রিয়া পেয়ে আমাদের ভাল লাগল। আসলে আমাদের জানা ছিল না। দেখার পরে পড়া। মিষ্টির দোকানে দেখার পরে। তাই নতুনের আবিষ্কারের উচ্ছ্বাস।
      বিভূতিভূষণ সেবাসদনের কর্মকাণ্ড জানলাম একটি প্রচারপত্র থেকে। সেটি রাস্তার পাশের একটি দোকানের দরজায় সাঁটা ছিল। ভাল উদ্যোগ। বিশেষ করে বিভূতিভূষণের স্মৃতি জাগিয়ে রাখার উদ্যোগ বেশি ভাল লেগেছে। সেই স্মৃতি যতই না কেন বিষাদময় হোক।
      আপনার পেন্সিল ড্রয়িং থেকেই আগ্রহের জন্ম। এক শিল্পী আমাদের সফর-কথা পড়েছেন জেনে আমরা খুবই খুশি।

  2. আমার হোয়াটস্ অ্যাপ নম্বর এবং ফোন নম্বর 9126995764

    1. ধন্যবাদ জ্যোতিরিন্দ্রবাবু। যোগাযোগ হবে।

      1. আপনাকেও আমার শুভেচ্ছা জানাই। আপনার পথ চলা আরও সুন্দর ও মসৃণ হোক। ভালো থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *