হাজরা বাড়ির দেবী।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

মুড়ো কাড়াকাড়িতে জয়ী হত লেঠেল সর্দার

দীপক দাস

গিয়েছিলাম মিষ্টির খোঁজে। পেয়ে গেলাম এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। এ ইতিহাস এক এলাকার। এক পরিবারের। আবার এক প্রাচীন দেবীরও।

পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতারে গিয়েছিলাম গত জুন মাসের শেষে। গমনের উদ্দেশ্য ছিল, গোপাল মোদক আর তাঁর আবিষ্কার ‘গোপালগোল্লা’র সন্ধানে। সন্ধান করতেই গ্রামের ভিতরে ঢোকা। ভাতার বাজার থেকে টোটোর সহযাত্রী সন্দীপ রায় নিয়ে গিয়েছিলেন পার্থসারথি হাজরার বাড়িতে। সন্দীপবাবুকে অনুরোধ করেছিলাম, গ্রামের এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে যিনি স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেন।

পার্থবাবুর ডাকনাম আশিস। মিষ্টি নিয়ে কথা প্রসঙ্গেই ইতিহাস চর্চার কথা উঠল। ধীরে ধীরে প্রকাশ পেল গ্রামের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান আশিসবাবু। যে পরিবারের ইতিহাসের শিকড় পোঁতা রয়েছে উত্তরপ্রদেশের আগরায়। জাতিতে রাজপুত ক্ষত্রিয় ছিলেন আশিসবাবুর পূর্বপুরুষ। মানসিংহের স্নেহধন্য ছিলেন কোনও এক পূর্বপুরুষ। পরবর্তী কোনও প্রজন্ম আগরা অঞ্চল থেকে বাংলায় চলে আসেন। তিনি প্রথমে এসেছিলেন এরুয়ার নামে এক গ্রামে। এখন ভাতার থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এরুয়ার। এরুয়ারে আগরা আগত রাজপুতেরা কতদিন ছিলেন জানা যায় না। তবে জানা যায়, ভাতার গ্রামে প্রথম এসেছিলেন এই বংশের দামোদর কোঁয়ার। কথিত, এরুয়ার এলাকায় দেওয়ানের অত্যাচার চরমে উঠলে দামোদর পরিবার নিয়ে গ্রাম ছাড়েন। তবে আসার আগে তিনি ভাতার গ্রামের জমিদারি পেয়েছিলেন। আর পেয়েছিলেন নতুন উপাধি হাজরা। কোঁয়ার পদবি ছেড়ে হাজরা ব্যবহার করতে শুরু করেন দামোদর ও তাঁর উত্তর পুরুষেরা।

হাজরাদের পুরনো বসতবাড়ি। এই বাড়ির ছাদে রয়েছে সিংহবাহিনীর মূর্তি।

তখন অবশ্য এলাকার নাম ভাতার ছিল না। নাম ছিল মুজফফরশাহি। কবে ভাতার নাম হল সে বিষয়ে তেমন তথ্য মেলে না। অনেকে মনে করেন, হেমরাজপুর আর দুবরাজপুর পাশাপাশি দু’টো গ্রাম মিলেমিশে ভাতার তৈরি হয়। হাজরা পরিবারের দুই পূর্বপুরুষের নামও কিন্তু হেমরাজ আর দুবরাজ। এই দু’জনের নামে গ্রামের নাম ছিল কিনা জানা যায় না। একটা অনুন্নত এলাকায় জমিদারি পেয়েছিলেন দামোদর এলাকা। জলা-জঙ্গলে ভরা। রাস্তা বলতে বর্ধমান-কাটোয়া কাঁচা রাস্তা। যানবাহন মূলত উটের গাড়ি। এই গাড়ি দাঁড়াত ভাতারের সন্তোষ সায়রের পুবদিকে। জায়গাটি চাঁদনি চক নামে পরিচিত ছিল। এলাকায় বাস করতেন ‘অনুন্নত কিছু সম্প্রদায়’। দামোদর হাজরা ও তাঁ উত্তর পুরুষেরা গ্রামটি সাজিয়ে তোলেন। গ্রামের একদিকের পাহারায় পাঠানদের বসানো হয়েছিল। এই পাঠানদের বংশধরেরা এখনও গ্রামে আছেন, বলছিলেন আশিসবাবু।

হাজরা পরিবার ভাতারে তিন-চার পুরুষ বসবাসের পরেই বাঙালি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে ফেলেন। রাজপুত ঘরানা ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। এই পরিবারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সম্পদ হল কুলদেবী সিংহবাহিনী। আশিসবাবু বলছেন, অন্তত ৫০০ বছরের প্রাচীন পুজো। প্রাচীনত্বের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই মূর্তিটি তিব্বতের এক সন্ন্যাসীর দেওয়া। তিনি যে মূর্তিটি দিয়েছিলেন সেটি ছিল অষ্টধাতুর। বছর তিরিশেক আগে অলংকার খচিত সেই মূর্তি চুরি হয়ে যায়। পরে আরেকটি মূর্তি তৈরি করানো হয়। তিব্বতের সন্ন্যাসীর দেওয়া মূর্তি। সন্ন্যাসী কি কোনও বৌদ্ধ ছিলেন? তাঁর অষ্টধাতুর মূর্তিটি কি বৌদ্ধ দেবীর? আশিসবাবু বলতে পারেননি।

বনবাসী শিবমন্দির। হাজরা পরিবারের ফটোগ্রাফ থেকে সংগৃহীত।

সিংহবাহিনীর পুজো হত দুর্গাপুজোর সময়ে। হাজরা পরিবারের বাঙালি হয়ে ওঠার বোধহয় এটাই বড় প্রমাণ। দুর্গাপুজো তো বাঙালির পরিচয়বাহী। সিংহবাহিনী পুজোর সময়ে হাজরা বাড়ি জমজমাট হত। নবশায়ক প্রজারা নানা উপকরণ দিতেন পুজোয়। সিংহবাহিনী পুজোয় একটা আকর্ষণীয় রীতি ছিল। নবমীর বলির ছাগলের মাথা নিয়ে একটা খেলার আয়োজন হত। খেলার নাম, মুড়ো কাড়াকাড়ি খেলা। এই খেলায় যিনি জিততেন তিনি এক বছরের জন্য লেঠেল সর্দার হতেন। উপহার পেতেন গামছা আর অর্থ। এই খেলা অবশ্য বছর তিরিশেক আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

ভাতার গ্রামে আরেকটি দেবস্থান উল্লেখযোগ্য। তা হল গ্রামের উত্তরে মাঠের মধ্যে অবস্থিত বনবাসী শিব। এখানেও সেই গরুর দুধ দেওয়ার কিংবদন্তী রয়েছে। এক গরু একটা ঢিবির উপরে দাঁড়ালেই আপনা থেকে দুধ পড়ত। ঢিবি খুঁড়লে মেলে শিবলিঙ্গ। তৈরি হয় মন্দির। তবে অনেকের ধারণা, বর্গি হামলা ঠেকাতে নাকি শিবমন্দির তৈরি হয়েছিল। বর্গিরা নাকি শিবমন্দির দেখলে গ্রামে ঢুকত না।

নতুন মন্দিরের সামনে পার্থবাবু তথা আশিসবাবু।

আশিসবাবু ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন সিংহবাহিনীর মন্দির। তাঁদের পুরনো প্রাসাদের মতো বাড়ি। সেই বাড়ির ছাদে সিংহবাহিনীর মূর্তি রয়েছে। পুজোর সময়ে পাশের নতুন মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। বনবাসী শিবের মন্দিরটা কিছু দূরে। মিষ্টির খোঁজে যাওয়ার তাড়া থাকায় আর দেখতে যাওয়া হয়নি। সেদিন ভাতার গ্রামের পুরনো দিনের অনেক গল্প বলেছিলেন আশিসবাবু। যেমন, ভাতারের উপর দিয়ে যেত ম্যাকলিয়ড কোম্পানির লাইট রেলওয়ে। বর্ধমান-কাটোয়া ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেন। লোকে বলত বিকে রেল। ভাতারে স্টেশন ছিল।

সিংহবাহিনী মূর্তি।

এলাকার নামটাই এমন স্বাভাবিক ভাবে উৎস খোঁজার ইচ্ছে জাগে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম আশিসবাবুকে। একাধিক সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন তিনি। কারও মতে, পৌরাণিক রাজা ভর্তৃহরি প্রতিষ্ঠিত ভর্তৃহরিনগর একসময়ে ভাতারে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। কেউ বলেন ভাতুরিয়া নামের এক ঐতিহাসিক স্থানের অপভ্রংশ ভাতার। অনেকের বিশ্বাস, এই এলাকায় ভাতের অভাব ছিল না বলে এমন নাম হয়। কারও মত, বনবাসী শিবকে এখানে ভাতার নামে ডাকা হত। সেই থেকে গ্রামের নাম।

গ্রামের নামের উৎস আর সিংহবাহিনী দেবী, দুই আকর্ষণ নিয়ে বেঁচে ভাতার গ্রাম।

তথ্যসূত্র- ভাতাড় গ্রাম— পার্থসারথি হাজরা, শারদীয়া আহ্নিক গতি, ১৪২৩

কভারের ছবি— সিংহবাহিনীর মূর্তি

ছবি- লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *