খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

জলুদার কচুরি, ইন্ডিয়ানের কালাকাঁদ আর সুইট হোমের রাবড়ি

ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

ব্যারাকপুর স্টেশন ছেড়ে ব্যারাকপুর-বারাসত রোডে উঠলেই চোখে পড়বে পিচ রাস্তার একটা বড় অংশে কালো পাথর বসানো। ইটের মাপে কাটা। পিছল হয়েছে বাস, অটো রিকশার চাকা আর জুতোর ঘষায়। সে রাস্তায় উঠেই বাঁ হাতে তাকিয়ে গন্ধে গন্ধে পৌঁছতাম দোকানটায়। বয়স অল্প। তবু বায়না কম ছিল বলে বেশি ঘ্যানঘ্যান করতে হত না।

ফুলকো ফুলকো হিংয়ের কচুরি তখন সবে ছাঁকা তেলে নাইছে। পাতে তুলে দেওয়ার সময় এখনকার মতো তার পেটে ঘুঁষনো হত না। একটার গায়ে আরেকটা ঠেলাঠেলি করে পড়ে গড়িয়ে যেত। দক্ষিণেশ্বরকে পর্যন্ত ঈর্ষায় ফেলত সে স্বাদ। বাঙালির হাতে তৈরি অমন অভিজ্ঞ কচুরি এখন আর খুব একটা মেলে কী!

ইদানীং যাওয়ার সুযোগ প্রায় একাংশও নেই। বছর ১৫ আগে পর্যন্ত ধীরে ধীরে কমতে থাকা যাতায়াত লেগে থাকত বছরের অন্তত চারটে দিন। দুর্গাপুজো, ভাইফোঁটায় নিশ্চিত। আর ব্যারাকপুর ভোলাগিরি আশ্রমের গোটা কতক উৎসবে। মা-বাবা সেখানে দীক্ষিত। সেখান থেকে আবার ৩০০ মিটার দূরেই মামার বাড়ি। ভাইফোঁটা ছাড়াও বছরভর আহ্লাদের এমন জায়গা থাকলেও উপভোগের বিষয় ছিল আরও বেশি। ৫-৬ বছর বয়স তখন। মন কৌতূহলী। ধোঁয়া ওঠা হিংয়ের কচুরির গন্ধ তো টানবেই। সে দোকানের আসল নাম আমার জ্ঞান হওয়ার অনেক আগেই ঢেকে গেছিল কাঠ আর কয়লা পোড়া উনুনের কালিতে। বাবা-মামাদের ডাকতে শুনেছি জলুদার দোকান বলে। মন তখন নিজ নিকেতনে।

রাস্তা ছেড়ে উঁচু বেদি ফুটপাথ। তার গা বেয়েই পথ এক ঢালে নেমে গিয়েছে ক্ষীর চমচম, রসগোল্লা, ছানার মুড়কি, অমৃতি, কালাকাঁদ, রসমালাই, দানাদার, ক্ষীরকদম, কালো জামে ঠাসা কাচের বাক্সটাকে পাশে রেখে। মনময় তখন ভুরভুর করছে বড় সাইজের ঢ্যালা ঢ্যালা হলদে কচুরির ডানা মেলা আতর! একটু পরেই যা উঠে আসবে পাতে। সঙ্গে ঘন ছোলার ডাল। পাতের একপাশে মাথা কাটা চামচ। কচুরির কোনা ছিঁড়ে মুখে পুরে প্রথমেই চিবিয়ে ফেলা যাবে না। যার একটা কোনাও কড়াইয়ে পাশ ফিরতে গিয়ে ভাঁজ হয়ে যায়নি, যার পুরু ধার বরাবর গরম তেলের বুদবুদ, তাকে এক কথায় মুখের ভিতরে হাওয়া করে দেওয়া যেত না। হা হু করে গুনে ৪ সেকেন্ড তার গরম আদরের স্রোত চলত তালু আর জিভ বরাবর। তখন কিন্তু চোখ বুজে রাখা চাই!

ব্যারাকপুরে ভোলাগিরি আশ্রমের রসুইঘর।

পরের দিকে বেশিরভাগ সময়েই আর সেসব হয়নি। কিন্তু বাবার কাছে আবদারের বয়সে সকাল দুপুর বিকেল যখনই স্টেশন ছেড়ে বড় রাস্তায় পা রেখেছি, দু’টো ময়দা মুখে না পুরে কিছুতেই যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ওই চত্বরে একাধিক ভাল মিষ্টির দোকান এখনও আছে। যেমন আরেকটু এগিয়েই সাজানো গোছানো রামকৃষ্ণ। তবে কচুরি খাওয়ার জন্য যে দোকানের কথা বললাম তাকে খুঁজতে হবে কোনার দোকানের সারিতে চোখ রেখে। পরিচয় জলুদার দোকান। সে স্বাদ এখন কতটা আছে জানি না। তবে পুরনো সে স্বাদ একটু বেশি লাগত গোল ভুঁড়ি মালিকের মায়াভরা হাসি দেখে। ময়রা তখন ভিতরে বসে মালিকের আলাপ দেখছে। মালিকও হাত লাগিয়েছে ময়দায়।

মায়ের শেষ পাতে একটু মিষ্টি দই, নয়তো কালাকাঁদ, অথবা সরভাজা। বাবা হয়তো কখনও লর্ড চমচম। তবে রেগুলার নয়। মাঝেমাঝে, মন খুশি থাকলে। সেই কালাকাঁদই পৌঁছত মামাবাড়ি। মিষ্টি দইয়ের হাঁড়ির পাশে ঝুলে। তবে লর্ড চমচম এখনও পর্যন্ত সেরা খেয়েছি নৈহাটি স্টেশন রোডের দোকানে। মানে লট চমচম আর কী! সে আলাপ পরে হবে। সদরবাজারে সুইট হোম আর ইন্ডিয়ান সুইটসের কালাকাঁদ, রাবড়ি এখনও মুখ খোলেনি।

দই-রাবড়ির সুইট হোম, কালাকাঁদের ইন্ডিয়ান

মিষ্টি দই! কথাটা বলে চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভাবলে আরাম পোরা ভুঁড়ি থলথলে নন্টে ফন্টের যে সুপারিন্টেনডেন্টকে স্মিতহাস্যে ধ্যানমগ্ন বসে থাকতে দেখা যায়, এ মিষ্টি দইয়ের স্বাদ ঠিক তেমনি। দুই দোকানের দুই যমজ সুপার।

টক দই মুখে দিলে ক্ষীর বলে প্রথমটায় ভুল হবে। আর রাবড়ি মুখে তুললেই স্মৃতিভ্রংশ! গলা থেকে সুরুৎ করে কান বেয়ে উঠলেই মাথার পিছন দিকটা যেন আর নেই! পরতে পরতে জমা দুধের কয়েক প্রজন্মের পুরু সর অল্প চিনিতে মিশিয়ে দিলে যে মোহ তৈরি হয় ঠিক তেমন!

আরও অনেক কারণের সঙ্গে ব্যারাকপুর কিন্তু বিখ্যাত কালীপুজোর জন্য। স্টেশন রোড ছাড়িয়ে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড ধরে সোজা চলে গেলে পরপর বড় বড় সব পুজো এখনও কমবেশি জাঁক করেই হয়। তো সেই রাস্তা ধরে বেশ কিছুদূর গেলে একটা মোড় ডান হাতে ঘুরে কোর্ট চত্বরে ঢুকেছে। সেখানে পৌঁছে বাঁ দিকে ঘুরলেই সদরবাজার। এখানে পৌঁছনোর আরও অঢেল রাস্তা। মামারবাড়ি ছিল বালিঘাট স্টপেজে। ঘাটে দাড়িয়ে সার সার লরির সাদা বালি তুলে নিয়ে যাওয়া দেখার বস্তু ছিল। পাশেই ইঁটভাটা। সে রাস্তায় না ঢুকে উল্টোদিকে ঢুকলেই সোজা চলে গেলে মামাবাড়ির গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে পৌঁছনো যেত সদরবাজার। আধ কিলোমিটারের ফারাকে দুই মিষ্টি তীর্থ, ইন্ডিয়ান সুইটস আর সুইট হোম।

ভোলাগিরি আশ্রম
ব্যারাকপুরে ভোলাগিরি আশ্রম

এই দুই জায়গার দইয়েরই তখন মর্ত্যজোড়া নাম। এক প্লেট খেলে চোখ জোড়া জুড়িয়ে আসত ভর দুপুরের আগেই। ছোটবেলায় মামার হাতেই দুলতে দুলতে বাড়ি ঢুকতে দেখেছি সেই দই আর রাবড়ি। সাইকেল শিখে মাঝেমাঝে আমিই মামাকে বসিয়ে নিয়ে যেতাম। দই বা রাবড়ি আসত সকালের টিফিনের জন্য। আবার দ্বিতীয় দফায় কালাকাঁদ আসত বাড়ি ফেরার মুখ মিষ্টি করার জন্য।

বড় বয়সে বিকেলে ছোট চিনে মাটির কাপে চা ছাড়া মুখে আর কিছু তুলতে চাইতাম না। কিন্তু মামাবাড়ি বলে কথা। মামাই সেই অমৃতসম কালাকাঁদ পুরে আমার মুখ বন্ধ করে দিত। জমানো ক্ষীর সমান মাপে কাটা। দানাটি পড়লে মুখে মিলিয়ে যেত। মাঝের সময়টায় বাড়ির পিছনে বড় খাটালে মামা বা দিদিমার সঙ্গে যাওয়া হত দুধ আনতে। সে যাওয়াও উৎসবের পর্ব। দুধ দোয়া শেষ। গরুগুলো জাবর কাটছে। সামনে থরে থরে দুধের কৌটো। বালতি ভরা হলদে দুধের মুখ উথলে উঠেছে গরম ফেনায়। কয়েক কাঠা জোড়া চাতালে ফুরফুরে হাওয়ায় পাতা নারকেল দড়ির খাটিয়া তখন আমার আলাদিনের কার্পেট। আচমকা সে সুখ হেঁচকা টানে দুধের বালতি তোলার মতো ছিনিয়ে নিত বাড়ি ফিরে আসার কষ্ট।

সেই কষ্টের মুখই কিছুটা স্বস্তি পেত কালাকাঁদ পুরে। মুখে দিয়েই খাবলে খেয়ে ফেলা নয়। নরম ক্ষীরের দলাইমলাই চলত বেশ কয়েক সেকেন্ড। একটু করে মুখ নেড়েচেড়ে নিতে হত। সারা বছর সাদা, শীতে গুড় ঢালা। এপাশ ওপাশ করতে করতেই গলায় সামান্য বেফাঁস আওয়াজ। সমস্তটা গিয়ে পৌঁছল পেটে। দু’তিনটে শুধু তখনকার মতো। বাঁধাছাদা করে আনা বাকি সবের স্বাদ দু’তিনদিন ধরে ভাগাভাগি চলত মুখে গালে পেটে।

সেসব দোকানের ঠিকানা এখনও আছে। কেত আরও বেড়েছে। আমার কাছে আরেকজনের ঠিকানা আছে। আর সব কিছু চেখে দেখার পাশাপাশি অবশ্যই মুখে দিতে হবে সেখানকার মাখা সন্দেশ, চমচম, দানাদার, ক্ষীরকদম এবং দইটা-ও। কিছুটা খাঁটি দুধের স্বাদ এখনও সেখানে মেলে। আলাদা করে ঘি-ও বানিয়ে বিক্রি করে তারা। সকালের কচুরি জিলিপি কিংবা বিকেলের শিঙাড়াও উপাদেয়। জায়গাটা মণিরামপুর। ভোলাগিরি আশ্রমের রাস্তায় ঢুকে ডান হাতেই এই দোকান। সকলে চেনে রঞ্জিত সাধুঁখার দোকান বলে। আরও চেনে তাঁর বাবা রাজাবাবুর নামে। এই রাজাবাবুর ভাল নাম ছিল কৃষ্ণচন্দ্র সাধুঁখা। এর হাতেই দোকানের শুরু। সম্ভবত এরই নামে দোকানের নাম শ্রীকৃষ্ণ সুইটস (যতদূর মনে পড়ছে)। দোকান এখন তাঁরই তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। আগে বছরভর আশ্রমের নানা পুজো-উৎসবের রেশ এ দোকানই টেনে নিত অনেকটা। আশ্রমের জৌলুস কমার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের টানও কিছুটা পড়তির দিকে। তবু এখনও যে জিনিসটা বলে বলে বাউন্ডারি হাঁকায় সেটা হল সকালের গরম বোঁদে। লালে হলুদে মেশানো একটু বড় চেহারার রসালো টুপটুপে নরম দানা। এক চামচ মুখে দিলে পঞ্চাশ গ্রাম পরের চামচেই উঠে যাবে। বাকি ২০০ গ্রাম মুড়িতে মেখে নিতে হবে। আড্ডার মতো জমে উঠবে আমেজ। পাইক বরকন্দাজ দরকার হতে পারে আড্ডা ভাঙতে।

ভাল পান্তুয়ায় মন খুশ সর্বদা। ছবিটি প্রতীকী।

শেষ পাতে পান্তুয়া

ভোলাগিরি আশ্রম ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে। গা ঘেঁষে আশ্রমেরই স্কুল মহাদেবানন্দ বিদ্যায়তন। তারই পাড়ে গঙ্গা। এখানে এখনও খেয়া চলে উল্টোদিকে শেওড়াফুলি ঘাট পর্যন্ত। আরেকটু এগিয়ে গেলে দু’পয়সার ঘাট। সেখান থেকেও খেয়া পেরিয়ে যাওয়া যায় এই শেওড়াফুলি ঘাটে। বাবা ছিলেন এই স্কুলের ছাত্র, হস্টেলের আবাসিক, সেই স্কুলেই চাকরিজীবন। আবার একদিকে মামার বাড়ি। ফলে ছোটবেলার একটা সময় ওই আশ্রম, স্কুল আর গঙ্গার ধারে বটের বেদি বা নৌকোর ছইয়ে বসে কেটেছে। বালি উড়িয়ে মামার সেই সাইকেল চালিয়ে দুপুর গড়িয়েছে। সেই আশ্রমেই পেয়েছিলাম স্বপ্নের মতো গালপোরা রসে ভেজানো পান্তুয়া।

আশ্রমে কোনও অনুষ্ঠানে গেলেই শেষ পাতে। ছোটবেলায় ছোট মুখ, গোটা আঁটতো না। কিন্তু নরম তুলতুলে পরিমিত সে মিষ্টি পাতে পড়লেই একপাশে কাত! আআহ!! বাবার থেকে বয়সে ছোট আরেক প্রাক্তন আবাসিক কানাই কাকু আসত সব অনুষ্ঠানেই। গিয়েই তাকে খুঁজতাম। কারণ একটাই এবং মোক্ষম। শেষের আগে শালপাতা গড়ানো মধুর গরম পায়েস বার দেড়েক পেটে যাওয়ার পর মন উচাটন হত ভাইয়া ডাকে কানাই কাকু হাজির হলে!! কান খাড়া হতে না হতেই পাতের সামনে ঠকাস করে নামল পান্তুয়ার বালতি। সেখানেই তৈরি হত তখন। ‘‘ভাইয়া খাও!’’ শুনেই মুখ রসরস। মন জবজব। টপাটপ দুটো। সেই রস একটু থেমে আবার ধাক্কা দিত মুখে একটা বড় এলাচের বীজ পড়লে। কানাই কাকু যেখানেই থাকুক ভোগ খাওয়া সেরে এক পঙক্তি উঠে গেলেই আমার সামনে হাজির। পাশে বসে মা। বাবা এক দফার পরিবেশন সেরে অন্য ঘরে। গোটা পঙক্তি তখন মুখ আঁচাতে গিয়েছে। আর আমার হাতে পান্তুয়া!

এই রস সাধ স্বপ্ন দিনে দিনে হারাল। পরের দিকে সুদূর বাগুইআটিতে নিজের পাড়ার আদি দোকান মডার্ন সুইটসে পেলাম লেডিক্যানি! আআহ আরেক নতুন স্বাদ। ওপরের পরত একটু ভারী। ভিতরে তুলতুলে ছানার পুর। সেই দোকানও এখন অবলুপ্ত!

কভারের ছবি— প্রতীকী

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *