বাহিরগড়।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

গড়, মন্দির, মার্টিন রেলের বাহিরগড়

দীপক দাস

একটা পুকুর। পাড়ে বাঁশবাগান ও অন্য গাছ রয়েছে। গাছের পাতা পড়ে পুকুরের জলে সম্ভবত বহু অণুজীব জন্মেছে। জলের উপরিভাগে কেমন একটা একটা লালচে সর পড়েছে। জলের রংটাও সবুজ। পুকুর পাড়ে একটা বাঁধানো চাতাল। সেটির পুকুরের দিকের অংশে দু’টি লম্বাটে বাঁধানো বসার জায়গা। দু’টো মিলিয়ে ইংরেজি এল অক্ষরের মতো রয়েছে। একটা পুরনো, ক্ষয়াটে। আরেকটি হয় নতুন, নয়তো পুরনোর উপরে নতুনের প্রলেপ। পুরনো বসার জায়গার মাথায় একটা ফলক বসানো। ফলকে চুন, সিমেন্ট ক্ষইয়ে লেখা ক’টি কথা, ‘ঈশ্বর রাজা বিষ্ণুদাস সিং স্মৃতি’।

পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা গড় খুঁজছিলাম। চিহ্ন দেখছি না আশেপাশে কোথাও। তখনও চোখে পড়ল চাতালটা। পুকুরটা। একসময় হয়তো গড়েরই অংশ ছিল। তার পর ‘রাজছত্র ভেঙে পড়ে রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে’র মতো। হারিয়েছে গড়। রাজার গর্বের স্থান।

রাজা বিষ্ণুদাসের স্মৃতির সেই ঘাট।

অনেকদিন পরে বেরিয়েছিলাম। আচমকাই ঠিক হয়েছিল। হেতু পুরনো সফর-সঙ্গী কচিবাবু ওরফে শুভ বৈদ্যের শুভাগমন। তিনি বাসিন্দা কলকাতার। বর্তমানে কর্মসূত্রে চেন্নাইবাসী। অনেক বছর পরে এসেছেন বন্ধু দীপশেখর ওরফে মিস্টার ঘাসপুসের বাড়ি। দীপুবাবু বর্তমানে ঘাসপুসের ডক্টরি ডিগ্রি দখলে বড়ই ব্যস্ত। শুধু বন্ধুর খাতিরে বেরোবেন। ফলে এক হোয়াটসঅ্যাপ নির্দেশিকা, ‘‘জায়গা খোঁজো। এই মঙ্গলবার বেরনো হবে।’’ কাছেপিঠে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। নির্দেশ মতো জায়গা খোঁজা। খুঁজতে গিয়েই বাহিড়গড়ের সন্ধান। হুগলি জেলার। গড়ের ইতিহাস আছে, মন্দিরও আছে। আমাদের পাতিহাল গ্রাম থেকে বেশি দূরে নয়। দীপু ডেকে নিয়েছিল, বাবলাকেও। ওরফে ছোটা ডন। তিনিও বহুদিন পরে ব্যবসা ছেড়ে নড়ছেন।

বিশ্বেশ্বরের মন্দির।

বাইক এসে থেমেছিল নওজোয়ান সমিতির কাছে। এলাকাটা বাহিড়গড় নামে পরিচিত হলেও খাতায় কলমে কৃষ্ণনগর। নদের নয়, এ কেষ্টনগর হুগলির। গড়, মন্দিরগুলোর অবস্থান জেনে নেওয়া যাক। এক চাষি ফিরছিলেন। তিনিই জানালেন, ক্লাবের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তায় গেলে একটু ঘুরপথ হবে। পাকা রাস্তা ধরে আরেকটু এগিয়ে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে গেলে সুবিধা। এগিয়ে গেলাম। তখনও কি জানতাম, এই ক্লাবটি এক ইতিহাসের ধারক?

গড়ের কাছের শিবমন্দির।

আমরা খোঁজ করছিলাম গড় আর দামোদর মন্দিরের। দু’টো দু’দিকে। ফলে আগে গড় দেখতে যাওয়াই ঠিক হল। সে পথে যেতে গিয়ে একটা মন্দির পড়ল। শিবরাত্রির ব্রত পালনে মেয়েদের ভিড়। তবুও বাইক থামল। ছবি তোলাতেও কিছুটা সাবধানতা নেওয়া হল। দূর থেকে কচি মন্দিরের ছবি তুলল। রাস্তায় জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছিলাম, এটা বেশ পুরনো মন্দির। কত পুরনো? মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন অমরেন্দ্রনাথ সিংহ রায়। প্রতিষ্ঠা সন ১১২৬ বঙ্গাব্দ। তিনশো বছরের পুরনো শিবমন্দির।

বাহিরগড়।

এত পুরনো মন্দির যখন তখন নিশ্চয় এর ইতিহাস আছে। খোঁজখবর করা দরকার। মন্দিরের পাশের চাতালেই বসেছিলেন অনিল সিংহ রায়। পরিচয় মিলল, তিনি রাজা বিষ্ণুদাসের বংশধর। বিষ্ণুদাস মানে পুকুর পাড়ের সেই স্মৃতিফলকের নামটি। অনিলবাবু জানালেন, মন্দিরটির সঙ্গে তারকেশ্বরের শৈবতীর্থের যোগ রয়েছে। পুরোহিত ঠিক করা হয় তারকেশ্বর থেকেই। তাঁরাই বেতন দেন। আগে এখানে তিনটি শিবমন্দির ছিল। সেই তিনটি শিব গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে নতুন শিব পাঠানো হয় তারকেশ্বর থেকে। হাতি করে পাঠানো হয়েছিল শিবলিঙ্গ। মন্দিরে এখন সেই শিবলিঙ্গই পুজো পাচ্ছেন। এই শিব বিশ্বেশ্বর নামে পরিচিত।

এখানেই কি ছিল গড়খাই? মানে পরিখা?

বিশ্বেশ্বর দর্শনের পরে গড়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়া। অনিলবাবু জানালেন, আরেকটু এগিয়ে গেলেই গড়। সেই এগোনোর পথেই পুকুর ঘাটে এসে থামা। তার পর ভাঙা পাঁচিল, ঝোপঝাড়ের ঢিবি দেখে গড় মনে করে ফটোসেশন চারজনের। ভুল ভাঙল কাছের এক বাড়িতে জিজ্ঞাসা করার পরে। আমরা যেখানটা দাঁড়িয়ে আছি তার উল্টো দিকে গড়। এক আধুনিক মন্দিরের পাশ দিয়ে চারজনে গেলাম বটে। কিন্তু গড়ের চিহ্ন দেখতে পেলাম না। বরং একটা পুরনো মন্দির চোখে পড়ল। এটাও একটা শিবমন্দির। বাঁশবাগানের কোলে প্রাচীন এক বেলগাছের নীচে মন্দিরটি। কোনও পরিচয় নেই মন্দিরের দেওয়ালে বা সামনের চাতালে। শুধু তারিখ লেখা। সন ১৭২২। ইংরেজি সনই হবে। এটিও বেশ প্রাচীন মন্দির। সনের পাশে ‘।৩১’— লেখা। এর অর্থ বোধগম্য হল না।

দুর্গাদালানের এইটুকু অংশ শুধু টিকে রয়েছে।

শিবমন্দিরটির কোনও নামও নেই। আগেরটা যেমন বিশ্বেশ্বর। নাম নিয়ে কী করব! সকলেই তো শিব। মন্দিরের পিছন দিকে গেলাম আমরা। অনেকটা জায়গা জুড়ে বাঁশবাগান। তারই মাঝে মাঝে ছোট ছোট জলাশয়। কিছুটা লম্বাটে জলাশয়ও আছে। হয়তো এগুলোই গড়ের চারপাশের পরিখা ছিল। এখন মজে হেজে গিয়ে ছোট ছোট ডোবার মতো হয়েছে। বেলগাছের নীচে একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম। একজোড়া খড়ম রাখা। সেই খড়ম পুজো করা হয়। কী কারণ, কার খড়ম? চারজনে অনেক আলাপ আলোচনা করেও স্থির করা গেল না। তবে টিভিতে দেখা রামায়ণ সিরিয়ালের পরে পাদুকা পুজো চাক্ষুষ দেখে ভালই লাগল।

এইরকম বাড়ি একসময়ের সমৃদ্ধির প্রতীক।

কিন্তু গড়টা কোথায়? মন্দিরের কাছের একটা বাড়ি আছে। গ্রিলে ঘেরা বারান্দায় এক বৃদ্ধ খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁকেই জিজ্ঞাসা করা গেল। তিনি বাড়ির পাশের জঙ্গলে ঢাকা একটা জায়গা দেখালেন। এটাই গড়। আমরা চারজন উঁকিঝুঁকি দিয়ে গড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখার চেষ্টা করলাম। তেমন কিছু চোখে পড়ল না। একটা পাঁচিল। দেওয়াল মনে হল। জানলার মতো দু’তিনটে। তার পরে একটা চত্বর। একটা ভাঙা দরজা। অনেকক্ষণ ধরে দেখে বাবলার মনে হল, এটা সম্ভবত কোনও মন্দির ছিল। বৃদ্ধ বাবলার অনুমানে সায় দিলেন। জানালেন, এটা দুর্গাদালান ছিল। অন্তত ২০০ বছর আগে শেষ পুজো হয়েছিল। তিনি জানালেন, এই গড়ের ইতিহাস জানতে হলে স্বরূপ সিংহ রায়ের যেতে হবে। উনি রাজা বিষ্ণুদাসের বংশধর। তারকেশ্বর মন্দিরের সঙ্গেও যুক্ত। গেলাম। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে তিনি বড় ব্যস্ত। তাই বেশিক্ষণ সময় দিতে পারলেন না।

বাহিরগড়।
দামোদর মন্দির।

অগত্যা আমরা দামোদর মন্দিরের দিকে। যতক্ষণ মন্দিরের পৌঁছব ততক্ষণে বাহিরগড়ের ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া যাক। কে এই রাজা বিষ্ণুদাস? গড়টাই বা কার ছিল? বাহিরগড়ের শিকড় পোঁতা বারাণসীতে। বারাণসীর কাছে জৌনপুর জেলায় বাস ছিল কেশব হাজারির। হাজারি মানে হাজার রাজপুত সেনার অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। অযোধ্যার নবাবের অত্যাচারে বৃদ্ধ কেশবকে পরিবার নিয়ে জৌনপুর ছাড়তে হয়। সঙ্গে হাজার সেনা। তাঁরা উপস্থিত হন হুগলির রামনগরে। কেশবের দুই ছেলে বিষ্ণুদাস ও ভারামল্ল। সেই সময়ে বাংলায় মুর্শিদকুলি খাঁয়ের রাজত্ব। কেশবের দুই ছেলে গ্রামে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। রাজস্ব আদায়ও শুরু করেন। কিন্তু কাছের বালিগড়ি ও মহেনাবাগ পরগনার অধিকর্তারা তাঁদের নামে নবাবের কাছে নালিশ করেন। নবাব দুই ভাইকে মুর্শিদাবাদে পাঠাতে নির্দেশ দেন। সেখানে পৌঁছতেই দুই ভাইকে গ্রেফতার করা হয়। হাজতে থাকাকালীন বিষ্ণুদাসের অলৌকিক শক্তি ও বিষ্ণুভক্তি দেখে নবাব দু’জনকে মুক্তি দেন। বিষ্ণুদাস বালিগড়ি ও মহেনাবাগ পরগনার রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব পান। পান রাজা উপাধিও। আর ভাই ভারামল্ল পান ‘রাও রাঁইয়া’। তিনি ‘রাও ভারামল্ল’ নামে পরিচিত হন। বিষ্ণুদাসই বাহিরগড়ে গড় তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। রামনগরে থাকতেন ভারামল্ল।

নানা দৃশ্যের টেরাকোটার প্যানেল। রয়েছে শিকারের দৃশ্যও।

বিষ্ণুদাসের বসবাসের জায়গার আসল নাম কিন্তু কৃষ্ণনগর। এখন জাঙ্গিপাড়া থানা এলাকায় পড়ে। গড়ের কারণে এর পরিচিতি বাহিরগড় হিসেবে। ‘গড়ের বাইরের গ্রাম তাই বাহিরগড়’। সেই গড়ের চিহ্ন আমরা খুঁজে পাইনি। যা পেয়েছে তা একটা পুজোমণ্ডপ আর গড়খাইয়ের কিছু অংশ। গড়খাই মানে গড়ের চারপাশের খাত। অর্থাৎ পরিখা। পরের দিকে সম্ভবত বিষ্ণুদাসের বংশধরেরা সিংহ রায় উপাধি পান। জৌনপুর থেকে উৎখাত হয়ে কোথায় এসে শিকড় গড়েছিলেন দুই ভাই!

দামোদর মন্দিরটি বেশ প্রাচীন। টেরাকোটার অপূর্ব সব কাজ করা মন্দিরের গায়ে। প্রবেশপথের উপরে ফলকে লেখা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সাল, ‘সকাব্দ ১৬৬৫’। ইংরেজিতে ১৭৪৩ সাল। যথেষ্ট পুরনো মন্দির। মন্দিরের গায়ের টেরাকোটায় রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি। রয়েছে শিকারের দৃশ্যও। প্রবেশপথের উপরে, কিছু মন্দিরের আদলে টেরাকোটার কাজ। তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। মন্দিরটি ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ঐতিহ্য ভবন হিসেবে ঘোষণা করে। এখন দেখলাম, ইংরেজি লেখা বোর্ডটা খুলে পড়ে আছে।

মার্টিন রেললাইনের উপরে কালভার্ট। ইট আর গাঁথনিতে রয়েছে ইতিহাসের রেলের চিহ্ন।

এবার অন্য জায়গায় যেতে হবে। বাহিরগড় ছাড়লাম আমরা। একটা ব্যর্থতা নিয়ে। কিছুতেই গোবিন্দ অধিকারীর জন্মস্থানটা খুঁজে পেলাম না। বাহিরগড়ের অধিকারী পাড়ায় গিয়েও। গোবিন্দ অধিকারী ছিলেন ‘বাংলাদেশের কৃষ্ণযাত্রার অন্যতম প্রবর্তক ও সংস্কারক’। পালাগান রচনাতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বাহিরগড়ে তাঁর রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি ছিল। এতেই তাঁর দলের ও পালার জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। তাঁর নিজের হাতিও ছিল। গোবিন্দ অধিকারীর পুজোমণ্ডপে স্থানীয় বাসিন্দারা নাট্যমঞ্চ তৈরি করেছেন। এত সব তথ্য দেওয়া সত্ত্বেও কেউ বলতে পারলেন না তাঁর অস্তিত্বের কথা। কী আর করা!

ও হ্যাঁ, বাহিরগড় আধুনিক এক ইতিহাসের সঙ্গেও যুক্ত। এখানে মার্টিন রেলের একটি স্টেশন ছিল। হাওড়া-চাঁপাডাঙ্গা শাখার স্টেশন। যদিও সেই স্টেশনের নাম ছিল বাহিরগড়া। বাহিরগড় লোকমুখে বাহিরগড়া হয়েছে। মার্টিন রেল হাওড়া-হুগলির নস্টালজিয়া। কোথাও কি নেই তার চিহ্ন। এই সফরে সে চিহ্ন খুঁজে পাইনি। আরেকবার আসতে হয়েছিল বাহিরগড়ে। সেদিন সঙ্গী ইন্দ্র আর বাবলা। নওজোয়ান সমিতির সামনে দেখা হয়েছিল গ্রামের বাসিন্দা সমীর চক্রবর্তীর। তিনি জানান, এই ক্লাবটি মার্টিন রেলের এক কালভার্টের উপরে তৈরি। ক্লাবের পিছন দিকে গেলে সেই সময়ের ইটের গাঁথনি এখনও বোঝা যায়।

স্টেশনটা ছিল আরেকটু আগে। কিন্তু সব চিহ্ন সময়ের সঙ্গে মুছে গিয়েছে।

তথ্যসূত্র: পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি- বিনয় ঘোষ

কভারের ছবি— গড়ের ভিতরের পুজোমণ্ডপ

ছবি— শুভ বৈদ্য, দীপশেখর দাস, ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “গড়, মন্দির, মার্টিন রেলের বাহিরগড়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *