পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

শীতের শিহরণ নিয়ে কিরিবুরু, মেঘাতুবুরু

ইন্দ্রজিৎ সাউ

কিরিবুরু, মেঘাতুবুরু নামটা শুনেই একটা ভাল লাগা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর বিশেষ কিছু খোঁজ করিনি। বেরিয়ে পড়েছিলাম। অবশ্য খোঁজ করার অবকাশও ছিল না। গুগল জ্যাঠাকে আঙুলের খোঁচা দিয়েও বিশেষ তথ্য পাইনি। কিরিবুরু অর্থাৎ হাতির জঙ্গল আর মেঘাতাবুরু মেঘের মতো ঘন জঙ্গল। এ ছাড়াও সাতশো পাহারের দেশ।

লৌহ আকরিক খনির প্রভাব। চারিদিকে লালচে।

অন্য বছরের মতো এবারও আমরা বেরিয়েছি, ৩১ ডিসেম্বর রাতে। এবারের আমাদের গন্তব্য সারান্ডা জঙ্গলের অন্তর্গত কিরিবুরু, মেঘাতাবুরু আর থলকোবাদ। ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূম জেলায় পড়ে জায়গা তিনটি। তবে এবারের বেরনোয় একটা বিশেষত্ব আছে। সালটা ২০২১, করোনা অতিমারির আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেওনি। এক বছরের গৃহবন্দি দশা কখনও আংশিক কখনও পুরো চলেছে। এখনও বেশ কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। তার মধ্যেই আমরা ছ’জন— সুব্রত, মিন্টুদা, দুলালদা, তপনদা, আমি আর বাইচুং। বাইচুংয়ের আমাদের সঙ্গে প্রথম সফর এটাই।

সেই জওয়ানের সঙ্গে।

পরিকল্পনা মতো রাত ১০টায় বেরনো হল। সুব্রত ডায়লিসিস করে ফেরার পর। উঠেই বিপত্তি, এবারে আমরা বেরিয়েছি তপনদার গাড়িতে। যাতে ন’জন বসার জায়গা আছে। কিন্তু গাড়ির মাথায় ব্যাগপত্র নিলে পুলিশ ধরছে এ রকম কিছু একটা নিয়ম শুনে আমরা সমস্ত কিছু গাড়ির পিছনে সিটে নিয়েছি। বেশ চাপাচাপি করে চলেছি। আমরা এতদিন ঘরে বদ্ধ থাকার পর বেরিয়েছি ঠিকই কিন্তু একটা অস্বস্তি যেন লেগে আছে। বহু দিন পর আমরা এ ভাবে এক সঙ্গে এত কাছাকাছি বসে। রাস্তা প্রায় শূন্য। মাঝে মাঝে কদাচিৎ একটা বাস বা লরি দেখতে পাচ্ছি। প্রাইভেট গাড়ি রাস্তায় নেই বললেই চলে যা এই রাস্তায় বিরল। কত ধাবা খোলা থাকত আমরা রাত গভিরে চা খেতাম তা-ও চোখে পড়ল না।

বোলানি লৌহ আকরিক খনির অংশ বিশেষ।

খুব ভোরে আমরা পৌঁছে গেলাম বারবিল। অনেক ঝক্কি সামলে, এক তো রাস্তার কিছু জানি না আমাদের ড্রাইভার তপনদার এই ধরনের বেড়ানোর কোনও অভিজ্ঞতা নেই। যদিও দীর্ঘ দিন গাড়ি চালাচ্ছেন। হাইওয়ে ছেড়ে লোকাল রাস্তা ধরতেই দেখি লরির বিশাল লাইন। এক ড্রাইভার আমাদের একটি রাস্তা দেখিয়ে দিল কোথায় যাব শুনে। রাস্তা না মেঠো পথ। রাস্তা বলে যেটায় ঢুকলাম সেখানে আধ হাত লাল ধুলো, কোনও রকমে গ্রামের ঢালাই রাস্তা ধরলাম। তখনও এখানকার মানুষজনের ঘুম ভাঙেনি। ইতিউতি দু’একজন দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছে। বারবিল বাজারো শূন্য। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর হোটেলের দরজা খুলল। আমরা রুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নিলাম।

মেঘাতুবুরুর সূর্যাস্ত।

প্রথমেই গেলাম বাজারে রসদের সন্ধানে। এখানে এসে পর্যন্ত দেখছি, চারিদিক কেমন লাল মরচে ধরা। হোটেলের ঘরগুলোও লাল ধুলোয় ভর্তি। কারণ তখনও পর্যন্ত অজানা। বাজার থেকে দিনের রসদ নিয়ে এবং সকালের উদরপূর্তি করে বেরিয়ে পড়লাম কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরুর সন্ধানে। গুগল দেখাচ্ছে বারবিল থেকে কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরুর মাত্র ১৮ কিলোমিটার। কিছুটা এগিয়েছি। রাস্তা আর আশপাশ মায় গাছগাছালি পর্যন্ত মরচে পড়ে আছে। কিছু দূর এগোতেই একটা বোর্ড দেখতে পেলাম, সেল বোলানি ওর মাইন। এতক্ষণে লাল মরচের কারণ পুরোপুরি বুঝতে পারলাম। এটা একটা লৌহ আকরিক খনি। কিছুদূর এগোতেই লৌহ আকরিক খননের এক বিশাল কর্মকাণ্ড দেখতে পেলাম। এক জায়গায় স্তূপীকৃত লৌহ আকরিক দেখে আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। চারিদিকের ছবি টবি তুলছি হঠাৎ দেখি, একজন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন।

কিরিবুরুর সাতশো পাহাড় ভিউ পয়েন্ট।

আমরা ভাবলাম এখানে ছবি তোলা নিষেধ। তাই হয়তো বারণ করতে আসছেন। তবে আমরা নিষেধ সম্পর্কিত কোনও বোর্ড দেখিনি। বেশ ঘাবড়েই গেলাম। ও বাবা কোথায় কী? উনি আমাদের বাংলায় কথা বলতে শুনে এগিয়ে এসেছেন। কারণ ওঁর বাড়ি আরামবাগে। আলাপচারিতা বেশ জমে গেল।

কিরিবুরুর টপ হিলে।

বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর এবং পথের দিশা জওয়ানের কাছ থেকে জেনে নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। পথের দিশা জেনে কী যে উপকৃত হলাম বলে বোঝাতে পারব না। প্রথমেই দেখলাম একটি ঝরনা। সবুজ গাছের গুহার মধ্যে দিয়ে ঝরনার কাছে পৌঁছলাম। পাহাড়ের কোল বেয়ে জলের ধারা ফোয়ারার মতো পড়ছে। এবং জলের ধারায় রামধনুর সৃষ্টি হচ্ছে। জায়গাটা এত ঠান্ডা যে আমাদের কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল। মনটা আমাদের খুশিতে ভরে গেল। একরাশ ভাললাগা নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। জঙ্গলের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। কিছু দূর গিয়ে একটা বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের পাশে একটি আদিবাসী গ্রাম দেখে আমরা দাঁড়ালাম। একটি আমগাছের নীচে আমরা রান্না চাপালাম। সামনেই টাইম কল। খাওয়াদাওয়া সেরে রওনা দিলাম মেঘাতুবুরুর দিকে সূর্যাস্ত দেখতে।

মেঘাতুবুরুর আশপাশের জঙ্গল।

মেঘাতুবুরুর সানসেট পয়েন্ট জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। কয়েকটি যুগল প্রাক-বিবাহ আলোকচিত্র তোলাতে এসেছে। কিন্তু খারাপ খবর। এত কুয়াশাছন্ন যে আমরা সূর্যাস্তের কিছুই দেখতে পেলাম না। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যায় বাজারে গেলাম ঘোরার জন্য। সকালে যে জায়গাটা শুনশান ছিল এখন তিল ধারনের জায়গা নেই।

ঝরনার জল এসে অন্য ধারার সৃষ্টি করেছে।

পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম কিরিবুরুর উদ্দেশে। এবারে আর কোনও ভুল হয়নি। সুন্দর পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে চড়াই উতরাই পার করে এগিয়ে চললাম। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। চারিদিকে ঘন বড় বড় গাছের সারি। আর সামনে সুন্দর পাকা রাস্তা। সে এক মনোরম পরিবেশ। আমরা চেকপোস্টে গাড়ি এবং আমাদের একজনের পরিচয়পত্র দিয়ে এগিয়ে চললাম। কিরিবুরুর ভিউ পয়েন্টে টপ হিলে গিয়ে বিস্তীর্ণ কুয়াশাছন্ন সবুজ উপত্যকা দেখলাম। এটাই সাতশো পাহাড়ের দেশ। আশপাশ মানুষ জনের সঙ্গে কথা বলে আমরা এখানেই নোঙর করলাম রান্নার জন্য। এখান থেকে থলকোবাদ খুবই কাছে। আগে থেকে আমাদের ঠিক ছিল ওখানে যাওয়ার। কিন্তু এখানে এসে সুব্রতর কী হল জানি না কিছুতেই ওকে যাওয়ার জন্য রাজি করানো গেল না। অগত্যা আশপাশটা ঘুরে দুপুরের বেশ কিছু পরে একরাশ ভালোলাগা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

কভারের ছবি— মেঘাতুবুরুর ঝরনা

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *