কাশীনাথ মন্দির।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

পসার বাড়ল আয়ুর্বেদাচার্যের, হল মন্দির, মহল

দীপক দাস

অনেকগুলো হারানো সূত্রের খোঁজ মেলে। এক পরিবারের শিকড় মেলে। মেলে গ্রাম বিন্যাসের ছবি। আর পাওয়া যায়, অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া টুকরো টুকরো গ্রামচিত্র। কোনও মন্দিরের ইতিহাস মানে শুধু দেব-দেবীর পুজো প্রচলনের ইতিহাস নয়। পাতিহালের চক্রবর্তীদের কাশীনাথ মন্দিরের ইতিহাস খুঁজলে তা বেশ বোঝা যায়।

বেশ কয়েকটি প্রাচীন শিবমন্দির ছিল পাতিহালে। মিত্রগড়ে একটা মন্দির ছিল। যেটার গা জুড়ে বটগাছ শাখাপ্রশাখা চালিয়ে দিয়েছিল। এক সময়ে মন্দিরের ইট কাঠ সব ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু গাছটাই মন্দিরের অবয়ব পেয়ে গিয়েছিল। সে এক দারুণ দৃশ্য। আবার মন্দিরতলায় ছিল জোড়া শিবমন্দির। অভিধান প্রণেতা এ টি দেবদের বংশের তৈরি। এখন একটা মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

কাশীনাথ মন্দির। পিছনের দিক থেকে।

পাতিহালের মণ্ডলার চক্রবর্তীদের শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে একটি পরিবারের শ্রীবৃদ্ধির ইতিহাস জড়িয়ে আছে। যদিও চক্রবর্তীরা এ গ্রামের আদি বাসিন্দা নন। তাঁরা বর্ধমান জেলার মাজদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। চক্রবর্তীদের এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল পাতিহালে। তাঁর নাম রোহিণী দেবী। স্বামীর নাম এবং পদবি জানা যায় না। রোহিণী দেবী ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি তাঁর এক ভাইয়ের ছেলেকে দত্তক নেন। রোহিণী দেবীর ভাইপো তথা দত্তক পুত্রের নাম ছিল কালীশঙ্কর। পাতিহালে চক্রবর্তী পরিবারের তিনিই প্রথম পুরুষ। সম্ভবত তাঁর পালিকা মা অর্থাৎ রোহিণী দেবীর স্বামীর পদবি চক্রবর্তীই ছিল। কারণ দত্তক পুত্র সাধারণত পালক পিতার পদবির উত্তরাধিকারী হন।

কালীশঙ্কর ও তাঁর পুত্র রামতারক পর্যন্ত চক্রবর্তীরা পাতিহাল গ্রামের উল্লেখযোগ্য পরিবার ছিলেন না। তাঁরা সাধারণ যাজক বৃত্তিতেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। রামতারকের পুত্র কার্তিকচন্দ্রের আমলে পরিবারটির অবস্থা ফেরে। এমনটাই জানালেন গৌরমোহন চক্রবর্তী। তিনি কালীশঙ্করের পঞ্চম উত্তর পুরুষ। তিনি পাতিহাল দামোদর ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক ছিলেন। আমাদেরও শিক্ষক ছিলেন তিনি। গৌরবাবু জানালেন, কার্তিকচন্দ্র ছিলেন আয়ুর্বেদ চিকিৎসক। অসমের কাছাড়ে আয়ুর্বেদ নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। একটি ওষুধের পেটেন্টের অধিকারী ছিলেন তিনি। সেই ওষুধের নাম, ‘বিশ্বেশ্বর রস’। ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত। চিকিৎসক হিসেবে যথেষ্ট পসার করেছিলেন কার্তিকচন্দ্র। ঘোড়ায় চড়ে রোগী দেখতে যেতেন। যথেষ্ট ভূসম্পত্তি করেছিলেন তিনি। তিন মহলা বাড়ি তৈরি করেছিলেন। কার্তিকচন্দ্র আয়ুর্বেদ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু গাছগাছড়া বাড়ির পাশের জমিতে চাষ করতেন। জানালেন গৌরবাবু। বাড়িতেই ওই গাছগাছড়া থেকে ওষুধ তৈরি হত। মাটির পাত্রে সারাদিন ধরে ফোটানো হত সেই গাছগাছড়া। তার পর সেগুলো কড়ির কলসিতে রাখা হত। রোগীদের ওষুধ দেওয়া হত কড়ির কলসি থেকেই।

মন্দিরের সামনের অংশ।

পসার হল। জমি হল, বাড়ি হল। আয়ুর্বেদাচার্য কার্তিকচন্দ্র গণ্যমান্য হলেন। সে যুগে বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলোর নিজস্ব মন্দির নির্মাণের রীতি ছিল। সেই রীতি মেনেই কি কার্তিকচন্দ্র মন্দিরটি নির্মাণ করেন? গৌরবাবু জানালেন, রোহিণী দেবী শিবের পুজো করতেন। পারিবারিক সেই দেবতার কোনও মন্দির ছিল না। ছোটখাট কোনও দেবস্থান ছিল সম্ভবত। কার্তিকচন্দ্র সেই মন্দির সংস্কার করেন অথবা নতুন ভাবে তৈরি করান। বারাণসী থেকে শিবলিঙ্গ আনিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। শিবলিঙ্গ এসেছিল নৌকা করে। নৌকা সরাসরি পাতিহালেই এসেছিল। সেই সময়ে সেটা সম্ভবও ছিল। কারণ পাতিহালের অনেক ভিতর পর্যন্ত নৌকা চলাচল করত।

সংস্কারের ফলক।

কাশীনাথ বা তাঁর মন্দির কত বছরের পুরনো তা জানা যায় না। মন্দিরে প্রতিষ্ঠা ফলকটি আর নেই। ফলক যে এক সময় ছিল তার চিহ্ন মন্দিরের গায়ে রয়েছে। তবে মন্দিরে সংস্কারের একটা ফলক রয়েছে। তাতে লেখা পিতা কার্তিকচন্দ্রের স্মরণে পুলিনবিহারী চক্রবর্তী ১৩৬৬ বঙ্গাব্দে মন্দিরটি সংস্কার করেন। চক্রবর্তীদের মন্দিরটির অবস্থা এখনও যথেষ্ট ভাল। তার কারণ পরিবারটির আর্থিক সঙ্গতি। কার্তিকচন্দ্র পরিবারকে সুদৃঢ় আর্থিক ভিত্তি দিয়েছিলেন। তাঁর ছেলে অটলবিহারী এবং অটলবিহারীর ছেলে অনাথবন্ধুরও পসার ছিল। তখন প্রতিদিন ২০-২৫ জন বাইরের লোক চক্রবর্তী পরিবারে খেতেন। পরিবার এখন বহু শাখায় বিভক্ত হলেও সেই ভিত্তি বজায় রয়েছে। গৌরবাবুর ছেলে অনিন্দ্য ও অভিরূপ জানালেন, তাঁদের দাদু অনাথবন্ধু আমতার খড়িয়প, ধাইপুর, গাজিপুর, শিয়াগড়ে সম্পত্তি করেছিলেন। অনাথবন্ধু এক সময় অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলনও করেছিলেন। পাতিহাল মণ্ডলায় ফলহারিণী কালীপুজো জনপ্রিয়। এই কালী প্রতিমার দাম এখনও চক্রবর্তী পরিবার থেকেই যায়। কাশীনাথ মন্দির সংস্কার নিয়ে আরেকটি ঘটনার কথা বললেন গৌরবাবু। চক্রবর্তী পরিবারের কোনও এক সদস্য ঠিকাদার ছিলেন। এক মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। মামলায় জয় পেয়ে মন্দিরে ফলক বসান।

বংশলতিকার ফলক।

চক্রবর্তী পরিবারের মন্দিরের ইতিহাস থেকে আরেকটি বিষয় প্রতিষ্ঠা হয়। পাতিহালে কোনও জনবসতি ছিল না। এ গ্রামের সকল পরিবারই নানা কারণে বাইরে থেকে এসেছিলেন। আয়ুর্বেদাচার্যের পরিবারও।

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *