খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

নবাবজাদার প্রেমের বাখরখানি, নবাবের শাহি টুকরা

ফারুক আবদুল্লাহ

বাড়ি মুর্শিদাবাদ। ইসলামপুর নামে একটি স্থানে। লোকে তো মুর্শিদাবাদ মানেই নবাবি কাণ্ডকারখানা বোঝেন। কিন্তু মুর্শিদাবাদ মানে কি শুধু শাহি ইমারত, ইতিহাস? জেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে কত খাবার। আজ তারই কয়েকটা চাখা যাক।

স্পঞ্জের মিষ্টি

মুর্শিদাবাদের মিষ্টান্নের মধ্যে স্পঞ্জের রসগোল্লা অন্যতম। এই রসগোল্লা বর্তমানে অবলুপ্তির পথে। আজ থেকে প্রায় ৪০-৫০ বছর আগে জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে প্রায় ২৫ কিমি পূর্বে ইসলামপুরের কাছে ঘোষপাড়া কলাডাঙ্গায় ফটিক সরকার নামে এক মিষ্টান্ন শিল্পী এই স্পঞ্জের রসগোল্লার উদ্ভাবন করেন। টাটকা গরম ছানা থেকে এই রসগোল্লা তৈরি করা হয়। সেই ফটিক সরকারের সেই দোকান বর্তমানে না থাকলেও ইসলামপুর এলাকার কিছু দোকানে এখনও মাঝে মাঝে স্পঞ্জের রসগোল্লার দেখা মেলে। আমার বাড়ির এলাকার মিষ্টি।

স্পঞ্জের রসগোল্লা।

ছানাবড়া

এটিও লালবাগ ও মুর্শিদাবাদ জেলার প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন। অনুমান করা হয় যে উনিশ শতকেই এই মিষ্টান্নে প্রচলন হয়েছিল। কথিত রয়েছে বাংলার  নবাবদের নাকি ছানাবড়া অতি প্রিয় ছিল। উৎকৃষ্ট ছানাকে ভাল করে বেটে তাতে এলাচ দানা মিশিয়ে গোল গোল করে ছানাকে ফুটন্ত ঘিয়ে ভাজা হত। এর পর তা লাল কিম্বা কালচে রঙ হলে এই ভাজা বলগুলোকে চিনির রসে ফেলতে হবে এবং কিছুক্ষণ রসে রাখার পর তা পরিবেশন যোগ্য হয়ে ওঠে। এই সুস্বাদু ছানাবড়া কে উদ্ভাবন করেছে জানা না গেলেও লালবাগের আদি মিষ্টান্নের দোকান ছিল নিমাই মণ্ডলের। কথিত রয়েছে যে এই নিমাই মণ্ডলের দোকান থেকেই নাকি নাবাব বাড়িতে নিয়মিত ছানাবড়া সরবরাহ করা হত। এছাড়াও ছানাবড়ার বিখ্যাত কারিগর ছিলেন সৈদাবাদের পটল উস্তাদ। কিন্তু বর্তমানে ছানাবড়া তার পূর্ব গৌরব হারাচ্ছে ক্রমশ।

ছানাবড়া।

বাকরখানি

এক বিয়োগান্তক প্রেম কাহিনি লুকিয়ে বাকরখানি নামের মধ্যে। মুর্শিদাবাদের মানুষ চায়ের সাথে ‘বাখোর’ বিস্কুটের সঙ্গে অভ্যস্ত হলেও অনেকেই আমরা বাকরখানির নাম জানি না। অথচ এই বাখোর বিস্কুটেরই আদি নাম বাখোরখানি। যদিও পূর্বের বাখোরখানির সঙ্গে আজকের ভাটিতে তৈরি বাখোর বিস্কুটের কোনও তুলনাই চলে না।

বাখোরখানি ছিল ময়দা দিয়ে তৈরি রুটি জাতীয় খাবার বিশেষ। ময়দার খামির থেকে রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হত। জনশ্রুতি অনুসারে, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের খাঁর নামানুসারে এই রুটির নামকরণ করা হয়েছে।

বাখরখানি।

নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের। প্রখর মেধার অধিকারী আগা বাকের যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের প্রেমে পড়েন। কিন্ত উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান ছিল পথের কাঁটা। সে খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি জয়নাল খানকে প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করে এবং খবর পেয়ে বাকের সেখানে যান ও তলোয়ারবাজিতে জয়নালকে হারিয়ে দেন। অন্যদিকে জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। উজির ছেলের হত্যার বিচার চায়। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ পুত্র বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। ইতিমধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে গেছে ও সে জোর করে খনি বেগমকে ধরে নিয়ে গেছে দক্ষিণবঙ্গে। উদ্ধার করতে যান বাকের খনি বেগমকে। পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। ছেলে জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেষ্টা করলে উজির নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। এই অবস্থাতে জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে। ঐতিহ্য্যবাহী বাকরখানি রুটির নামের পেছনে রয়েছে বাকের খান এবং খনি বেগমের নাম। আসলে বাকের খাঁন হয়তও তাঁর প্রেমকে অমর রাখতেই রুটির নাম তার এবং তার প্রেমিকার নামে রাখেন বলেই অনুমান করা যেতে পারে। এতকাল মুর্শিদাবাদের নাবাব পরিবারে বাখরখানি রুটির জনপ্রিয়তা থাকলেও বর্তমানে সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। এর কারণ হিসেবে নতুন প্রজন্মের চাহিদার অভাবকেই দায়ী করা যেতে পারে।

শাহি টুকরা

মুর্শিদাবাদের নবাবদের পছন্দের খাবারগুলোর মধ্যে শাহি টুকরা হল অন্যতম। কথিত রয়েছে, মুর্শিদাবাদের নাবাব ওয়াশেফ আলি মীর্জার অত্যন্ত পছন্দের খাবার ছিল এই শাহি টুকরা।

শাহি টুকরা।

এটি খুব সহজেই তৈরি করা যাই। এটির মূল উপাদান হল পাউরুটি । এছাড়া লাগবে ঘি, পেস্তা, বাদাম, কিসমিস, মধু ও জাফরান। মুর্শিদাবাদের স্বল্প কিছু মিষ্টির দোকানে এখনও এই শাহি টুকরার দেখা মেলে। আমি দোকানের নয়, শাহি ঘরানার মিষ্টিই চেখেছিলাম। শাহি টুকরা খাইয়েছিলেন বাংলার শেষ নবাব নাজিম ফেরাদুন জাঁয়ের বংশধর নাফিসা নিসা নাসির।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *