বড়দিন
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

বড়দিনের সকালে এক গ্রামীণ গির্জায়

ঋতুপর্ণা ঘোষ

আমরা বড় শহুরে মানুষ। শহরের কোলাহল, বিভিন্ন কাজ, নিজেদের ব্যস্ততায় প্রকৃতির কাছে যাওয়াই হয় না। ব্যস্ততার মাঝে মনটা কিছুদিন ধরেই উড়ু উড়ু ছিল। তাই হয়ে গেল এক হঠাৎ ভ্রমণ।

বড়দিনের আগের দিন। হঠাৎ ঠিক হল, পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া হবে। এখন কর্মক্ষেত্রে ছুটি। দিনটাও বেশ উৎসবের। বেরিয়ে পড়া যেতেই পারে। কিন্তু যাবটা কোথায়? তা জানি না। তবে এটুকু জানি, শহর থেকে দূরে হারিয়ে যাব কোথাও। একটা দিনের জন্য।

গ্রামের সেই ধুলো মাটির পথ।

নির্ধারিত ২৫ ডিসেম্বর সকালে বেরিয়ে পড়া হল। বহরমপুরের রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সেতু থেকে। বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন। সঙ্গী সন্তু, অনির্বাণ এবং শুভঙ্কন। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক পেরিয়ে পড়ল শিল্পতালুক। একটা মন্দির দেখতে পেলাম। পরিষ্কার, সুন্দর পরিবেশ। মন ভাল করে দেয়। কিন্তু মন খারাপ হল পরক্ষণেই। এক পাশে চাষের জমি। অন্যদিকে একটি কারখানা। আশেপাশে নির্মাণ কাজ চলছে। পরিকল্পিত কিছু নাগরিক সুখ ভোগের কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। শোনা যায়, রিসর্ট, সিনেমা হল হবে এখানে। সহজেই বুঝলাম, এই নির্জন স্থান, মন্দির আর বেশি দিন এমন থাকবে না। কোলাহল আর কংক্রিটের জটাজালে ঢেকে যাবে।

তালসারি।

বাইক আবার ছুটল। সকাল সকাল বেরিয়েছি। বড়দিনের কেক খাওয়া হয়নি। কিছু খাওয়াও হয়নি। তাই খুব খিদে পেয়েছিল। পেটে দানাপানি দিতে হবে। জাতীয় সড়কের ধারে একটা ধাবা দেখতে পেলাম। সেখানেই চারজনে সেরে নিলাম প্রাতরাশ। পেট পুরে খেয়ে আবার যাত্রা শুরু।

দিয়ারা গ্রাম।

এবার আমাদের গন্তব্য ঠিক করা হল, দিয়ারা ও সাহাপুর গ্রাম। যাত্রাপথে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। গ্রামের ভিতর দিয়ে মাটির পথ। পথ না বলে একে নাগরদোলা বলাযই ভাল। হেলতে দুলতেই গুগল ম্যাপকে সঙ্গী করে একসময় এসে পৌঁছলাম দিয়ারা গ্রামে। এই গ্রামে একটি গির্জা রয়েছে। নির্জন পরিবেশে গির্জাটি বেশ ভাল লাগল। ধান কাটা হয়ে গিয়েছে। কিছু জমিতে সরষে চাষ হয়েছে। ধান ঝাড়ার পরে খড়ের আঁটিগুলো ডাঁই হয়ে আছে রাস্তার পাশে। ধান শুকোচ্ছে রাস্তায়। একটা ছোট্ট পুকুর ঘিরে তাল গাছের সারি। কত ছোট ছোট দৃশ্য মনে গেঁথে গেল বড়দিনের সকালে। বড় সুন্দর সেই সব দেখা।

প্রকৃতি সেজেছে এখানে এমনই।

মুর্শিদাবাদ জেলার নবগ্রাম ব্লকের অন্তর্গত দিয়ারা গ্রাম। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। শোনা যায়, সুলতান হুসেন শাহের আমল থেকেই এই জায়গায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসতি স্থাপন করে আছেন। ঔপনিবেশিক কালে সারা দেশে মিশনারিরা খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার শুরু করেন। প্রচার শুরু হয় মুর্শিদাবাদেও। সেই সময়ে এই এলাকার বাসিন্দারা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই থেকেই এখানে গড়ে ওঠে ক্যাথলিক গির্জাগুলো। দিয়ারা আর সাহাপুরে। গির্জাকে কেন্দ্র করে কিছু বিদ্যালয়। জাতীয় সড়ক থেকে বেশ কিছু দূরে এই গ্রামগুলোয় এখনও অনেকটা পিছিয়ে পড়া। অনেক কিছুর অভাব রয়েছে। এলাকাবাসীর প্রধান জীবিকা হল, কৃষিকাজ, মাছ ধরা। দিয়ারা গির্জার পিছনে গাছগাছালি ঘেরা সুন্দর পরিবেশে রয়েছে সমাধি ক্ষেত্র।

বড়দিনের সাজে দিয়ারা গির্জা।

গ্রামটি কিন্তু ছবির মতো সুন্দর করে সাজানো। মাটির বাড়ি, চাষের জমি, পুকুর দিয়ে ঘেরা গির্জায় বড়দিনের আয়োজন চলছে দেখলাম। সুন্দর সরল আয়োজন। গ্রামের মানুষেরা উৎসবে মেতেছেন নিজেদের মতো করে। মাদল বাজিয়ে স্থানীয় ভাষায় গান বাজনা করে তাঁরা পালন করছেন বড়দিন। নতুন জামা পরে হাসি খুশি মানুষগুলো দেখছিলেন আমাদের। গ্রামে বড়দিনের উৎসব পালন করতে এসেছে কারা এরা! ওঁদের সঙ্গে ছবি তুলে, লজেন্স, কেক খেয়ে ভাললাগায় ভরে গেল মন। এক সুন্দর অনুভূতি।

গির্জার পিছনে সমাধি ক্ষেত্র।

সরলতাই যেন উৎসবের প্রাণ। শহুরে মেজাজের বাইরে প্রকৃতির কোলে বড়দিনের সকালটা বড় ভাল কাটল। দিয়ারা গ্রামের ওই ছোটো বাচ্চাদের মিষ্টি হাসি মুখগুলো অনেক দিন থেকে যাবে আমাদের মনে।

একটি গ্রামীণ দৃশ্য।

কভারের ছবি— দিয়ারা গির্জা

ছবি— সন্তু ঘোষ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *