অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মালদা থেকে হিলি সীমান্ত, ভায়া মধুচক্র— কাঁটাতার পর্ব

দীপক দাস

মধুচক্র পেরিয়েই দেখা হয়ে গেল আত্রেয়ীর সঙ্গে। নামে চেনা। মিষ্টি নামের একটা নদী। সুবীর তার খবর পাঠাত। মাজিদুর ছবি। বিগত যৌবনা আত্রেয়ীর একাকী বেঁচে থাকার খবর। চলায় বিভঙ্গ নেই। শরীরে জলজ ঔজ্জ্বল্য, উচ্ছ্বাস, কিছুই নেই। তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। চলে আন্দোলন। যেমন করে এখন পরিত্যক্ত বৃদ্ধ মা-বাবাকে রক্ষা করতে সামাজিক ভাবে উদ্যোগী হন কয়েকজন। মহামান্য আদালতকে রায় দিয়ে বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনের শিক্ষা দিতে হয়। একাকী আত্রেয়ীর সেইরকম খবরই করত সুবীর-মাজিদুর।

লেখার সময়ে গভীর রাতে সুবীরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বেচারা সারাদিনের পরে হয়তো একটু সামাজিক হয়েছিল। আমি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছিলাম। সুবীরই বলল, আমরা যে বদ্ধ স্রোতস্বিনীকে দেখেছিলাম, ওটা আত্রেয়ী খাঁড়ি। পরে সংস্কার করা হয়। এখন নাকি তার রূপ, অপরূপ। সরকার ইচ্ছে করলে ওই খাঁড়িকে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করতে পারে। অন্তত ইউরোপ, আমেরিকার কোনও দেশ হলে তাই করত। ওই সব দেশে শহরের মাঝে বয়ে চলা ক্যানালগুলো থেকেও তো অর্থ উপার্জন হয়। তবে পরিবেশ অবিকৃত রেখেই। হয়তো কোনও দিন এখানেও হবে। সরকার বাহাদুর অনেক বড় ব্যাপার। তার মনের নাগাল কি সহজে মেলে!

‘যথা ইচ্ছা…’র পাঠকদের মনে হতে পারে, বালুরঘাট ছাড়িয়ে গেলাম অথচ ইন্দ্র, দীপু, বাবলা, শুভ কেউ এল না লেখায়? এর একটাই কারণ। দীপু তখনও নাবালক। একাদশ শ্রেণির ছাত্র। আমার কাছে বাংলা পড়ে। বন্ধুত্বের পর্যায়ে ওর উত্তরণ ঘটেনি। শাস্ত্রে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতে বলেছে। শুভর দ্বাদশ শ্রেণি। ও তখন শুধু আমার ভাইয়ের বন্ধু। এখন সে রেলের গার্ডবাবু হয়েছে বিশাল একটা মালগাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে। বাবলা আবার ওদের বন্ধু। শুধু ইন্দ্রই তখন বন্ধু। ও অবশ্য মালদায় এসেছিল। সে গল্প পড়ে করা যাবে।…

গাড়ি তখন প্রবল বেগে ছুটছে। একটানা গাড়ি চালিয়ে ঘুম পেতে পারে। সেজন্য একবার চালক বদল হল। দু’জনের হাত খুবই পাকা। আমরা টুকটাক গল্প করছি। গল্প জমছে না। কারণ আমি হাঁ করে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। খবরে পড়া জায়গার নামগুলো এক এক করে পেরিয়ে যাচ্ছে। সকালের আলোয় টুকরো টুকরো ছবি তৈরি হচ্ছে। সেগুলো মনে রাখার চেষ্টা করছি। কথায় কথায়, দিলীপদা বললেন, আকাশ পরিষ্কার থাকলে রায়গঞ্জ থেকে নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। পরে শুনেছি, ওটা নাকি একটা মিথের মতো। সত্য মিথ্যে যাচাই করার সুযোগ হয়নি আর। সুমন্তর বাড়ি তপন ব্লকে। ও নিজের এলাকার সমস্যার কথা বলছিল। নানা সমস্যা। সেটা ততদিনে বুঝে গিয়েছিল। রাজধানী শহর থেকে যতদূরে যাবে উন্নয়ন তত ফিকে হতে থাকবে। মানে সাধারণ ভাবে উন্নয়ন বলতে যা বোঝায়। রাস্তা, বাড়ি, এখন একটা মার্কেট কমপ্লেক্স এই সব আরকী। তপনে জলের খুব সংকট। গরমের আগে থেকেই খবর হতে শুরু করে জল নেই জল নেই। এখন অবস্থা বদলেছে কিনা কে জানে!

তপন ব্লকে মেয়েদের জলকষ্ট। এভাবেই জল আনতে হাঁটতে হয় বেশ কয়েক কিলোমিটার। ছবি— মাজিদুর সরদার।

এই খানে এসে আবার একবার ধাক্কা খেতে হয়। আমরা দিলীপদার বাড়ি পৌঁছেছিলাম কোন রাস্তা দিয়ে? দিলীপদার সঙ্গে যোগাযোগ দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন। সফরসঙ্গী সুমন্তকে ফোন করলাম। ও বলল, বালুরঘাট থেকে আমরা বাস ধরেছিলাম। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, গাড়ি বালুরঘাট শহর ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়েছিল। সকালে মাঠের মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তায় গাড়ি ছুটছিল। তারপর এক জায়গায় নেমেছিলাম। সেই জায়গাটা গাড়ি চালক অজয়ের বাড়ি। ওখান থেকে বাস ধরেছিলাম। সুমন্ত বলল, ‘তাহলে ওটা হোসেনপুর।’ এখানে আমাদের নামিয়ে অজয়রা বাড়ি চলে গিয়েছিল। আমরা তিনজন বাসে করে ত্রিমোহিনী পৌঁছলাম। ত্রিমোহিনী মানে তিন মাথার একটা মোড়। সেখান থেকে হাঁটা পথে দিলীপদার বাড়ি।

মনে আছে, বৌদি আমাদের পায়েস মুড়ি খাইয়েছিলেন জলখাবারে। বেশ ভাল। খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে পাড়া ঘুরতে বেরোলাম তিনজনে। অনেক জায়গাতেই গিয়েছিলাম। দিলীপদার এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। দেখা করেছিলাম রবীন মুর্মুর সঙ্গে। রবীন ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদে’র হিলির রিপোর্টার। ওকে বলা হল, আমাদের সীমান্ত অভিযানের ইচ্ছার কথা। ও বাইক জোগাড় করে রাখবে বলল। দিলীপদা আমাদের নিয়ে গেলেন হাটে। কোনও এলাকায় গেলে সেখানকার হাটবাজারটা আমরা ঘুরে দেখার চেষ্টা করি। একবার বাসে করে দুমকা থেকে রামপুরহাট আসার সময়ে নেমে পড়েছিলাম সারসডাঙ্গালের হাটে। বাজারহাট দেখলে এলাকার চরিত্র বোঝা যায়। কত রকম লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়। ত্রিমোহিনীর হাট বেশ লাগল আমার। একেবারেই ছিমছাম হাট। একটা চাতালের মতো উঁচু জায়গা। সেখানে বসে মাছওয়ালারা মাছ বেচছেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে তরিতরকারি। দিলীপদা বেশ বড়সড় একটা মৃগেল কিনলেন। এলাকার কোনও পুকুরের টাটকা মাছ। ঝকঝকে ভাব দেখলেই বোঝা যায়, সার, ওষুধে বড় করা নয়।…

খেয়েদেয়ে বিশ্রাম হল। সেই মাছের তরকারি। বেশ সুস্বাদু। একটু বিশ্রাম নিয়ে গেলাম দিলীপদার পুরনো বাড়িতে। হাঁটতে হাঁটতে, মাঠের ওপর দিয়ে। সেই অনেকবার বলা কথাটা আবার বলতে হয়, বড় সড়কের আশপাশের পরিবেশ দেখে কখনও কোনও এলাকার চরিত্র বিচার করা উচিত নয়। ওই ভিড় কৃত্রিম। জটলা ছাড়িয়ে ভিতরে ঢুকলে আরেকটা পরিবেশ দেখা যাবে। সেটাই আসল। প্রকৃত মুখ। জটলাটা ফেয়ারনেস ক্রিমের মতো ভুয়ো।

দিলীপদার পুরনো বাড়ি খুব সুন্দর। তকতকে নিকানো মাটির দাওয়া। টিনের চাল। মুখোমুখি ঘর। মাঝে এক চিলতে উঠোন। একটা লতানে গাছ কঞ্চিতে ভর করে চালে উঠেছে। গাছটা চিনতে পারলাম। গাঁদাল গাছ। সাধারণত রোগীর পথ্য। টেনিদার গল্পের প্যালারামের জন্য বিখ্যাত। তবে আমার খুব ভাল লাগে। মসুর ডাল বাটা দিয়ে বড়া। গরম ভাত, গাঁদাল পাতার বড়া, একটু ডাল আর লেবু হলেই দুপুরের আহার অমৃত। শুধু খাওয়া দাওয়ার ঘণ্টা দুই আড়াই পর থেকে একটু সতর্ক থাকতে হয়। লোকজনের অসুবিধের কথা ভেবে। দিলীপদার পুরনো বাড়িতে মা আর ভাইয়েরা থাকেন। মায়ের সঙ্গে দেখা হল। ভাইপো, ভাইঝিদের টফি দিলেন দিলীপদা।…

ত্রিমোহিনী মোড়। এখন। তখন অবশ্য এত জমজমাট ছিল না। ছবি— রবিন মুর্মু

বিকেলের আগেই যাত্রা শুরু হল। দু’টো বাইকে পাঁচ জন। আমি, দিলীপদা, সুমন্ত, রবিন মুর্মু আর রবিনের এক বন্ধু। বাইক ছুটল সীমান্তের দিকে। কাঁটাতারের গা ঘেঁষা পাকা রাস্তা। মাঝে মাঝে একজন করে বিএসএফ রক্ষী রাইফেল কাঁধে দাঁড়িয়ে। সেই প্রথম ছিটমহল দেখলাম। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে ভারতীয় গ্রাম। ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’এ সেই সময়ে একটা সিরিজ হয়েছিল। ওরা থাকে ওধারে। ছিটমহলের বাসিন্দাদের জীবনের ছবি। দক্ষিণ দিনাজপুর নিয়ে লিখেছিল সুবীর মহন্ত। ছবি মাজিদুর। উত্তর দিনাজপুর নিয়ে অলিপ মিত্র। দুই দিনাজপুরের টিমটা অসাধারণ কাজ করেছিল। আগে শুনেছিলাম, পড়েছিলাম ছিটমহলের বাসিন্দাদের কথা। এবার চাক্ষুস দেখলাম। শ্রীরামপুর, শ্রীকৃষ্ণপুর, উত্তর জামালপুর, উঁচা গোবিন্দপুর, নিচা গোবিন্দপুর, আগ্রা পার হয়ে গিয়ে পড়লাম হিন্দু মিশনপাড়ায়।

দূরে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাস্তা। বেশ ঝকঝকে দু’চারটে গাড়ি গেল। দু’ধারে বড় বড় বনস্পতির ছায়ায় বনবীথি তৈরি হয়েছে। আমি নিশ্চিত, ওই মহীরুহগুলো স্বাধীনতার আগে থেকেই ছিল। ফুল ফুটিয়েছে। ফল ছড়িয়েছে। কিছু ফলের বীজ থেকে গাছ হয়েছে। তারপর একদিন দেশ স্বাধীন হল। কিছু বৃক্ষগুলোর কিছু সন্তান রয়ে গেল এপারে। যেমন আমি। জানি, ওই রাস্তা ধরে চলতে থাকলে একদিন হয়তো বরিশালে পৌঁছে যাব। যেখানে আমার কোনও দিন না দেখা পূর্বপুরুষের ভিটে রয়েছে। আমার ঠাকুরদা একদিন দেখতে গিয়েছিল তেরো বছরের ঠাকুমাকে। বিয়ে করেছিল। তারপর একদিন এক মেয়ে, বউ আর ভাইকে নিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিল ধুবুলিয়া ক্যাম্পে।

কভারে আত্রেয়ী খাঁড়ি। ছবি— সুবীর মহন্ত

(চলবে)

 

প্রথম পর্ব পড়তে হলে…

মালদা থেকে হিলি সীমান্ত, ভায়া মধুচক্র

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *