মুণ্ডেশ্বরী, হুগলি
জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

মন্দির পেরিয়ে মুণ্ডেশ্বরীর কাছে

দীপক দাস

যেখানে বসে নিজস্বী তুলছিলাম সেটা একটা স্মৃতিক্ষেত্র। এক জমিদার পরিবারের প্রয়াত সদস্যদের স্মৃতিতে মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। অনেকগুলো স্মৃতিমন্দির রয়েছে একটা ছোট চত্বর ঘিরে। প্রতিষ্ঠার সময়ে নিশ্চয় ঝাঁক হয়েছিল খুব। কিন্তু সে সব ফুটিফাটা, রংচটা, হেলে পড়া। স্মৃতিমন্দিরের পরিচয়জ্ঞাপক ফলকের রং বিবর্ণ হয়েছে। শিবমন্দিরও রয়েছে কয়েকটা।

স্মৃতিমন্দির চত্বরের পাশেই রয়েছে একটি জলাশয়। মজে যাওয়া পুকুর। বাঁধানো ঘাট দেখে বোঝা যায় একসময়ে গুরুত্ব ছিল। এই ঘাটের শ্যাওলা ধরা ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে খেয়াল এল। সীমানা ছাড়ালে কেমন হয়? সীমানা শব্দটার উপরে এমনিতেই বেশ ভয় আমার। ছোটবেলায় বড়রা ধমকাতেন, সীমা ছাড়িয়ো না বাছা। সে সীমা অনেক। তখন ভাবতাম, বড় হয়ে নিশ্চয় এত সীমার অনেকগুলোই আর আমাকে আটকাতে পারবে না। এখন সেই ভ্রান্তি কেটেছে। তবুও সীমানা ছাড়াতে সাহস হয় মাঝে মাঝে। এই আজ যেমন হল।

এক ভিলেনের সেই বাইক।

কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? আমরা যেখানে রয়েছি সেটা ঝিকিরা। এখানে অনেক মন্দির আছে শুনে দেখতে এসেছিলাম। মন্দির দেখা হয়েছে। কিন্তু এখনই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। অনেকদিন পরে বেরিয়েছি। করোনার প্রকোপ তখন কমেছিল। সরকারি তেমন বিধিনিষেধ ছিল না গত নভেম্বরে। ফলে বেরিয়ে পড়া। কোথায় যাওয়া যায়? এদিক দিয়ে মেদিনীপুর যাওয়া যায় শুনেছিলাম। পশ্চিম মেদিনীপুর এদিকে পড়ে। কিন্তু অত দূর কি যাওয়া যাবে? এক বৃদ্ধ যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে মেদিনীপুরের সীমানা ছোঁয়ার দূরত্বটা বোঝার চেষ্টা করলাম। মেদিনীপুর আজ নাগালের মধ্যে আনা যাবে না। কিন্তু হুগলি জেলাকে আনা যেতে পারে। পলাশপাই নামে জায়গাটা হুগলি জেলার মধ্যে পড়ে। সেখানে নদীও আছে। সঙ্গী দীপু আর ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওরা যেতে রাজি কিনা। ওরা জানাল, সীমানা ছাড়াতে ওদের কোনও আপত্তি নেই।

হেল্থ পয়েন্ট হাওড়ায়। ওই যে অধিকারী উনি হুগলির।

বাইক ছাড়ল। গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। মাঠ, বসতি, মাঠ পেরোতে পেরোতে একটা তিনমাথার মোড়ে এসে থেমেছিলাম। মোড়ের মাথায় একটা হোটেল। পলাশপাইয়ের পথ জিজ্ঞাসা করা হল হোটেলে। ফিরে এসে দেখি, ইন্দ্র ওর মোবাইলে এক মনে একটা বাইকের ছবি তুলছে। দামী কোনও বাইক নয়। দর্শনধারী। মোপেড বাইক। কিন্তু মালিক সেটিকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। এক জায়গায় লেখা দেখলাম, ‘এক ভিলেন’। প্রচার সর্বস্ব যুগে সকলেই নিজেকে নায়ক ভাবতে চায়। নিজেকে ভিলেন ভাবেন এমন লোকের সন্ধান পেয়ে বিস্মিত হলাম।

রথতলার চার মন্দির।

বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। সে বিস্ময় সীমানার। আমরা যে মোড়ে দাঁড়িয়েছিলাম সেটা হাওড়া ও হুগলি জেলার সংযোগস্থল। হোটেলের দিকটা হাওড়া। উল্টো দিকটা হুগলি। হাওড়া থেকে হুগলি বহুবার ঢুকেছি। কিন্তু সীমানা পার হয়েছি ফাঁকা মাঠ ধরে বা নদী পার করে। আমাদের বাড়ি থেকেও হুগলির সীমানা কাছে। কিন্তু দু’হাত ছাড়িয়ে হুগলি এই প্রথম। মোড় পেরিয়ে রথতলায় সীমানায় দাঁড়িয়ে সাক্ষী হলাম। একদিকে হাওড়ার ঝিখিরা-জয়পুরের রথতলা। অন্যদিকে গ্রাম+পোস্ট পলাশপাই, হুগলি।

সীমানায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আবার রওনা দিলাম আমরা। কিছুটা দূরে দীপু আবিষ্কার করল একগুচ্ছ মন্দির। রাস্তার পাশে একটা ঘেরা জায়গায় পাশাপাশি চারটি মন্দির। ওই চত্বরে একটি পুরনো বাড়ি আছে দেখলাম। বাড়ি না বলে প্রাসাদই বলা ভাল। বাড়ির কাছে একটি টিনের চালের চত্বর। অনেকটা হাট বা চণ্ডীমণ্ডপের চালার মতো। সম্ভবত ওই বিশাল বাড়ির মালিকেরাই এই মন্দির আর চালা বানিয়েছিলেন। এই এলাকাটা হাওড়ার মধ্যে পড়ে। কিন্তু কাদের এলাকা সেটা জানতে পারলাম না। মন্দিরগুলোয় কোনও ফলক নেই। রাস্তার দোকানপাটও বন্ধ।

পলাশপাই-খুনিয়াচকের সাঁকো।

ঝিখিরা এলাকার শেষ মন্দিরগুলো দেখা হয়ে গিয়েছে। এবার মুণ্ডেশ্বরী। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনিও দেখা দিলেন। শীর্ণকায়া, নষ্ট জলের নদী। একটা বাঁশের সাঁকো দুই পারের সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। চলাচলের জন্য বাঁশের উপরে কাঠের পাটাতন দেওয়া। পার হতে গেলে টোল দিতে হয়। পার হলাম। দীপু আর ইন্দ্র বাইক রেখে এসে ছবি তুলতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে একজন চলে এলেন। ইনি ওপারের টোল আদায় চৌকিতে ছিলেন। এসেই জিজ্ঞাসা, ‘‘কী ব্যাপার? ছবি তুলছেন কেন? রিপোর্টার নাকি?’’ আমরা বোঝানোর চেষ্টা করলাম, শখের কারবারি আমরা। খবরের নই। বিশ্বাস করলেন বোধহয়। কারণ আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।

খুনিয়াচকের মুণ্ডেশ্বরী।

জায়গাটার নাম খুনিয়াচক। এমন ভয়ঙ্কর নাম কেন? আগে কি? টোলের ভদ্রলোক একটু লাজুক হেসে বললেন, ‘‘অনেকদিন আগেকার সেসব। এক সময় হত।’’ মুণ্ডেশ্বরী নদীতে সাঁকোর কাছে একটা নৌকা বাঁধা। মাছ ধরেন লোকজন। আরেক দিকে অর্ধনির্মিত একটা সেতু। কেন হয়নি সমাপ্ত? ভদ্রলোক বললেন, ‘‘তা জানি না। আমরা অনেকবার আবেদন করেছি।’’ সেতু তৈরি হলে কি দু’দিকের ঘাটের যাঁরা ইজারা নিয়েছেন তাঁদের ক্ষতি হবে? তিনি জানালেন, বরং লোকের সুবিধে হবে। এই ঘাটটি তাঁরা কয়েকজন মিলে ইজারা নিয়েছেন। ডাক পেতে যা খরচ হয় তা টোল থেকে উঠে আসে না। কিন্তু লোকজনের দিকে চেয়েই এ কাজ করেন। বোঝা গেল, ইনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জিজ্ঞাসা করতে সম্মতি জানালেন।

খুনিয়াচকের অসমাপ্ত সেতু।

বেশ কিছুক্ষণ গল্প হল ভদ্রলোকের সঙ্গে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে এলাকা জলের তলায় চলে গিয়েছিল। জলস্তর ছুঁয়েছিল সাঁকো। ওঁরা সারারাত জেগে সাঁকো পাহারা দিয়েছেন। ভেঙে গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে যাবে। হাওড়া ও হুগলির এই দিকটা নদী, খাল বেশি। ফলে বাঁশের সাঁকো বেশি। সেটাই হয় একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। ভাটোরার দ্বীপাঞ্চলে গিয়ে আমরা দেখেছি এমন সাঁকো নির্ভর জীবন।

ভদ্রলোক যে আমাদের কথা বিশ্বাস করেছিলেন তার আরেকটা প্রমাণ পেলাম। বললেন, আরেকটু এগিয়ে যেতে। সেখানেও নদী আছে। আর সেখানে সিনারি ভাল হবে। কথা শুনলাম আমরা। পথে মুণ্ডেশ্বরী মুণ্ডেশ্বরী জিজ্ঞসা করতে করতে হাজির নদীর কাছে। জায়গাটার নাম নতিবপুর। সত্যি অন্যরকম রূপ এখানের মুণ্ডেশ্বরীর। আমরা মুণ্ডেশ্বরীকে অনেকবার দেখেছি। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের কৈজুড়ি ঘাট পেরিয়ে হুগলির পানশিউলি মাড়োখানা বাজার হয়ে মুণ্ডেশ্বরী দেখেছিলাম। সব জায়গাতেই সে শীর্ণ। কিন্তু নতিবপুরের মতো এত বিশাল চড়া কোথাও দেখিনি। এই চড়া নদীর বার্ধক্যের ফল। মানে নিজের দেহের ভার আর বইতে পারছে না সে। যেমন করে জীবনের লড়াই লড়তে ক্লান্ত প্রবীণেরা একসময়ে প্রায় স্থবির হয়ে যান। কিন্তু এই চড়া নদীর অন্যরকম সৌন্দর্য এনে দিয়েছে।

নতিবপুরের মুণ্ডেশ্বরী ও চর এলাকা।

নতিবপুরেও মুণ্ডেশ্বরীর উপর পারাপারের একটা বাঁশের সাঁকো রয়েছে। এ সাঁকো খুনিয়াচকের সাঁকোর প্রায় আড়াই তিনগুণ। টোল দিয়ে ওপারে চলে গেলাম। একপাশে বাইক দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা শুরু হল। চরের বালির উপরে হাঁটা, পায়ে পায়ে বালি ছড়ানো। দীপুকে পোজ দিচ্ছিলাম। দেখে ইন্দ্রও দাবি করল ওরও ছবি তুলে দিতে হবে। ওরা ছবি তুলতে ব্যস্ত হল। আমি চারদিকটা দেখতে শুরু করলাম।

নতিবপুরের সাঁকো।

নদী প্রায় মরে গেলেও মানুষের সঙ্গে সংযোগ এখনও ছিন্ন হয়নি। নদীতে মাছ ধরে লোক। একটা সাদা ছোপ মাছরাঙা নদীর উপরে বাতাসে এক জায়গাতেই ডানা ঝাপটাচ্ছে। মাছের খোঁজে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছে। এদিক ওদিক করে খানতিনেক নৌকা বাঁধা দেখলাম। ব্যবহার হয় নিশ্চয়। নদীর উপরে সাঁকোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রচুর লোকজন, বাইক, চার চাকা পার হচ্ছে। বর্ষায় নিশ্চয় এ নদী অন্য রূপ ধরে। যেমনটা ধরে মালদার মহানন্দা। পুরনো মালদার দিকে থেকে ইংরেজবাজারে আসার স্মৃতি মনে পড়ছিল। বছরের অন্য সময়ে এই মুণ্ডেশ্বরীর মতোই। বর্ষায় এপার ওপার ছোট হয়ে আসে। নৌকায় ভুটভুটি লাগাতে হয়।

এমন ভাবেই বেঁচে রয়েছে মুণ্ডেশ্বরী।

দিগন্তে সূর্য তখন লাল হয়ে গিয়েছে। এবার ঘরে ফেরার পালা। মুণ্ডেশ্বরীর গোধূলি পিছনে ফেলে আমরা এগোতে শুরু করলাম।

ভারের ছবি— নতিবপুরের মুণ্ডেশ্বরীর চর

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *