ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

ইস্টিশন ইস্টিশন— পঞ্চম পর্ব

দীপক দাস

কোনা— নগর পেরিয়ে গ্রাম

শিব্রাম চক্রবর্তীর কি যোগ আছে কোনা নামে জায়গাটির সঙ্গে? তাঁর আত্মজীবনী ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’য় কোনা নামটি মেলে। সেটা কোন কোনা কে জানে! শিব্রামও সংশয়ে ছিলেন। বংশ পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘মাতৃকুলে দাদামশায়ের নাম জানতাম, ভুলে গেছি এখন। বেণীমাধব চৌধুরী না কে। কোন্ না কোথাকার জমিদার ছিলেন, নেহাত জমিদার না হলেও কোনা বলে কোনো জায়গার ভারী জোতদার জাতীয় ছিলেন বোধহয়’।

শীতের ভোরে কোনা। ছবি বিল্টু দে-র তোলা।

এই কোনা হাওড়ার নাকি অন্য কোনও জেলার কোণে, তা জানি না। খোঁজ করা হয়নি কোনওদিন। কিন্তু আমার গুরুদেবের সঙ্গে হাওড়ার যোগ আছে, এটা ভেবেই ভারী পুলকিত আমি। কোনা স্টেশনকে অবশ্য আরও একটা কারণে ভাল লাগে। স্টেশনের আগে-পিছের প্রকৃতি। কলেজে পড়ার সময় থেকেই ভাল লাগত। স্টেশনের ঢোকার আগে দু’দিকের সবুজ চোখ টানে। চাষআবাদও হয়। শরৎকালে কাশ ফুল ফোটে অনেকটা জায়গা জুড়ে। স্টেশন ছাড়ালে রেললাইনের দু’দিকেই ঝিল। গরমকালে ট্রেনের কামরায় ভ্যাপসা, দমবন্ধ অবস্থা। কিন্তু ট্রেন ওই ঝিলের পাড়ে এলেই মৃদু একটা হাওয়া গায়ে লাগে। প্রাণ জুড়োয়। স্টেশন ছাড়িয়ে একটু ট্রেন এগোলে আরেকটা ঝিল। জলাশয়ের মাঝখানে একটা ঢিপি মতো ভূখণ্ড। যেন ছোট্ট একটা দ্বীপ। সেই দ্বীপে হাঁসেরা বসে পালক পরিষ্কার করে। ঝিলের আরেক পাড় দিয়ে মালগাড়ি যায়। ডানকুনির দিকে।

কোনা স্টেশন। ছবি রাজকুমার জানা।

কোনা মার্টিন রেলের সময়েও স্টেশন ছিল। এখন ব্রডগেজের সময়ে ডাউনে ডাঁসির পরের স্টেশন কোনা। ডাঁসি ছাড়ার কিছু কারখানা, উড়ালপুল দৃষ্টিপথের বাধা হয়। সেসব পার হলে দূরে দেখা যায় ওয়েস্ট কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল সিটি। তৈরি হতে হতে থমকে যাওয়া এক শহর। ঐতিহাসিক বা ইতিহাস হতে গিয়েও হয়ে উঠতে না পারা এক শহর। সালিম গোষ্ঠী প্রথমে এই শহর তৈরি শুরু করেছিল। কিন্তু জমি আন্দোলনের সেই প্রবল আন্দোলনের সময়ে বাধা পায়। আন্দোলনকারী নেতাদের দাবি ছিল, ওই জমি তিন ফসলি।

কোনা ছাড়িয়ে বাঁকড়া নয়াবাজের দিকে এগোলে। ঝিল কে উসপার ডানকুনির রেললাইন।

ভূমি রাজস্ব দফতরে গিয়ে জমির চরিত্র দেখা হয়নি। কিন্তু খালি চোখে তো…। ট্রেন থেকে বেশ লাগে। আগের স্টেশন ডাঁসি গ্রাম। কিন্তু একটু এগোলেই চারপাশটা দ্রুত বদলাচ্ছে, দেখা যায়। আরও কিছুটা এগোলে আন্তর্জাতিক নগর। নগরের গা ঘেঁষে চলেছে একটানা গ্রাম।

বালিটিকুরি— ঝাঁপকল

বালিটিকুরি। এখানেই থামত ট্রেন। আর যাত্রীরা লাফিয়ে নামতেন।

খাতায় কলমে কোনও স্টেশন নয়। হল্টও নয়। কোনও প্ল্যাটফর্মও নেই। কিন্তু ট্রেন থামত একসময়ে। সেটা সম্ভবত সিগন্যাল ব্যবস্থার কোনও নিয়মের কারণে। আর সেই সুযোগেই লোকজন ঝাঁপ দিয়ে নেমে পড়তেন। হাওড়া-আমতা লোকালের রুটের সঙ্গে বাস রুটের কিছুটা তফাৎ রয়েছে। যাঁদের বালিটিকুরি বা বালিটিকুরি ঘেঁষা দাশনগরে নামার দরকার ছিল তাঁরা সিগন্যালের জন্য ট্রেন থামলেই ঝাঁপ দিয়ে নেমে যেতেন। সেই জন্যই ডেলি প্যাসেঞ্জারদের মুখে মুখে স্টেশনের নাম ঝাঁপকল হয়েছিল। সেই সময়ে বালিটিকুরি, দাশনগর এলাকায় বহু কারখানা ছিল ছোট, বড়। গ্রামের দিক থেকে বহু লোক কাজে আসতেন। ঝাঁপকলে নামতে তাঁদের সুবিধে হত। মিনিট দশেকের হাঁটায় ওঠা যায় মুক্তারাম দে স্কুলের সামনে।

একসময় ইন্টারলকিং সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু হল। বালিটিকুরিতে ঝাঁপ দিয়ে নামা বন্ধ হয়ে গেল। ঝাঁপকলে ট্রেন থামানোর জন্য আন্দোলন হয়েছিল। থানা-পুলিশ হয়। কিন্তু ট্রেন আর থামে না। এখন ওই এলাকায় কারখানাও কমেছে।

বাঁকড়া নয়াবাজ— ফাঁকির টিকিটের স্টেশন

হাওড়া-আমতা লাইনের প্রথম জংশন স্টেশন সাঁতরাগাছি। আপে ঠিক তার পরের স্টেশনই হল বাঁকড়া নয়াবাজ। সাঁতরাগাছি শহরের স্টেশন। বাঁকড়া নয়াবাজ ছিল গ্রামীণ। জনদরদি এক রেলমন্ত্রী একসময়ে ঠিক করেছিলেন, গ্রামীণ এলাকায় ন্যূনতম দূরত্বের ভাড়া হবে দু’টাকা। আর শহর এলাকায় পাঁচটাকা (নাকি তিন টাকা!)। সাঁতরাগাছি পর্যন্ত শহর। কিন্তু তার পরের স্টেশন গ্রামীণ। ফলে সাঁতরাগাছিতে যাঁরা নামতেন তাঁদের কেউ কেউ বাঁকড়া নয়াবাজের টিকিট কাটতেন। তিন টাকা সাশ্রয়। চেকারেরাও কৌশল বুঝতেন। জরিমানা করতেন। তখন আবার অনেক তিন টাকার গুণিতক ক্ষতি। এখন অবশ্য গ্রাম-শহর সবই একই দর।

বাঁকড়া নয়াবাজ

হাওড়া-আমতা লাইট রেলওয়ের সময়েও বাঁকড়া নয়াবাজ স্টেশন ছিল। জায়গাটার আলাদা আকর্ষণ ছিল এমন নামের জন্য। বাঁকড়া বা নয়াবাজ কোনও নামের উৎসই আমার জানা নেই। নয়াবাজ কি নয়াবাঁধ থেকে? কেউ যদি সাহায্য করেন তাহলে জানা যায়। এই স্টেশন থেকে একটি লাইন ডানকুনির দিকে গিয়েছে। মৌড়িগ্রাম স্টেশনের সঙ্গেও একটি লাইনের সংযোগ আছে বলে শুনেছি। লাইন দু’টো মূলত মালগাড়ি চলাচলের জন্য।

স্টেশনটি নিয়ে কলেজ জীবনের অনেক স্মৃতি। মাঝে মাঝে এই স্টেশনে এসে ট্রেন আর নড়তে চাইত না। তখন ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যাও ছিল খুব কম। অল্প কয়েকজন যাত্রীদের মাঝে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ত, ট্রেন খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমরা বন্ধুরা ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করে দিতাম। আশিস, নূপুর, হরিদাস, বর্ণালী। রেললাইন ধরে নয়, পাড়ার ভিতর দিয়ে সাঁতরাগাছি স্টেশনে পৌঁছতাম। এক আধদিন সাঁতরাগাছি স্টেশনে দেখা হয়ে যেত সুদীপ, দুর্গাপ্রসাদ বা সন্দীপের সঙ্গে। দলে ভারী হয়ে ডাউন মেচেদা-পাঁশকুড়া লোকালে উঠতাম। গন্তব্য টিকিয়াপাড়া।

আমতা লোকালে শুয়ে-বসে আসা যায়। কিন্তু মেন লাইনের ট্রেনে অসম্ভব ভিড়। সেই ভিড় এক শিক্ষা দিয়েছিল। সুখ জিনিসটা ক্ষণস্থায়ী।

কভারের ছবি— বাঁকড়া নয়াবাজ।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *