ডাকাত কালী
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

গাঙ্গুলি ডাকাতের কালী বা রায়বাঘিনীর মন্দির

দীপক দাস

গল্প শুনছিলাম আটচালায় বসে। আবহাওয়াটা সেদিন বেশ মনোরমই ছিল। বর্ষাকাল ক্যালেন্ডারে। আকাশে অল্পস্বল্প কালো মেঘও ওড়াওড়ি করছিল। দু’এক ফোঁটা ঝরেও ছিল মেঘবিন্দু। এমন পরিবেশ গল্প শোনার পক্ষে আদর্শ। দুপুরবেলা বলে শুধু চপ-মুড়ির বাটি বা ঠোঙা হাতে ছিল না। তবুও গল্প জমে গিয়েছিল। ডাকাতের গল্প এমনিতেই রোমহর্ষক হয়। তার সঙ্গে যদি জড়িয়ে যায় রাজরাজড়া তাহলে আরও মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে। এ গল্প যদিও ডাকাতের থেকে মন্দিরের বেশি।

সেদিন আচমকাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। জুনের শেষের দিকের মঙ্গলবারে। একাই। দলের ছেলেরা সব পালিয়েছে এদিকে ওদিকে। আমারও বেরনোর কোনও পরিকল্পনা ছিল না বেলা ১০টা পর্যন্ত। হঠাৎই পলাশ পোড়েল বাবুর একটা মন্তব্য মনে পড়ল। কবি এবং ‘হাওড়া জেলার কথা’ নামে ফেসবুক পেজের পরিচালক ইনি। আমাদের গ্রুপেরই একটি লেখায় তিনি দু’টো জায়গায় ঘুরে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। একটা জায়গা দিলাকাশ। আরেকটা খুঁড়িগাছি। হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া থানা এলাকায়। বাড়ি থেকে বেশিদূর নয়। হিসেব করে দেখলাম, চট করে বেরিয়ে পড়লে দুপুরের মধ্যে ফিরে আসা যাবে।

খুঁড়িগাছির ডাকাত কালীর মন্দির।

অটোয় চড়েছিলাম। এবং অটোচালকদাদা সাহায্য করেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মন্দিরের অবস্থান। খুড়িগাছিতে একটা মন্দির রয়েছে। যেটি ডাকাত কালীর মন্দির হিসেবে পরিচিত। এখন অবশ্য অনেকে রানী ভবানীর মন্দির বলে জানেন। মন্দিরের ছবি তোলার পরে কথা বলার লোক খুঁজছিলাম। মন্দির সম্পর্কে অন্তত কিছু তথ্য যাতে সংগ্রহ করা যায়। মন্দিরের কাছে একজন বাইকে মালপত্র বাঁধছিলেন। জিজ্ঞাসা করতে তিনি মন্দিরের আটচালায় বসে থাকা এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ওই তো মন্দিরের পুরোহিত বসে রয়েছেন। উনি ভাল বলতে পারবেন।’’

আটচালায় গিয়ে বসলাম। তার পর শুরু হল গল্প। পুরোহিতের নাম স্বদেশ চক্রবর্তী। চার পুরুষের পুরোহিত। আদতে তাঁরা হুগলির ছিট সন্তোষপুরের বাসিন্দা। খুঁড়িগাছি থেকে অনেক দূর। হেঁটে যাতায়াত করতেন পুরোহিত। বর্ষায়, শীতে পুজোর অসুবিধা হত। স্বদেশবাবুর দাদু মন্দিরের কাছে জায়গা পান। তার পর তাঁরা এখানকারই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন।

ডাকাত কালী ও অন্য দেব দেবীরা।

স্বদেশবাবু জানালেন, খুড়িগাছির এই এলাকায় আগে লোকবসতি তেমন ছিল না। মন্দিরের এলাকাটি ঝোপজঙ্গলে ভরা ছিল। এই এলাকায় আড্ডা গেড়েছিল এক ডাকাত সর্দার। সেই সর্দারের নাম, কোথায় বাড়ি কিছুই বলতে পারলেন না স্বদেশবাবু। শুধু জানালেন, সর্দার গাঙ্গুলি ব্রাহ্মণ ছিলেন। লোকজন জোগাড় করে দল পাকিয়ে ডাকাতি করতেন। কথিত যে, গাঙ্গুলি ডাকাত একবার বর্ধমানের মহারাজার বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে এক ৮-১০ বছরের মেয়ের কাছে বাধা পান। দলের অন্য সদস্যরা তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সর্দার মারতে দেননি। ডাকাতি করতে না পারলেও সর্দার একটা কালী মূর্তি চুরি করে নিয়ে চলে আসেন। এসে খুঁড়িগাছির এই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

দিলাকাশের সিমাফোর। এই জায়গাটি গির্জাতলা নামে পরিচিত।

যেখানে প্রথম মূর্তি স্থাপন হয়েছিল সেই জায়গাটা নাকি একটা ঢিবি মতো ছিল। তার উপরেই মূর্তি স্থাপন হয়। জায়গাটা পাতা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। এদিকে মূর্তি চুরি হওয়ায় বর্ধমানের রাজা খোঁজ করেন। তখনই একদিন স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নে দেবী জানিয়ে দেন তিনি খুড়িগাছিতে রয়েছেন। আর ফিরতে চান না। অনেক পরে রানি ভবানী বা ভবশঙ্করী মন্দিরটি তৈরি করে দেন। ঠিক কবে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল তা জানা যায় না। মন্দিরের গায়ে একটি স্তম্ভে কতকগুলো কথা লেখা রয়েছে। স্বদেশবাবু বলছিলেন একটি ফলকে কথাগুলো লেখা ছিল। সেটাই নতুন করে তৈরি মন্দিরের ফলকে লিখে রেখেছেন। লেখাটি এই রকম, ‘শ্রী কালী ত্রিসপ্তাষ্টেন্দু শাকেহত্র মীনে/ভানৌ মিতে কুজে।/খুঁড়িগাছীতি পল্লীস্থৈশ্চিন্ময়ী/স্থাপিতা মঠে।।’ অনেকটা মধ্যযুগের কাব্যের রচনাকাল প্রকাশের পঙক্তির মতো। এটি প্রতিষ্ঠা লিপি হতে পারে। কিন্তু এর অর্থ উদ্ধার করা যায়নি। আমিও দু’একজনের কাছে এটির ছবি তুলে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ভাষা উদ্ধার করা যায়নি। এই লিপির নীচে লেখা রয়েছে, ‘বীরাঙ্গনা রানী রায়বাঘিনী প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস প্রসিদ্ধ শ্রী শ্রী ঈশ্বর ডাকাতে কালী মন্দির খুঁড়িগাছি, হুগলি’। পড়লেই বোঝা যায় এটি আধুনিক কালে লেখা হয়েছে।

একদম সামনে লীলাবতীর থান। ডানদিকে প্রথমে শিবমন্দির। পাশে মহাপ্রভু মন্দির। সোজা দিকে আটচালা। আটচালার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুর্গামণ্ডপ।

মন্দির এবং মন্দিরের জায়গার অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। বলছিলেন স্বদেশবাবু। তাঁর কথায়, এই জায়গায় আগে শ্মশান ছিল। দলিলে নাকি শ্মশান কালীর নাম উল্লেখ আছে। মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে উল্লেখ রয়েছে জনৈক মনোহর রায়ের নাম। তাঁর পরিচয় দিতে পারেননি স্বদেশবাবু। মন্দিরের দেবী কালী। কিন্তু একটি কাঠামোয় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, জয়া-বিজয়া, ডাকিনী-যোগিনী রয়েছে। যা সচরাচর দেখা যায় না। স্বদেশবাবু জানালেন, কোনও সময়ে বিধান নেওয়া হয়েছিল দেবীকে চামুণ্ডা রূপে পুজো করতে। তাই এমন সব দেব দেবীর সহাবস্থান।

মন্দির বর্তমানে নবরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি। তবে একসময়ে খিলান দেওয়া মন্দির ছিল বলে জানালেন স্বদেশবাবু। মন্দিরের ভিতরে পুরনো ধাঁচ অনেকটাই বজায় রেখেছেন। মন্দির নতুন করে তৈরি হয়েছে ভক্তদের দানে। আটচালাও তাই। চৈত্র মাসে অমাবস্যার সময়ে বাৎসরিক পুজো হয়। তখন বেশ জাঁকজমক হয়।

ষষ্ঠীর থান।

খুঁড়িগাছি থেকে টোটো ধরে দিলাকাশ। বেশি দূর নয়। টোটোচালক আমার গন্তব্য বুঝতে না পেরে একটু দূরে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। হেঁটে ফিরলাম। ফেরার সময়ে আরেকবার দেখা হল সিমাফোর টাওয়ারটা। রাস্তার ধারেই। এই রাস্তায় বহুবার যাতায়াত করেছি। নানা কারণে। টাওয়ারটাও দেখেছি। লোকে যদিও এই টাওয়ারকে গির্জা বলে মনে করে। সড়ক কর্তৃপক্ষের বোর্ডেও দেখলাম, জায়গাটিকে গির্জাতলা বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। হাওড়ার বড়গাছিয়ায় একটা জায়গার নাম গির্জাপুকুর। এখানেও কোনও গির্জা ছিল না। ছিল একটা সিমাফোর টাওয়ার। কালের নিয়মে যা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

মন্দিরের সামনের দিঘি।

আমার গন্তব্য অবশ্য টাওয়ারের আগে। রাস্তা থেকে বাঁদিকে গ্রামের খানিকটা ভিতরে। ওখানে রয়েছে প্রাচীন ভৈরবী মন্দির। পাড়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে একটা কুকুর প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল। জটাজুটধারী ছিলাম বলে হয়তো। কুকুরে ভীষণ ভয়। তবুও একলা জগাই বুকে বল নিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম।

জায়গাটা দেখে অবাক হলাম। এ যে এক ধর্ম সমন্বয়ের ক্ষেত্র। ভৈরবী মন্দির তো রয়েছেই। এর সঙ্গেই রয়েছে মহাপ্রভু মন্দির। দুর্গাচালা। শিবের মন্দির। ষষ্ঠী ঠাকুরের থান। লীলাবতীর থান। একটা পুকুরের ওপারে রয়েছে কালী মন্দির। বৈষ্ণব-শাক্ত-শৈব এবং লৌকিক দেব দেবীর এমন সহাবস্থান আশ্চর্য করল। সব ক’টি মন্দির একটি চত্বরকে ঘিরে। শিবমন্দিরটি বেশ প্রাচীন। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ফলক অনুযায়ী ১৭১৮ শকাব্দে বা ১২১৩ সনে যাদব গোপন শ্রী নিত্যানন্দ ভোড় ঘোষ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। ভৈরবী মন্দিরটিতে কোনও ফলক পেলাম না।

ভৈরবীর মন্দির।

মন্দির সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেও পারলাম না। বলার মতো কেউ ছিলেন না। একজন স্থানীয় বাসিন্দা চান করতে যাচ্ছিলেন, তিনি জানালেন, সবেমাত্র মন্দিরের পুরোহিত বাড়ি চলে গেলেন। একটা বিষয় বুঝলাম, সব ক’টি মন্দিরই নতুন করে তৈরি। প্রাচীনত্বের কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমনকি ভৈরবীর মূর্তিতেও বদল এসেছে। ওই স্থানীয় বাসিন্দা জানালেন, আগে দেবী মূর্তি ছিল ভীষণা। এখন শান্ত রূপ। এখানেও খুঁড়িগাছির মন্দিরের মতো দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ রয়েছে। রয়েছে জয়া-বিজয়াও। ডাকিনী-যোগিনী নেই। চতুর্ভুজা দেবীর পদতলে মহিষাসুর। খুঁড়িগাছির ডাকাত কালীর পদতলে শিব। মন্দির চত্বরের সামনে বিশাল দিঘি। মন্দিরেরই সম্পত্তি।

ভৈরবী মূর্তি

পলাশবাবু জানিয়েছিলেন, ভুরশুটের শেষ ধীবররাজ শনিভাঙ্গড়ের রাজধানী ছিল দিলাকাশ। তাঁর গড় নাকি এখনও দেখা যায়। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সকলেই বললেন, এমনটা তো শুনিনি।

কভারের ছবি— খুঁড়িগাছির ডাকাত কালী মন্দির

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *