ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

বারাণসীর মন্দিরে-ঘাটে

তনয় শীল

বছর শেষে বেড়াতে যাওয়ার জন্য সারা বছর অফিসের সিএল জমিয়ে রেখেছিলাম। সেই মতো তিন বন্ধু বেরিয়ে পড়েছিলাম শীতকালীন ভ্রমণে। পূর্ব বর্ধমানের অম্বিকা কালনার বিভিন্ন পর্যটন সংস্থা বছরের বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বাসে করে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে থাকে। কয়েক মাস আগে থেকেই বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দেয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমার আর দুই বন্ধু শিবম বাইল ও প্রীতম বিশ্বাসের গন্তব্য ছিল রাজগির, নালন্দা, গয়া, বুদ্ধগয়া, প্রয়াগরাজ (ত্রিবেণীসংগম, কুম্ভ) ও বেনারস। মোট পাঁচদিনের প্যাকেজ। টিকিট ৩৫০০ টাকা। তাতে বাস ভাড়া, প্রাতরাশ, দুপুর ও রাতের খাবার ও থাকার খরচ ধরা। মোট ৫০ জন বাসযাত্রী। শেষ দু’দিন ধার্য ছিল বেনারস ভ্রমণের জন্য।

রাতের বারাণসী।

সব জায়গা ঘুরে যেদিন বেনারস পৌঁছলাম তখন রাত ৯টা। ফলে গঙ্গারতি দেখা হয়নি। কিছুটা কষ্ট হয়েছিল। ভাবলাম আজ হয়নি তো কী হয়েছে? কাল সন্ধ্যেবেলায় দশাশ্বমেধ ঘাটে উপস্থিত থাকতেই হবে।

দশাশ্বমেধ ঘাটে জলচর পাখি।

ভারত সেবাশ্রমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল। সেদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে স্নান সেরে তিন বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে বেড়িয়ে পড়লাম। গুগল ম্যাপ দেখে আগের রাতেই একটা ঘোরার পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। প্রথম গন্তব্য ছিল কাশীবিশ্বনাথ মন্দির। হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিলল বিশালাকৃতি ষাঁড় ও বেনারসির পানের দোকান। রাস্তার দু’পাশের পুরনো মন্দিরশৈলী আপনাকে আকৃষ্ট করবেই। কাশীবিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিয়েই আমাদের বেনারস ভ্রমণ শুরু করলাম।

চলতে চলতে দেখা মন্দির শৈলী।

উত্তরপ্রদেশে গঙ্গানদীর তীরে অবস্থিত বারাণসী। বেনারস ও কাশী নামেও পরিচিত। ভারতীয় ইতিহাস, ধর্ম ও সংস্কৃতির এক অন্যতম মেলবন্ধনের স্থান। গঙ্গার দুই উপনদী ‘বরুণা’ ও ‘অসি’ থেকে ‘বারাণসী’ বা ‘বেনারস’ নামের উৎপত্তি। ঐতিহাসিকদের মতে, আর্যরা প্রথম গঙ্গার তীরে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে বেনারস তাদের এক প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। বেনারসের গঙ্গাকে অন্যতম পবিত্র নদী মনে করা হয়। যদিও বর্তমানে আর্যরা বহিরাগত, এমন তত্ত্ব মানতে নারাজ বহু ঐতিহাসিক।

কাশীবিশ্বনাথ মন্দির

গঙ্গার পশ্চিম তীরে অবস্থিত শিবের একটি মন্দির, যা ‘বিশ্বেশ্বরমন্দির’ নামেও পরিচিত। হিন্দুধর্মালম্বীদের একাংশের বিশ্বাস কাশীবিশ্বনাথ সকলের মনস্কামনা পূরণ করেন। ‘স্কন্দপুরাণেও’ এই মন্দিরের উল্লেখ আছে। পুরাণ অনুসারে বারাণসীতেই প্রথম শিবের জ্যোতির্লিঙ্গ উদ্ভাসিত হয়েছিল। দেশের ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে যা অন্যতম।

কাশীবিশ্বনাথ মন্দির।

সকাল থেকেই মন্দিরে পুজো দেওয়ার লাইন পড়ে যায়। মন্দিরের বাইরে পুজো সামগ্রী ও প্রসাদ কেনার জন্য অনেক দোকান রয়েছে। পছন্দ মতো সামগ্রী যেমন ধুতরো, কলকে, আকন্দ, অপরাজিতা ইত্যাদি ফুল, ও ফুলের মালা, বেলপাতা, আমের সরা, ধুতরো ফল, দুধ, গঙ্গাজল, নারকেল, বেল, ধুপকাঠি, মাটিরপ্রদীপ, মোমবাতি ইত্যাদি কিনে পুজো দিতে পারেন। যে দোকান থেকে সামগ্রী কিনবেন সেখানেই জুতো জমা রেখে মন্দিরে পুজো দেওয়ার লাইনে দাঁড়াতে পারবেন। মন্দিরে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মন্দিরের বাইরে ও ভেতরে পুলিশ থাকেন।

দশাশ্বমেধ ঘাট

দশাশ্বমেধ ঘাট।

বেনারসের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় ঘাট দশাশ্বমেধ ঘাট। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে কাছেই অবস্থিত। জনশ্রুতি, ব্রহ্মা, শিবকে আমন্ত্রণ জানাতে এই ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। ব্রহ্মা দশ হাজার অশ্বের মেধে যজ্ঞ করেন। যা থেকে এই ঘাটের নামকরণ। গঙ্গায় স্নানেরও ব্যবস্থা আছে। স্নান সেরে গঙ্গাবক্ষে প্রদীপ ভাসাতে পারেন। গঙ্গার ঘাটেই স্থানীয় বিক্রেতাদের থেকে দশ টাকার বিনিময়ে পেয়ে যাবেন প্রদীপ ও ফুলে সুসজ্জিত ডালা। এই ঘাটের অন্যতম আকর্ষণ প্রতিদিনের সন্ধ্যারতি। যা উৎসর্গ করা হয় শিব, গঙ্গানদী, সূর্য, অগ্নি ও সমগ্র বিশ্বকে। সন্ধ্যাবেলায়ও গঙ্গাবক্ষে প্রদীপ ভাসানো করা হয়। অন্ধকারে হাজার আলোক রাশি সেজে ওঠে।

মণিকর্ণিকাঘাট

দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছেই রয়েছে ‘মণিকর্ণিকাঘাট’। আসলে শ্মশানঘাট। যেখানে চিতার আগুন কখনও নেভে না। লোকবিশ্বাস, এখানে কারও মৃত্যু হলে বা কাউকে দাহ করা হলে তিনি মোক্ষ লাভ করেন। এবং জন্মান্তর থেকে মুক্তিপান। আরও কিছু ঘাট রয়েছে এখানে। ‘হরিশচন্দ্র ঘাট’, ‘ললিতা ঘাট’, ‘চৌকি ঘাট’, ‘চেতসিং ঘাট’, ‘কেদার ঘাট’, ‘জানকী ঘাট’, ‘অহল্যাবাঈ ঘাট’, ‘রাণামহল ঘাট’, ‘পঞ্চগঙ্গা ঘাট’ ইত্যাদি। প্রত্যেকটি ঘাটই পরপর অবস্থিত। তাই হেঁটেই ঘাটগুলি ঘোরা যায়। নৌকা ভাড়া করেও ঘুরে আাসা যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে আগত সাদা পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে নৌকাবিহার এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

মণিকর্ণিকা ঘাট।

ঘোরাঘুরি করে দুপুরের আগে ফিরে এলাম ভারত সেবাশ্রমে। খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। ভারত সেবাশ্রমের সামনেই অনেক অটো পেয়ে যাবেন। রিজার্ভ করে ঘুরে আাসার জন্য। চারজনের ভাড়া ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা।

একে একে ঘুরে এলাম বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির, দুর্গামন্দির, তুলসীমানস মন্দির, রামনগর দুর্গ ও সংগ্রহশালা ইত্যাদি।

মন্দির নগরীর প্রকৃতিও অসাধারণ।

দুর্গা মন্দির

‘দুর্গাকুণ্ডমন্দির’ নামেও পরিচিত এই মন্দিরটি। ১৮০০ শতকে বাংলার নাটোরের রাণী ভবানী এর প্রতিষ্ঠা করেন। লালরঙের এই মন্দিরে দুর্গার পুজো হয়।

তুলসীমানস মন্দির

বেনারসের বিখ্যাত মন্দির ‘শ্রী সত্যনারায়ণ তুলসীদাস মন্দির’। রামকে উৎসর্গ করে ১৯৬৪ সালে শ্বেতমার্বেল পাথর দিয়ে এই মন্দির স্থাপিত হয়। জনশ্রুতি অনুসারে এই স্থানে তুলসীদাস ‘রামচরিত মানস’ রচনা করেছিলেন। মন্দিরের দেওয়ালে রামচরিত মানসের অনেক দৃশ্য রয়েছে। মন্দিরের দ্বিতীয় তলে রয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনার মূর্তি ও দৃশ্য। সেগুলি দেখতে পাঁচ টাকার টিকিটের ব্যবস্থা আছে।

তুলসীদাস মন্দির

মূল মন্দিরের প্রবেশপথের ডানদিকে রয়েছে একটি আকর্ষণীয়, শান্ত পরিবেশের তুলসীবাগান। এই বাগানে তুলসীদাসের একটি মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের বা দিকে রয়েছে চারঘাট বেষ্টিত একটি সুন্দর পুকুর। মন্দির খোলার সময় সকাল ৫.৩০-দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৩.৩০-রাত্রি ৯.০০টা। আরতির সময় সকাল ৬টা ও বিকেল ৪টে।

সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির

বেনারসের বিখ্যাত জাগ্রত হনুমান মন্দির। স্থানীয়দের মতে, এখানে ভক্তদের সব আশাপূরণ হয়।

গঙ্গারতি।

সবশেষে অটো আমাদের দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে নামিয়ে দিল। সাক্ষী হতে চলেছি সেই প্রতীক্ষিত মুহূর্তের। হ্যাঁ, বেনারসের সন্ধ্যারতি। সে এক মায়াবী মুহূর্ত। আরতি শেষে গঙ্গার পাড়ে কিছুক্ষণ কাটালাম। ফিরতে মন চাইছিল না, কিন্তু ফিরতে যে হবেই কারণ রাত ১০টায় বাস বাড়ি ফেরার পথে পাড়ি দেবে। ঘাট থেকে বেরোলেই রাস্তায় রয়েছে অসংখ্য কাঁসা, পিতলের থালা বাসন, পুজোর বাসন ও অন্যান্য সামগ্রীর দোকান। রয়েছে ‘বেনারসী’ শাড়ির দোকান।

গঙ্গাবক্ষে ভাসানো হয়েছে প্রদীপ।

দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে জন প্রতি ১০ টাকা ভাড়ায় অটো চেপে ফিরে এলাম ভারত সেবাশ্রমে। গোছগাছ ও খাওয়া সেরে বাসে উঠলাম। রাত ১০টায় বাস ছাড়ল।

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *