পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

মহাভারতের গ্রামে যেতে মানা

দীপশেখর দাস

“ভগবান বুলা রাহে হে। চলো কাল বদ্রীনাথ ধাম হি চলতে হে”— রাতে খেতে বসে বললেন দীনেশ স্যার। আচমকা এমন কথায় আমি আর নিকেশ তো প্রায় বিষম খাই আর কী!

স্যর বেশ ঈশ্বরভক্ত। উত্তরাখণ্ডেরই লোক। চামোলি জেলার। তিনজনে ফুলের উপত্যকায় গিয়েছিলুম ওখানকার ‘ঘাসপুসের’ খবর অন্বেষণে (যেখানে ব্রহ্মকমল ফোঁটে দ্রষ্টব্য)। ফুলের উপত্যকার খুব কাছেই বদ্রীনাথ ধাম। আমি আর নিকেশ সেবারই প্রথম উত্তরাখণ্ডে গেছি। একদিন আলোচনার সময় যখন জানা গেল স্যার একই জেলার বাসিন্দা হলেও তখনও পর্যন্ত বদ্রীনাথ দেখেননি। এটা জেনেই নিকেশ প্রস্তাব দিয়েছিল কাজ শেষে বদ্রীনাথ দর্শনে যাওয়ার। কিন্তু, সময়ের অভাব এবং আরও এক জায়গায় ঘাসপুসের (গাছপালার খোঁজ। দলের ছেলেরা আমাকে ঘাসপুস বলে বলে অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে) খোঁজে যেতে হবে এই অজুহাতে সে প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ হয়েছিল। স্যার খুব ভাল মানুষ। আমাদের সঙ্গে একেবারে বন্ধুর মত মেশেন। কিন্তু প্রচণ্ড কাজ পাগল। কাজ পেলে তিনি আর কিছু জানেন না। সমস্ত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর কাছে কোনওরকম ছুটির প্রত্যাশা বৃথা। তাই যে প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করেছিলেন সেই প্রস্তাব নিজে থেকেই তুলতে দু’জনেই বেশ অবাক হলুম।

বদ্রীনাথ মন্দির।

যদিও ‘ভগবানের বুলাওয়া’ ব্যাপারটা বুঝলুম খানিক পরেই। ফুলের উপত্যকার, এটা যে ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স এতক্ষণে পাঠক সেটা বুঝে ফেলেছেন নিশ্চয়, কাজ শেষ করে আমাদের দেহরাদূন ফেরার কথা। সেই উদ্দেশ্যেই আমরা ফুলের উপত্যকা থেকে নেমে গোবিন্দঘাটের এক হোটেলে রাতের জন্য ঠাঁই নিয়েছিলুম। দিন কুড়ির টেলিভিশনহীন, মোবাইল নেটওয়ার্কহীন সন্ন্যাস জীবন কাটানোর পর আমি আর নিকেশ খাবার টেবিলে বসে হোটেলের একমাত্র ১৪ ইঞ্চি টেলিভশনে ক্রিকেট হাইলাইটস উপভোগ করছিলুম। হোটেলের কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে কী যেন একটা নিয়ে গভীর আলোচনা করছিলেন। স্যার ওঁদের আলোচনা মন দিয়ে শুনছিলেন।

সেপ্টেম্বর মাস। উত্তরাখণ্ডে তুমুল বৃষ্টির সময়। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিও হচ্ছিল নাগাড়ে। ফলে যা হবার তাই। বড়সড় ধস নেমে দেহরাদুন যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। ধস সরাতেই হয়ত দুপুর গড়িয়ে যাবে। তখন দেহরাদূনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে না। তাই ‘ভগবানের বুলাওয়ায়’ সাড়া দিয়ে বদ্রীনাথ দর্শনের ফিকির।

কুয়াশার আবছায়াতে তৈরি হওয়া অন্য সৌন্দর্য।

পরদিন সকাল সকাল উঠে গরম জলে স্নান করে তিনজন বেরিয়ে পড়লুম ধামের উদ্দেশ্যে। স্যারের কড়া নির্দেশ কিছু খাওয়া যাবে না। পুজো দিয়ে তবেই খাওয়া হবে। হোটেলে আমিষ-নিরামিষ প্রভেদ নেই। তাই ওসব এখন ছোঁয়া যাবে না। আর ছুঁলে ধাম-দর্শনের আশা ত্যাগ করতে হবে। অগত্যা মেনে নিলুম। চললুম খালি পেটেই। কিন্তু, গাড়ি কিছুদূর এগোতেই বিপত্তি। এদিকেও ধস নেমেছে। যদিও ছোট ধস। প্রায় এক ঘণ্টার অপেক্ষার পর রাস্তা পরিস্কার হতে গাড়ি ছাড়ল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বদ্রীনাথ পৌঁছলুম। স্যার আর নিকেশ অশেষ ভক্তিসহকারে ডালি সাজিয়ে পুজো দিল। ও বলা হয়নি! নিকেশও দারুণ ঈশ্বরপ্রেমী। প্রতি মঙ্গলবার হনুমানজীর ব্রত রাখে (যদিও এখন বিয়ে ওর বিয়ে হয়েছে। এ অবস্থায় আর ব্রত রাখে কিনা জানা হয়নি)।

দুই ভক্ত। স্যর এবং নিকেশ।

আমার মনে শান্তি এল। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। ওদের পুজো দেওয়া হয়েছে। এবার আমার পেটের পুজো করা দরকার। মন্দির থেকে বেরিয়ে খাবার দোকানের খোঁজ করতে লাগলুম। এখন পর্যটকদের মরসুম নয়। তাই বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ। মন্দিরের বাঁ পাশের দিকে একটু বাইরের দিক করে একটা দোকান মিলল। দু’টো করে আলুর পরোটার অর্ডার দিয়ে বাইরের দিকে এলুম। প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ এদিকটায়। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় পাতলা সাদা মেঘের চাদর। বাতাসে হিমেল আবেশ। বিভোর হয়ে দৃশ্য উপভোগ করছিলুম। সম্বিত ফিরল দোকান মালিকের ডাকে। দেখি ধোঁয়া ওঠা পরোটার প্লেট আমাদের প্রতীক্ষায় আছে।

দোকান মালিক খুব অমায়িক। আমরা তাঁর সেদিনের প্রথম খরিদ্দার। আমাদের টেবিলের পাশের টেবিলে বসে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়লেন। কোথা থেকে এসেছি, কোথায় কোথায় গিয়েছিলুম, কোথায় কোথায় যাব ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুঁটিয়ে জানছিলেন। কিছু নিজের কথাও বলছিলেন যদিও। তাঁর থেকেই জানলুম, এখান থেকে কিলোমিটার ২-৩ দূরে একটা গ্রাম আছে। নাম ‘মানা’। অনেক কাহিনি নাকি জড়িয়ে আছে ওই গ্রামের সঙ্গে।

খাবারের দোকানের বাইরের প্রকৃতি।

হাতে সময় ছিল। দেখলুম, স্যার জানতেন মানা গ্রামের কথা। পাছে যেতে হয় তাই আমাদের কাছে বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। এখন ধরা পড়ে ঢোঁক গিললেন। যেতে রাজি হলেন। তিন কিলোমিটার রাস্তা আমাদের কাছে কিছুই না। হাঁটা লাগালুম। পথের পাশে মিলিটারি ক্যাম্প। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বার করতেই উর্দি পড়া সেপাই ছুটে এলেন। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। ক্যাম্পের নয়, প্রকৃতির ছবি তুলছিলুম যদিও। তবে মেনে নিলুম। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে কোনও আপসে আমিও রাজি নই। দেশের জন্য আমার এটুকু স্বার্থ ত্যাগ তো করতেই হবে। ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যেই গ্রামের ফটকের কাছে পৌঁছে গেলুম। গোটা গোটা অক্ষরে ভারতের শেষ গ্রাম মানা আমাদের স্বাগত জানাল।

মহাভারতের গ্রামে প্রবেশপথে।

পৌরাণিক এবং ভৌগোলিক দিক থেকে মানা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বত বর্ডারের কাছে শেষ গ্রাম মানা। গ্রামের খানিক আগে থেকে পাশের পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা চলে গেছে তিব্বত বর্ডারের দিকে। মূলত সৈন্যদের যাতায়াত, খাদ্য ও যুদ্ধ সামগ্রী পাঠানোর জন্যই পাহাড় কেটে এ রাস্তা তৈরি করা। সেদিক থেকে মানা গ্রামের কাছের মিলিটারি ক্যাম্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মানা গ্রামের পৌরাণিক ইতিহাসও প্রবল প্রসিদ্ধ। কথিত মহাভারত এই গ্রামেই রচিত হয়েছিল। ব্যাসদেব বলেছিলেন মহাভারতের কাহিনি। আর শিব-পার্বতী পুত্র গণেশ তা শ্রুতিলিখন করেছিলেন। গ্রামের মাঝে এই দু’জনের নামে দু’টো গুহা আছে, ব্যাস গুহা আর গণেশ গুহা। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরস্বতী নদী। যদিও নদীর গতিপথ অতন্ত ছোট। কথিত গণেশ যখন মহাভারতের শ্রুতিলিখন করছিলেন তখন সরস্বতীর জলের আওয়াজে সবটুকু শুনতে পাচ্ছিলেন না। ফলে বারবার রচনা ব্যাহত হচ্ছিল। ক্রুদ্ধ ব্যাসদেব অভিশাপ দিয়ে সরস্বতীর গতিপথ বেঁধে দেন। সরস্বতীও নিশ্চুপ হয়। নদীর কোনও উৎস পাওয়া যায় না। পাথরের নীচে থেকে বেরিয়ে অল্প পথ পেরিয়েই অলকানন্দায় মেশে সে।

সরস্বতী নদী।

মহাভারতের আরও গল্প আছে মানায়। দ্রৌপদী-সহ পঞ্চপাণ্ডব এই গ্রামের মধ্যে দিয়েই মহাপ্রস্থানের পথে যান। সরস্বতী নদী পেরোনোর সময় ভীম পায়ের চাপে একটা বড় পাথর নদীর উপর ফেলে সেতু বানান। সেই সেতুর সাহায্যেই পাণ্ডবরা নদী পার করেন। গ্রামের শেষ প্রান্তে সরস্বতীর নদীর উপর শুয়ে থাকা বিশালাকার এক পাথর নাকি ভীমের পায়ের চাপে এখনও কাত হয়ে আছে। গল্প শুনে দেখতে গিয়েছিলুম সে পাথরখানা। দেখলুম শুয়ে থাকা বিশালাকার পাথরটার গায়ে পাঁচটা খাঁজ। সরস্বতীর জলের ঝাপটায় স্বাভাবিক আবহবিকারের ফলেই সে খাঁজ সৃষ্টি বলে আমার অনুমান। প্রবল কল্পনাশক্তির অধিকারী মানুষও পায়ের পাঁচ আঙুলের ছাপের সঙ্গে ওই আবহবিকার মেলাতে পারবেন বলে মনে হয় না।

ব্যাস গুহা।

এক গাইড উদ্দীপনার সঙ্গে পর্যটকদের ভীমের পায়ের ছাপ দেখাচ্ছিলেন। তাঁকে একা পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, ‘‘ভীমের দ্বিতীয় পায়ের ছাপটা কোথায়?’’ লোকটা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।

ভীমের পায়ের চাপে তৈরি সেতু।

ছবি— লেখক ও দীনেশ সিং রাওয়াত।

কভারের ছবি— মানা যাওয়ার পথে।

(সমাপ্ত)

One thought on “মহাভারতের গ্রামে যেতে মানা

  1. পঞ্চপাণ্ডবেরা সারা ভারত ঘুরেছিলেন। বিশেষ করে মধ্যম পাণ্ডব ভীম। অজ্ঞাতবাসের সময়ে তাঁরা কোথায় না কোথায় এসেছিলেন। সেই মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকা গুহা থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত। জনশ্রুতি, মেদিনীপুরে হিড়িম্বাকে বিয়ে করেছিলেন, বকরাক্ষসকে বধ করেছিলেন ভীম। গড়বেতার গনগনিতে বকরাক্ষসের হাড়ও মিলেছে বলে দাবি ওঠে। যদিও সেটা কোনও গাছের জীবাশ্ম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *