আটঘরা। সেকেন্দ্রাপুর।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

সমন্বয়ের ক্ষেত্র জঙ্গলবিলাস পিরের মেলা

দীপক দাস

দেখা কোনও দিন হয়নি। টুকটাক থেকে লম্বা আলাপ, সবই হোয়াটসঅ্যাপে। পরিচয় হয়েছিল অনলাইনে তাই পরিচয়ও নেটিজেন হিসেবেই থেকে গিয়েছিল। ফোনে কথা হল এই মঙ্গলবার। দীপ্তেন্দুবিকাশ জানা পড়াশোনা করা একটি ছেলে। সিলেবাসের বাইরের পড়াশোনার কথা বলছি। আঞ্চলিক ইতিহাসে আগ্রহী। পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে। আমাদের দলকে অনেকদিনই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিল। দল বেঁধে যেন ওদের চাঁপাডাঙার ওদিকে ঘুরতে যাই। দল আর বাঁধা হয়নি। দিনকে দিন দল ছেড়ে ছেড়ে যাচ্ছে। তাই আজ একা ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। দীপ্তেন্দুদের চাঁপাডাঙাতেই।

ফোনে অবশ্য দীপ্তেন্দু অন্য প্রস্তাব দিল। আমার যদি আগ্রহ থাকে তাহলে আমাকে জঙ্গলবিলাস পিরের মেলায় নিয়ে যাবে। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক মানব মণ্ডলের পোস্ট থেকে দীপ্তেন্দু এই বিষয়ে জানতে পারে। পিরের নামটা শুনেই আগ্রহ হয়েছিল। যেমন আগ্রহ হয়েছিল জঙ্গল সুফি নামে। সিংটির দিকে যেতে মাতোর মোড়ে এই পিরের আস্তানা রয়েছে। তাঁর নামেই জায়গার নামকরণ। কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানি না। জঙ্গলবিলাস পিরের খোঁজে যাওয়া যেতেই পারে।

রাস্তার সৌন্দর্য।

কথা মতো আমি হুগলির জাঙ্গিপাড়ায় হাজির হলাম। থানার সামনে অপেক্ষা। দীপ্তেন্দু বাইকে এল। গন্তব্য ঠিক হল। প্রথমে খানাকুলের কৃষ্ণনগর। সেখান থেকে জঙ্গলবিলাস পিরের আস্তানায়। খানাকুলে আমরা দল বেঁধে বহুবার গিয়েছি। রামমোহন রায়ের বাড়ি, মিষ্টান্ন কারকাণ্ডার খোঁজে। অনেক স্মৃতি। যেতে যেতে মনে পড়ছিল। দীপ্তেন্দুকে বলছিলাম। দিগরুইঘাটে ওঠার আগে একটা বাঁশের সাঁকো পড়ে। এই সাঁকোতে প্রথমবার কত মজা হয়েছিল প্রথমবার আসার সময়ে। এই পুরো রাস্তার সৌন্দর্য অসাধারণ।

কৃষ্ণনগরে কাজ মিটিয়ে ফেরাত পথে ঢুকলাম আটঘরা। এখানেই জঙ্গলবিলাস পিরের মেলা চলছে। জিজ্ঞাসা করতে করতে পৌঁছে যাওয়া। বড় রাস্তার পাশ থেকেই মেলার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আলো লাগানো প্রবেশপথ। রাস্তার দু’ধারে দোকানপাট। জিলিপি, জিভে গজা, খাজা, গুড়কাঠির পসরা। রয়েছে কাপড় ঘেরা রেস্তরাঁও। নদী বাঁধের ঠিক পাশেই পিরের আস্তানা। জায়গাটা আটঘরা হিসেবে পরিচিত হলেও এই এলাকার নাম সেকেন্দ্রাপুর।

মানতের নানা আকারের ঘোড়া।

জঙ্গলবিলাস পিরের আস্তানায় দু’টো জিনিস চোখ টানল। এক, বিশাল বিশাল মাটির ঘোড়া। সে ঘোড়ার উচ্চতা দু’মানুষের বেশি হবে। ছোটে আকারের ঘোড়াও রয়েছে। রঙিন ঘোড়াগুলো জায়গাটা আলো করে রয়েছে। আর দেখলাম, আস্তানার সামনেই একটা আটচালা। এমন বৈশিষ্ট্য স্বল্প ঘোরাঘুরিতে প্রায় দেখিইনি। দু’জনে আস্তানার কাছে গেলাম। সেখানে যেতে আরও ভাল লাগল ফলকগুলো দেখে। একটা ফলকে লেখা, ‘গেট এবং গ্রীল দাতা শ্রী নন্দলাল চট্টোপাধ্যায়’। আরেকটি ফলকে লেখা, ‘ঈশ্বর যতীন্দ্রনাথ নেমুর কনিষ্ঠপুত্র অজিত নেমু ১৪০০ বঙ্গাব্দ’।

এবার ইতিহাস খোঁজা। কিন্তু বলবেন কে? বাঁধের উপরে ঝুড়িতে ছোট ছোট মাটির ঘোড়া বিক্রি করছিলেন এক বৃদ্ধ। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘‘সে অনেকদিন আগের কথা। জঙ্গল থেকে উঠেছিলেন বলে জঙ্গলবিলাস পির নাম।’’ তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। আমরা মাটির ঘোড়ার বিষয়ে জানতে চাইলাম। বৃদ্ধ জানালেন, তাঁরাই মাটির ঘোড়া তৈরি করেন। আর বড় ঘোড়াগুলো? ওগুলোও তাঁরা তৈরি করেন। তবে বরাত দিতে হয়। ঘোড়াগুলো কেন দেওয়া হয়? ঘোড়া বিক্রেতা জানালেন, লোকেরা মানত করে। মনোকামনা পূরণ হলে তাঁরা ঘোড়া দেন।

আস্তানার পাশে ঘোড়া।

ঘোড়ার বিষয় তো জানা গেল। কিন্তু জঙ্গলবিলাস পিরের আগমনের তথ্য? না জেনে ফিরে যাব! দীপ্তেন্দু বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করে জানল পিরের সেবায়েত নন্দীরা। কাছেই বাড়ি। তাই একবার খোঁজ করেই যাব ঠিক হল। নন্দী বাড়িতেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন জঙ্গলবিলাস পিরের খাদেম ইসমাইল শাহ ওরফে মজনু আলি শাহ। বাড়ি আরামবাগের গৌরহাটি। চার পুরুষের খাদেম তাঁরা। তবে জঙ্গলবিলাস পিরের উদ্ভব কাল সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে পারলেন না। শুধু জানালেন, একশো বছরেরও বেশি আগে নন্দীবাড়ির কোনও এক কর্তা স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। স্বপ্নে তাঁকে বলা হয়, দামোদরের তীরে এক জায়গায় পির আছেন। তাঁকে যেন সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। যে জায়গাটির কথা স্বপ্নে বলা হয়েছিল সেখানে একটা দহের মতো তৈরি হয়েছিল। দ্বীপ অংশটা ছিল জঙ্গলে ঘেরা। জঙ্গলের মধ্যে নন্দীবাড়ির কর্তা একটা গম্বুজের মতো পান। তার পর জায়গাটি পরিষ্কার করে পিরের আস্তানা তৈরি করেন। জঙ্গল থেকে উদ্ভব বলে পিরের নাম হয়, জঙ্গলবিলাস। এর বেশি তিনি কিছু জানেন না। তাঁরা কী ভাবে এখানকার খাদেম যুক্ত হলেন? ইসমাইল শাহ জানালেন, সঠিক জানেন না। সম্ভবত তাঁদের কোনও পূর্বপুরুষ এই এলাকায় এসেছিলেন। নন্দীরা তাঁকে খাদেম নিযুক্ত করেন।

পিরের পুজো বা মেলা হয় রাসের ন’দিন পরে। পিরের থানে দেওয়া হয় পাকা সিন্নি এবং ঘোড়া। বাতাসাকেই পাকা সিন্নি বলা হয়। মেলার প্রথম তিনদিন পিরের গান হয়। বাইরে থেকে গানের দল আসেন। কেউ কেউ পিরের গানের মানত করেন। মানতকারীর খরচে পিরের গান আরেকদিন বেশি হয়। এখানে দৈনিক পুজোও হয়। সে পুজোর ব্যবস্থা করেন নন্দীরা। সব ধর্মের মানুষ পিরের কাছে মানত করেন। ভক্তি করেন।

দামোদরের অবস্থা।

আমরা ফলক এবং আটচালার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। খাদেম সাহেব জানালেন, মানতকারীর দান। তাঁদের কেউ আস্তানার পাশের ছোট ছোট ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। কেউ অন্য কিছু দিয়েছেন। আটচালাটা কমিটির তৈরি। কথার মাঝেই বেরিয়ে এলেন অভিজিৎ নন্দী। তিনি নন্দীবাড়ির উত্তর পুরুষ। তবে জঙ্গলবিলাস পিরের বিষয়ে খাদেম সাহেবের থেকে বেশি কিছু বলতে পারলেন না। জানালেন, তাঁরা ব্যবসায়ী ছিলেন। জায়গা জমি ছিল। আর জানালেন, বড় করে মেলাটা পরের দিকে শুরু হয়েছে। এলাকার পরিবর্তনও হয়েছে সময়ের সঙ্গে। যে দামোদরের তীরে জঙ্গলবিলাস পিরের উদ্ভব সেই নদ এখন মরে হেজে গিয়েছে।

ফেরার সময়ে দীপ্তেন্দুর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। আমরা দু’জনেই স্বপ্নাদেশে পিরের উদ্ভবের বিষয়ে শুনিনি। খাদেম সাহেব বলছিলেন, জঙ্গলবিলাস পিরের আস্তানায় কোনও সমাধি নেই। একটা গম্বুজ মতো করা আছে। জঙ্গলবিলাস পির নানা দিক থেকেই গবেষকদের আগ্রহ হতে পারেন।

আমি অত পণ্ডিত নই। আমার আগ্রহ জঙ্গলবিলাস পিরের সমন্বয়ের মহিমায়। বৈচিত্রের মধ্যে মিলন মহান ভারতের মূল সুরটি তিনি ধরে রাখতে পেরেছেন। সুরে শুধু সমন্বয় ও সম্প্রীতির আহ্বান।

কভারের ছবি— মাঝের বাঘের মূর্তি দেওয়া নির্মাণটি পিরের আস্তানা।

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *