শালবনি
জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

জঙ্গলপথে ঘুরতে ঘুরতে ভীমপুর গির্জায়

দীপক দাস

ভুল করলে সব সময় মাসুল দিতে হয় না। প্রাপ্তি যোগও হয়। যেমন হল আমাদের গন্তব্য ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ায়। নবমীর দিন দল বেঁধে বেরিয়েছিলাম ঘুরতে। গাড়ি নিয়ে। এবার দলটা খুব বড় না হলেও খারাপ নয়। মাঝারির থেকে একটু বড়।

গন্তব্য ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর। আরও স্পষ্ট করে বললে কর্ণগড়। রানি শিরোমণির গড়। সহকর্মী বরুণের থেকে ফোনে পথ নির্দেশ জেনেছিলাম। সে একেবারে নির্দেশ দিয়ে পেন-খাতা নিতে বসিয়েছিল। যাত্রাপথের বড় জায়গাগুলো পরপর লিখিয়ে দিয়েছিল। পইপই করে বলেছিল বীরেন্দ্র সেতু ছাড়িয়ে কিছুটা গিয়েই ভাদুতলা। তার একটু আগেই ডানহাতি রাস্তায় কর্ণগড়।

রাস্তার পাশের প্রকৃতির এক ঝলক।

আমরা কথা বলতে বলতে কখন ভাদুতলা পেরিয়ে গিয়েছি বুঝতে পারিনি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। সবুজের মাঝে কালো পিচের সড়ক আর সাঁই সাঁই করে ছুটে চলায় মোহমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। গোটা দলই উত্তেজিত। সকলের মুখে একটা কথা, এই তো এবার জমেছে আমাদের সফর। জঙ্গলে না গেলে কি আমাদের পুজো জমে! গত কয়েক বছর তো পুজোয় জঙ্গলে জঙ্গলেই কাটিয়েছি। এ বছর বেরনোই হচ্ছিল না। শেষ মুহূর্তে বেরিয়ে জঙ্গল পেয়ে খুব খুশি। সকলে নয়। আমার ছোট ভাই ভোরবেলা উঠে সামলাতে পারেনি। গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।

হঠাৎ দেখা ছোটখাট ক্যানভাস।

ভাদুতলা পেরিয়ে এসেছি বুঝতে পারলাম টিফিন করতে গিয়ে। খাবার দোকানেই পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করে নেওয়া হল। সাহায্য করলেন দোকানে খেতে আসা এক স্থানীয় ভদ্রলোক। ঠিক হল, প্রথমে দেখব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশদের তৈরি শালবনির এয়ারফিল্ড (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিমানঘাঁটির খোঁজে জঙ্গলে দ্রষ্টব্য)। তার পর যাব ভীমপুর গির্জা দেখতে। সেখান থেকে ফিরে আসব ভাদুতলায়।

ঘন জঙ্গলের পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটছে।

শালবনির এয়ারফিল্ড দেখে যাত্রা শুরু হল ভীমপুরের দিকে। পথে নানারকম দৃশ্য। ছোট ছোট গ্রাম। পথের পাশে দিগন্ত জোড়া চাষের জমি। রাস্তায় হঠাৎ সামনে চলে আসা গরুর পাল। কখনও মোষের দল নিয়ে ঘরে ফেরা পালক। দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। পথে পড়ল অপূর্ব সুন্দর এক জঙ্গল। কী নাম কে জানে। কাউকে জিজ্ঞাসা করার মতো লোক পেলাম না। গোদাপিয়াশাল কি?

ভীমপুরের গির্জা।

গাড়ি ছুটে চলছে আর আমরা সরে সরে যাওয়া জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি তো কোনও সুন্দর বাদ না পড়ে সে জন্য দু’ধারেই তাকাচ্ছি। সারা রাস্তা ইন্দ্র গাড়ির সামনের সিটে বসেছিল। কিন্তু কোনও কাজ করেনি। না দেখেছে জায়গার নাম। না তুলেছে ছবি। ফলে ওকে চালান করে দিয়েছি একেবারে পিছনের সিটে। কিন্তু ওকে কি সহজে জঙ্গল দেখানো যায়! আমাদের রেশন থেকে মুড়ি, শসা, চানাচুর বার করে খেতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে জঙ্গলের তারিফ করছিল বটে। ভাই তখন জেগেছে। বাবলা জঙ্গল আর ইন্দ্রর খাবার দিকে নজর রাখছিল। আর দীপু ওর কাজ করছিল। ছবি তুলছিল।

গির্জার চারপাশে।

ভীমপুর পৌঁছতে পথে অনেকবার থামতে হয়েছিল। বারবার পথ জিজ্ঞাসা করতে হচ্ছিল। কারণ কিছুক্ষণ আগে এগিয়ে যাওয়ার ভুল করেছি। ভীমপুরের পথে সেই ভয় ছিলই। তার উপরে কোনও দু’মাথা তিন মাথা এলেই সংশয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। ভুল দিকে চলে গেলে সময় নষ্ট। পথে একটা মজা হয়েছিল। একটা গ্রাম দেখেছিলাম। পূর্ত বিভাগের সাইনবোর্ডে নাম লেখা পাথরা। এটাই কি সেই মন্দিরময় গ্রামের পাথরা! একটা ঝুপড়ি মতো দোকানে জিজ্ঞাসা করা হল। উত্তর এল, সে পাথরা অনেক দূর। আবার গাড়ি চলল।

এ রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় অনন্ত সময়।

অবশেষে পৌঁছলাম ভীমপুরে। রাস্তার পাশেই ছিমছাম একটা গির্জা। সাদা রঙের। গির্জার ছবি বলতে মনে যে ছবি ভেসে ওঠে সেই রকম নয়। স্থাপত্যের বিশেষত্বও তেমন নেই। আমেরিকান ব্যাপটিস্ট চার্চ। বিশেষত্ব না থাকলেও ভীমপুরের গির্জার ঐতিহাসিক এবং সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রাচীনতম গির্জাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। মূল লক্ষ্য ছিল এলাকায় ধর্ম প্রচার। কিন্তু ভীমপুরের মিশনারিরা শুধু সে কাজেই নিজেদের আবদ্ধ রাখেননি। তাঁরা এলাকায় শিক্ষা বিস্তারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সাঁওতাল ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। স্থাপন করেছিলেন স্কুল এবং মেয়েদের হস্টেল। মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মিশনারিরা। গির্জা থেকে কিছু খোঁজখবর করা হয়নি। কারণ প্রবেশ পথের দরজায় দেখলাম তালা দেওয়া। গির্জার চারপাশটা বেশ সুন্দর। গাছগাছালিতে ভরা।

একাকী এক বাড়ি।

এবার ফেরার পালা। ভাদুতলার দিকে গাড়ি ছুটল। আবার প্রকৃতি আবার জঙ্গল। ভীমপুর থেকে বেরিয়ে কিছুটা আসার পরে জঙ্গল শুরু হল। তার আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। ভিজে কালো রাস্তা, জলে ধোয়া শালগাছ অন্য রূপ ফুটিয়ে তুলেছিল। শালবনি থেকে ভাদুতলা পর্যন্ত আসার পথে দু’টো জঙ্গল পার হওয়ার কথা। একটা গোদাপিয়াশাল আরেকটা পিরাকাটা। প্রথম দেখা জঙ্গলটা সম্ভবত পিরাকাটা। গাড়িতে বসে সবাই মিলে পথের পাশে চকিতে দেখতে পাওয়া গ্রামের নামগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলাম। বেশি মনে পড়ল না। সিজুয়া-গোবিন্দপুর-তিলাখুলা-চকতারিণী মনে পড়ল। আর দেখলাম কয়মা। নামটা চেনা। এখানে একটা স্টেডিয়াম আছে শুনেছিলাম। গ্রাম দেখেছিলাম। আর দেখেছিলাম বাড়ি। মাটির দোতলা। টিনের ছাউনি। কোনওটা অ্যাসবেসটসের।

জঙ্গলমহল ভাদুতলা স্টেশন।

এসব দেখতে দেখতে এসে পড়েছিলাম এক রেললাইনের সামনে। ডানদিকে তাকাতে দেখি একটা স্টেশন। নাম দেখলাম জঙ্গলমহল ভাদুতলা। রাজনৈতিক কারণে ভাদুতলা সবসময়েই আলোচনায় থাকে। গোটা জেলাটাই তো জঙ্গলমহল। এই এলাকা তো বটেই। আলাদা করে জঙ্গলমহল নাম কেন কে জানে?

স্টেশনের নামটা দেখে সকলে স্বস্তি পেলাম। গন্তব্যের কাছে এসে গিয়েছি। এবার খেয়ে নিতে হবে। না হলে ইন্দ্র আমাদেরই খেয়ে নেবে।

ছবি— দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *