জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

আড়বাঁশিতে মন ভাঙা ঢেউ— অন্য দিঘা

রবিশঙ্কর দত্ত

বেশ সেজেছে দিঘা। অন্তত আমার মতো যাঁরা এক-দেড় দশক পরে বেলাভূমিতে দু’চার ঘণ্টা থিতু হওয়ার সুযোগ পাবেন, তাঁদের কাছে তো সবই নতুন।

এ সাজ নিয়ে দু’রকম মত আছে। সে সব কিছু নিয়েই থাকে। আমার চোখে ভালই। তবে দিঘার রূপ-লাবণ্য বাঙালির তো মুখস্থ। আমার লেখা তা নিয়ে নয়ও। কর্মসূত্রে দিঘায় গিয়ে এই সাজ চোখে তো পড়েইছে, এই যাত্রায় সমুদ্রপারে এক জোড়া ‘মুক্তো’ পেয়েছি আমি। চোখকান খোলা রাখলে যে কেউ-ই পেতে পারেন। একটু চেষ্টায় ধরা দিতেই পারে নতুন দিঘা। সেখানে থাকছে— ‘মাছ, মিউজিক অ্যান্ড মোর।’

ভোরের ধোঁয়া ওঠা ইশারা।

হোটেল যত দামি বা আরামদায়কই হোক না কেন, সে সব ছেড়ে পথে থাকাই তো বেড়ানোর প্রথম শর্ত। তাই রাতে থালা জোড়া পমফ্রেটে পেট ভরিয়েও বিছানা ছাড়তে দেরি করিনি। বিনা চায়েই ঘর ছেড়েছি, বিনা অনুযোগে।একেবারে অন্ধকার থাকতে একাই বেরিয়ে পড়েছিলাম শিরশিরে হাওয়ার টানে। দু’পা এগোতেই কানে এল সেই সুর। আড়বাঁশিতে বাজছে। মাথায় সরু বঁড়শি বেঁধে শিকারি যেমন মাছের জন্য তা অনেক অনেক দূর পর্যন্ত ছুড়ে দেয়, বাঁশিওয়ালার অস্পষ্ট অবয়ব থেকে ঠিক সেই রকমই ছড়িয়ে পড়েছে তা। সূর্যও অস্পষ্ট। কিন্তু তার হালকা লাল আভা আর আটের দশকের লতা-মুকুশের ডুয়েট মায়ার আবেশ তৈরি করেছে পুরনো দিঘার পার জুড়ে।

আমার কয়েক হাতের মধ্যেই তৈরি ধোঁয়া ওঠা কফি। ইশারায় তা আরও কাছে। চাইলে বারবার। সঙ্গে একটার পর একটা গান। পাগল বাঁশিতে ঢেউ উঠেছে তীর জুড়ে। জল যখন সবে লাল হতে শুরু করেছে, তখন আমার আশপাশে আরও কিছু মুগ্ধ মুখ। আলাপ বাড়ছে। তারপর আত্মীয়তাও। 

সুরসঙ্গী।

সমুদ্রে বেড়ানো তখন একেবারে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে আমাদের। মনে হচ্ছিল, কোনও সাগরপারের কনসার্ট শুনতে আমি ভিন্ন মেরুতে। এই মাত্রায় নিজেকে জুড়ে দিতে এক কাপ ছবিসহ হাতটা বাড়িয়েই দিলাম। বুঝলাম ভুল করিনি। শিল্পী তিনি হৃদয়েও। পরিচয় হল শিশির সিংহের সঙ্গে।

দাশনগরের ভদ্রলোকের ব্যক্তিত্ব সকালের সমুদ্রের মতোই সুন্দর। পরিচয় করিয়ে দিলেন পাশে বসা সহধর্মিণী সুপ্রীতির সঙ্গেও। সুরেই নয়, প্রেমিক তিনি জীবনেও। প্রায় অর্ধশতকের সঙ্গীরও এই সম্পর্ক নিয়ে কী বিনয়ী অহঙ্কার! সে সবের ফাঁকে ফাঁকে শিশিরবাবুর বাঁশির সুরে দিঘার বেলাভূমিতে কখনও কিশোরকুমার, কখনও মহম্মদ রফি আবার কখনও হেমন্ত আর মান্না। সঙ্গীতের মতো অসীমস্পর্শী সিংহ হৃদয় দম্পতির। পুত্র, পুত্রবধূ, নাতিকে নিয়ে দিন কয়েক দিঘার সংসারে। সারা দেশ ঘুরেছে এই সিংহ পরিবার।

বীথি পথে একা।

পার ধরে ডান দিকে জগন্নাথ ঘাটের দিকে এগিয়ে আর একটু গেলেই সেই মন্দির। রাজ্য সরকার পুরীর আদল-আবহ দিতে চাইছে। এখনও সে কাজ এগোয়নি। সে সব নিয়ে কথা এগোলে এই ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় একটা সরল আড্ডা আটকে দিতে পারে অনকটা সময়। এটা বিকেলে হলেই ভাল। পাশের খাদালগোবরা গ্রামের সাধনবাবু, রমেশবাবুর মতো স্থানীয় দু’চারজন স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সঙ্গ দেবেন। বলবেন, এই মন্দিরের বিগ্রহ কে, কীভাবে প্রথম দেখেছিলেন। কে তা তুলে এনেছিলেন। যাচাই করা কঠিন। তবে ঝাউবনের সামনে বসে এ এক উত্তম সঙ্গত। ভালই লাগবে শুনতে, এই পূর্বপুটিয়ারির মণ্ডল দম্পতির কথা। তাঁরাই তো নিজেদের খরচে এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন।

জগন্নাথ মন্দির।

পাড়ার মাথা গুণে চাঁদা তোলা প্যাকেজ, ছাত্রাবস্থার চঞ্চলতা আর বউ-বাচ্চা সহ— দিঘার বেড়ানোর সবরকম অভিজ্ঞতাকে চ্যালেঞ্জ করতেই পারে এবারের মুগ্ধতা। শুধু শিশির-সুপ্রীতির মতো কাউকে খুঁজে নিতে হবে। আর আড়ালের আড় ভেঙে একটা আড্ডাবাজ আপনাকে সাহস জোগাতে হবে।

নিশ্চয়ই পারবেন। তবে চেষ্টাটা শুরু করতে হবে নিজের পাড়া থেকেই।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *