বাকসি হাট থেকে।
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ছাপা গাছের গ্রাম পেরিয়ে শুশুক দর্শন

দীপশেখর দাস

বিলেতে নাকি লোকে সপ্তাহ শেষের একদিনের ছুটিতে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। আমেরিকাতেও এরকম চল আছে। আমেরিকা বা বিলেত ভারী সুন্দর জায়গা। তাদের সমুদ্র পার ভাল, ঝরনা ভাল, পার্ক ভাল। এমনকি গ্রামগুলোও সব ছবির মতো। গ্রাম বললে আমার চলবে না। বলতে হবে কান্ট্রিসাইড। এ দেশ থেকে লোকে কান্ট্রিসাইডে ঘুরতে গিয়ে চোখ কপালে তুলে ফেলে। কী সুন্দর! কী সুন্দর!

আমাদের দেশের গ্রাম না ঘুরেই বোধহয় তারা বিদেশের গ্রাম দেখতে যায়। কম সুন্দর নাকি আমাদের গ্রাম। বেশি দূরে যেতে হবে না। আমাদের হাওড়া জেলার যে কোনও গ্রামীণ প্রান্তের দিকে বেরিয়ে পড়লেই হাজার হাজার পিকচার পোস্টকার্ড দেখতে পাওয়া যাবে। এই মঙ্গলবার ঘুরতে গিয়ে আবার দেখলুম সেই পোস্টকার্ডগুলো।

শস্যশামলা।

নানা কারণে বেরনো হচ্ছিল না। একদিন বেরিয়ে পড়া গেল। সঙ্গীরা সব ব্যস্ত। তাই বুড়ো লোকটাকেই পিছনে বসিয়ে নিয়েছিলাম। একটা জায়গা আমাদের পছন্দ ছিল আগেই। আমতা পেরিয়ে সেহাগড়ি সেতুর পাশ দিয়ে নেমে কিছুটা গিয়েছিলাম। এখানে নিম্ন দামোদর বইছে। নদের দু’পাশে দু’টো রাস্তা। একটা কাঁচা। আরেকটা পাকা। কাঁচা সড়ক ধরে কিছুটা গিয়েছিলাম একবার। এবার ঠিক করলাম পাকা সড়ক ধরে কত দূর যাওয়া যায় দেখা যাক।

রোদের তেজ ছিল বেশ। তার মধ্যেই দামোদরের পাড়ের পাকা সড়কে পৌঁছতে মন জুড়িয়ে গেল। এক দিকে নদ। তার আগে উলু বন। রাস্তার আরেক পাশে অনেক গাছপালা। রাস্তার নীচ থেকে শুরু হচ্ছে চাষ জমি। বিঘের পর বিঘে। জমির মাঝে ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর। পরপর ধান জমির মাঝে একখানা ঢেঁড়শের খেত। এক চাষি ফসল তুলছেন দেখতে পেলুম।

ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্তরা।

তার পরে আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া। কিছুটা এগোতে দেখলাম, বাঁ পাশে একটা ক্যানালের দু’পার বরাবর দু’টো রাস্তা চলে গিয়েছে। মোরাম বিছানো রাস্তা। দ্বিতীয় রাস্তাটায় ঢুকে পড়লাম। দু’পাশটা গাছপালায় ভর্তি। নিশ্চয় কোনও গ্রামে ঢোকার রাস্তা। কিছুটা এগোতে দেখি, রাস্তার উপরে দু’টো সাইকেল দাঁড় করানো। ছেলেপুলেরা আড্ডা দিচ্ছে ভেবেছিলাম। কাছে গিয়ে দেখি, ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্তরা বসে আছে ক্যানাল পারে। ছিপ হাতে। খানপাঁচেক ছিল। তারা মাছ ধরছে। ট্যাংরা কিনা জানি না। জিজ্ঞাসা করতে বলল, ছোট বড় সব মাছই খায়। শ্রীকান্তদের থেকে জেনে নিলাম, এই রাস্তা ধরে গেলে গ্রাম পড়বে কিনা। দলের সবচেয়ে ফোক্কড়টা বলল, ‘‘নিমতলার বাঁধ সিং পাড়া পড়বে।’’

কামারগোড়িয়া গ্রামের দৃশ্য।

এগোলাম। সঙ্গী মহাশয়ের ইচ্ছা ছিল, রাস্তা ধরে যতটা পারা যায় এগোনো যাক। ক্যানালের ওপারের রাস্তাটা এপারের সঙ্গে কোথায় মেলে দেখতে হবে। এই রাস্তাটাও বাঁধের রাস্তা। বাঁধের পাশে খালের জলে চাষিরা পাট কাচছেন। একটা দু’টো বাড়ি। সে সব পেরিয়ে একটা পাকা পোল চোখে পড়ল। পোলের অপর প্রান্তে গাছের ছায়ায় গ্রামের কিছু লোক আড্ডা দিচ্ছেন। এ পারে এক বৃদ্ধ গরু চরাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে জানলাম, ও পারটা কামারগোড়িয়া। লোকগুলো কামারগোড়িয়ার দিকেই আড্ডা দিচ্ছিলেন। সেখানে একটা ইস্কুলও ছিল। নাম কামারগোড়িয়া শিশু শিক্ষা কেন্দ্র। আমতা ২ ব্লক, জয়পুর, হাওড়া। গ্রামের নাম কামারগোড়িয়া কেন জানার চেষ্টা করছিলাম। কামাররা কি ছিলেন? না বললেন আড্ডাধারীরা। জানালেন, এ গ্রামে কামার নেই। কিন্তু অন্য নানা পদবির লোকের বাস আছে।

বাঁকে নিয়েছে নদ।

ফিরতে শুরু করলাম আবার নদের পাশের পাকা রাস্তার দিকে। অস্ত যাওয়ার আগে সূর্যদেব শেষ তেজ দেখিয়ে দিচ্ছেন। চড়া রোদ জলে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে লাগছে। একটা জায়গা এসে নদ কিছুটা বাঁক নিতে আলোর প্রতিফলনের হাত থেকে বাঁচা গেল। আরও কিছুটা যাওয়ার পরে একটা সেতু চোখে পড়ল। যথারীতি নীল-সাদা। ওটা জয়পুর সেতু। সেতুতে ওঠার মুখে একটা চায়ের গুমটি। এক পাশে যাত্রী প্রতীক্ষালয়। আমার সঙ্গী বুড়ো লোকটা চায়ের দোকানে কথা বলছিল। আমি সেতুতে ওঠে ছবি তুলছিলাম। ছবি তোলার সময়ে এক উৎসাহীর পাল্লায় পড়ে গিয়েছিলাম। ব্যাটার নিশ্চয় মাথার ব্যামো। বলে কিনা ছবি তুলে দিতে। পরে ওর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠিয়ে দিতে হবে।

দূরে জয়পুর-খালনা সেতু।

উৎসাহী ছেলেটিকে নিরস্ত করে ফিরে আসছি বুড়ো লোকটাও দেখলাম সেতুতে উঠছে। হাসতে হাসতে বলল, ‘‘দারুণ তথ্য পেয়েছি।’’ কী তথ্য? এই জায়গাটার নাম ছাবগাছতলা। কী করে নাম হয়েছে? চায়ের দোকানি নাকি বলেছেন, এখানে কোনও এক সময়ে অচেনা একটা গাছ বসানো হয়েছিল। তার পাতাগুলো ছিল ছাপা ছাপা। তা থেকেই এমন নাম। তবে চায়ের দোকানে থাকা একটা লোক নাকি প্রতিবাদ করে বলেছিল, এটা কারণ নয়। এখানে আগে অনেক ঝাউগাছ ছিল। ঝাউ পরে ছাব হয়েছে। কোনটা ঠিক কে জানে? বুড়োটাও সংশয়ে পড়ে গিয়েছে দেখলাম। সংশয় বাড়াল সেতুর পরিচয় দেওয়া বোর্ডটা। তাতে আবার লেখা, জায়গাটার নাম সাবগাছতলা। কী মুশকিল। তবে বোর্ড থেকে জানতে পারলাম, সেতুটা মুকুন্দদিঘি রোডের উপরে হয়েছে। সেতুর নীচ দিয়ে যে জলস্রোত তার নাম শর্ট কাট চ্যানেল। এই জায়গাটা খালনা। ওপারটা জয়পুর। যে জয়পুরে আমরা একবার অভিযান করেছিলাম। ১৩টি লৌকিক দেব দেবীর থান আছে ওই গ্রামে।

দুধ দোয়াচ্ছেন দম্পতি।

গ্রামের নাম নিয়ে যতই সংশয়ে পড়ুক গন্তব্য একটা জেনে নিয়েছিল আমার সঙ্গী। আমরা যাব বাকসি। সেখানে বাকসি হাট দেখে বাড়ি ফিরব। একদম সিধে রাস্তা। বাঁধের এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে এগোতে লাগলাম। বাঁধের উপরে দু’একটা ঘর। বাচ্চারা খেলছে। মায়েরা কেউ গরু নিয়ে বসে আছেন। কেউ ডালপালা জোগাড় করছেন। কেউ গরু নিয়ে ফিরছেন। এক ছোকরা মদ খেয়ে টলতে টলতে ফিরে মায়ের সঙ্গে ঝামেলা করছে। ও হ্যাঁ, একটা দৃশ্যের কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। জয়পুর সেতুর কাছে নদের চরায় এক বৃদ্ধ দম্পতিকে দেখেছিলাম। বৃদ্ধা গরুর দুধ দোয়াচ্ছেন। বৃদ্ধ গরুটিকে ধরে রয়েছেন। কান্ট্রিসাইড। আমাদের বাংলার চিরকালীন ছবি।

এই জায়গার নাম তেখালা। তিনদিকের জলধারা ক্যামেরায় আসেনি। এখানেই দেখেছিলাম শুশুক।

জীবন দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম একটা কাঠের পোলের কাছে। একজনের থেকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, জায়গাটার নাম তেখালা। এটা আসলে জলপথের তেমাথার মোড়। দু’দিক থেকে দু’টো খাল এসে নদের সঙ্গে মিশেছে। ওপারটা কাশমূল্লি। এ পারে কোনও পাড়া নেই দেখলাম। ওপারে একটা মন্দির দেখা যাচ্ছে। একটা বৃদ্ধা নৌকা বেয়ে দু’জনকে নিয়ে ওপারে গিয়েছেন দেখলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি হঠাৎ দেখলাম, কী একটা ভুস করে উঠেই ডুবে গেল। আরে শুশুক যে! দীপকদাও দেখেছে। উত্তেজিত আমরা। তার পর অনেকবার শুশুকের ভেসে ওঠা, ডুবে যাওয়া দেখলাম। কিন্তু ছবি তুলতে পারলাম না। না তুলতে পারি চোখ তো সার্থক হয়েছে।

সেই বৃদ্ধা মাঝি।

আবার যাত্রা শুরু হল। এবার কুলিয়া সেতু, বাকসি খেলার মাঠ পার করে বাকসি হাটে পৌঁছলাম। এখানে নদী বিশাল চওড়া। দূরে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। আকাশে অল্প কালো মেঘ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ঘাটের কাছে নৌকা বাঁধা। তা থেকে ধানের বস্তা নামছে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এই জায়গাটার এমন অবস্থান একটা সিগারেট ধরিয়ে তিন জেলা ঘুরে আসা যায়। একটা জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর। ঠিক ওপারের জায়গাটা দাসপুর। ওখানে ত্রিবেণী পার্ক করা হয়েছে। আরেক দিকে হুগলি। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেই বাকসি হল হাওড়া জেলা।

বাকসি হাটের চালা।

বাকসির হাটের নাম শুনেছি। এখানে মাটির জিনিস পাওয়া যায়। লোকমুখে শুনলাম, মাটির জিনিস আসে বেরাল থেকে। মঙ্গলবার হাটবার নয়। এখানে হাট বসে বুধ ও রবিবার। খালি হাটচালার ছবি তুলেই ফিরে আসছিলাম। তখনই দেখতে পেলাম, একটা মিষ্টির দোকান। দোকানের শোকেসে তিনটে গামলা। একটায় পান্তুয়া। দু’চারটে পড়ে আছে। বাকি দু’টোয় রসগোল্লা। টেস্ট করে দেখার ইচ্ছে হল। পান্তুয়া আর রসগোল্লা একটা করে দিতে বললাম। দোকানদার নিজেই বললেন, ‘‘পান্তুয়া খেতে হবে না। রসগোল্লা খান।’’

দিনমণি চলেছেন অস্তাচলে।

শুনে এত ভাল লাগল! এই যুগে এমন সততা? রসগোল্লাগুলোও ভাল ছিল। মোলায়েম। স্পঞ্জ নয়। সততার সুন্দরে আর নরম মিষ্টিতে শেষ হল আমাদের ঘোরা। একদিনের আউটিং। বাংলার কান্ট্রিসাইড দর্শন।

কভারের ছবি— শেষ বেলায় বাকসি হাট থেকে

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *