ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

রাধানগরের মহানাগরিক

সৌগত পাল

বাইকে আমাদের প্রথম ভ্রমণ রাধানগর। আমাদের মানে ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপের। কেন যে রাধানগর বাছা হয়েছিল, এখন আর মনে নেই। রামমোহন রায়ের প্রতি ভক্তির কারণে? নাকি নতুন জায়গা দেখার আকাঙ্ক্ষায়? এখন ভুলে গিয়েছি।

তবে বেরিয়ে পড়েছিলুম এক মঙ্গলবার। আমরা ছ’জন। তিন বাইকে।

গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। তা নিয়ে নতুন করে বলারও কিছু নেই। শহুরে উন্নাসিকতায় কত লোকে অনায়াসে উচ্চারণ করে ‘গাঁইয়া কোথাকার?’ কেন বলে! কীসে তারা এগিয়ে? একমাত্র প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কারণে সুযোগসুবিধা বেশি পাওয়ার থেকে?

কথাটা মনে পড়ছিল রাধানগর যাওয়ার সময়ে। হাওড়ার রামপুর বাসস্ট্যান্ড পার হওয়ার পরেই রাস্তা খারাপ। পাড়াগুলো বেশ জমজমাট। তবুও কোন প্রাচীনকালের ইট পাতা রাস্তাঘাট। গোটা ইট একসময়ে ছিল। এখন একটা দু’টো টুকরোয় কোনওরকমে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। কারও বাইকের পিছনে বসে সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়াটা মশলামুড়ি মাখার মতো। মনে হচ্ছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই হাড়মাস নরম হয়ে বাইক থেকে গলে গড়িয়ে রাস্তায় পড়ব। কার্টুনের টম বেড়ালের মতো।

দম টিপে পেরনো গেল সে রাস্তা। কিন্তু তারপরে পড়লুম জলপরীক্ষায়। রাস্তা নেই। মাঝেই মাঝেই বাঁশের সাঁকো। ক্ষীণকায়া মুণ্ডেশ্বরী নদী বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে। সেই বাধা কাটাতে তৈরি বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো। তার উপর দিয়ে হেঁটে গেলেই মড়মড় শব্দে প্রবল আপত্তি জানাচ্ছে। শুভকে তো ঠেলে ঠেলেও সাঁকোর উপরে তোলা যাচ্ছিল না। বাইক নিয়ে পার হওয়া যাবে কী করে? ইন্দ্র পাকা চালক। সে-ও একটু থমকে। বাবলা নতুন চালানো শিখেছে। ওর চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছে। ওর ওই বড় বড় চোখের ছবি দেখে আমরা এখনও হাসাহাসি করি।

যারা সওয়ারি ছিলুম তারা হেঁটে পার হলুম সাঁকো। ইন্দ্র ‘জয় আস্তিক মুণি’ বলে (আগে গৈরিক দলের সমর্থক ছিল। বর্তমানে যুক্তিবাদী হয়েছে) বাইক চালিয়ে দিল। সে কী আওয়াজ! যেন শয়ে শয়ে রাক্ষসীর হাড় মড়মড়ি ব্যামো হয়েছে। তারা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

ঘাটের ওপারে গিয়ে আরেক আশ্চর্য। বাঁশের সাঁকোর জন্য টোলট্যাক্স! বাঁশের একটা দণ্ড দড়িকলের সাহায্যে ফেলা-তোলার ব্যবস্থা। একটি বাচ্চা সেই কাজ করছে। আর সাঁকো সওয়ারিদের থেকে টাকা আদায় করছে। সঙ্গী আরও দুই খোকা। হেঁটে আর সাইকেলে পার হলে এক টাকা করে। বাইকে দু’টাকা। ব্যবস্থা দেখে দীপু তো অবাক। ওর বিস্ময় আর কাটতে চায় না। বোধহয় ভাবছিল, বাইক নয়, টাইমমেশিনে করে রামমোহনের সময়ে এসে পড়েছে। দীপকদা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী রে তোরা ইস্কুল যাসনি?’ ওরা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আজ ছুটি।’

বাঁশের সাঁকোর ওপারে টোল প্লাজা।

টোল দিয়ে গিয়ে উঠলুম বড় দিগরুইঘাটে। গোপীমোহনপুরের এই ঘাটের কাছে মুণ্ডেশ্বরী বেশ চওড়া। আর তার প্রায় বুক ঘেঁষে চলেছে লম্বা কাঠের সেতু। দু’পাশে জল আর মাঝে ওই কাঠের সেতু দিয়ে বাইক চালাতে মজাই লাগে। একটু দূরে পাকা সেতুর কাজ চলছে। সেতুর একপাশে আদিগন্ত চাষের জমি। গাছগাছালি। জীবনানন্দ কেন বারবার এই বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছিলেন সেটা বেশ বোঝা যায়।

দিগরুইঘাট পার হতেই ইন্দ্র কেমন যেন আনচান করছিল। ওর এই ছটফটানিটা আমরা বুঝি। খিদে পেয়েছে। তাহলে খেয়েই নেওয়া যাক। এই জায়গায় কোনও ভাল খাবার দোকান পাওয়া যাবে ভাবিনি। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, খাবার দোকান ফেলে এসেছি। আবার ফেরা। দোকানটা কোথায় হতে পারে? ভাবনার মাঝেই ইন্দ্র ‘এই তো’ বলে এমন চিৎকার করে উঠল যেন ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর গুপ্তধন পেল। সেই দোকানে ঢুকতেই নজরে পড়ল বড় বড়। হান্ডা। মানে বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে ইন্দ্র দোকানটা আগেই দেখেছে। বলতে লজ্জা পাচ্ছিল।

দোকানে অর্ডার দিতে গিয়ে আর এক মজা। অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি, দোকানের মহিলাকর্মী প্লেটে বিরিয়ানি ঢালতে শুরু করেছেন। দলের সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে, খাবারের দোকানদারেরা ইন্দ্রকে দেখলে চাহিদা বুঝতে পারেন। বিভিন্ন অভিযানে এটা পরীক্ষিত সত্য। শুধু বুঝতে পারা নয়, পরিমাণটাও বেশি লাগবে সেটাও জেনে যাওয়া। এখানেও তাই ঘটল। দীপকদা প্রস্তাব দিয়েছিল, ইন্দ্রর খিদে পেয়েছে। ও এক প্লেট নিক। বাকিরা তিন প্লেট নিয়ে ভাগ করে নেব। কিন্তু বলার আগেই দোকানদার ছ’টা প্লেট নিয়ে হাজির।

দীপু আর শুভ মাছের ঝোল, ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। ওদের খাওয়ার জন্যই দেরি বেরোতে দেরি হয়েছিল। কিন্তু কেউই প্লেট ছাড়তে রাজি নয়। হুগলি জেলা। আলুর দেশ সেটা। এত আলু হয় যে চাষি ঘরে নিয়ে যায় না। মাঠে মাঠে খড়বিচালি চাপা দেওয়া আলুর ঢিপি দেখে এসেছি আসার পথে। বিরিয়ানিতে দু’টো করে ক্রিকেট বলের সাইজের আলু। একটুকরোও পড়ে রইল না।

রামমোহনের আমবাগান।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলুম রাধানগর। দেখা হল, সেই আমবাগান। যেখান থেকে রামমোহনের বিবর্তনের শুরু। এখানেই হয়েছিল তাঁর বউদি সহমরণে গিয়েছিলেন। যা দেখে বদ্ধ সমাজকে ধাক্কা দেওয়ার বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছিল রামমোহনের মনে। তারপরে যাওয়া হল, তাঁর পুরনো বসত ভিটেয়। দেখা হল ঘুরে ফিরে। কিছু দূরেই তাঁর নামাঙ্কিত কলেজ। সেটাও দেখা হল।

এবার ফেরার পালা। ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল, কী দেখলাম এই অভিযানে? ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ তিনি। কিন্তু তাঁর এলাকায় কোথায় আধুনিকতার ছোঁয়া? রাস্তাঘাট ভাল নয়। বর্ষাকালের দুর্দশাটা বেশ বোঝা যায়। এখানকার লোকেদের জীবনের উপকরণ এতই কম যে শহরে গেলে তাঁরা সেখানকার বাহুল্যে আপনা থেকেই কুঁকড়ে থাকবে। আর সেই সুযোগেই শহুরেরা তাঁদের গাঁইয়া উপাধি দেবে।

সতীদাহ বেদি।

অবশ্য আধুনিকতার কিছু উপজাত দ্রব্য সেখানে চোখে পড়েছিল। যেমন, রামমোহনের বাগানবাড়িতে বনভোজন করছিল একদল। তাদের প্লাস্টিকের গ্লাসে হলুদ হলুদ তরল চোখে পড়ল। সেদিন চৈত্রমাস। প্রচণ্ড গরমে চোখে সরষে ফুল দেখতেও পারি। রামমোহন কলেজের সামনে দেখেছিলুম, বিরাট কাটআউট। মাটির মানুষদের দিদির। রামমোহনের নামাঙ্কিত কলেজের সামনে তিনি কেন শোভা পাবেন? জানি না।

একদল লোক উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করতে করতে যাচ্ছিল, ‘এবার অনেকগুলো গ্যাছে রে!’ শুনে ভয় পেলুম আমরা। এই এলাকায় মাঝে মাঝেই রাজনৈতিক সংঘর্ষের খবর মেলে। কথা বলে সেই আশঙ্কা কাটল।

ব্রিস্টলের সমাধি স্মারকের আদলে তৈরি স্মারক।

সেদিন ছিল চড়ক সংক্রান্তি। এলাকার রীতি অনুযায়ী, গাজনের সন্ন্যাসীরা একযোগে নদীতে ঝাঁপ দেন। গতবার একজন মারা গিয়েছিলেন। এবার নাকি পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জাল ফেলে পাঁকে পোঁতা দেহগুলো তোলা হচ্ছে।

এখানকারই একটা মানুষ আজ থেকে বহু বছর আগে কালাপানি পার হওয়ার হিম্মত দেখিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের মনের ‘ধর্মের মোহে’র কালাপানি দূর করতে পারেননি। মনে হল।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *