ওড়িশায়।
খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মিষ্টিপথে বঙ্গ-বিহার ওড়িশায়

দীপক দাস

তৈরি করা পথ। প্রয়োজনেরও বলা যাতে পারে। যেমন, বাদশাহি সড়ক বা জগন্নাথ সড়ক। শের শাহের বাদশাহি সড়কের সৃষ্টি-কাহিনি সর্বজনজ্ঞাত। জগন্নাথ সড়ক মেদিনীপুরের দাঁতন থেকে পুরীর মন্দিরে যাওয়ার প্রাচীন পথ। যে পথের বর্তমান নাম ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড। তিন রাজ্য জুড়ে আমাদের এই মিষ্টিপথ এমনই এক তৈরি করা পথ। আচমকাই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটি কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে।

গত বছর অক্টোবরের কথা। করোনা অতিমারির ভয় ভেঙেছে। লোকজন বেরোচ্ছে। আমার দরকার পড়ল কলকাতায়। রোজ রাজধানীতে যাওয়া লোক বছরখানেক পরে কলকাতামুখী। উদ্যোগ পর্বে যোগ দিল দীপুবাবু। আমাদের মিস্টার ঘাসপুস। আমার দরকার বালিগঞ্জে। ওরও বালিগঞ্জে যাতায়াত আছে। দু’জনের কাজ মিটলে একসঙ্গে ফিরব। ফেরার স্থানচিহ্ন ছিল একটি মিষ্টির দোকান। মৌচাক। বালিগঞ্জ গার্ডেন্সের সেই বিখ্যাত দোকান। যেখানে দোকানের সমনামী একটি মিষ্টি বিপণীর মতোই জনপ্রিয়। বহু বছর ধরে মিষ্টি রসিকদের রসনা তৃপ্তি করে আসছে। আমরাই বা কেন অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ফিরব? সুতরাং মধুচক্রে দুই মউলির প্রবেশ এবং আস্বাদন।

দীপুর হাতে মৌচাক। এটা আধখানা মানেই একটা।

কেমন মিষ্টি মৌচাক? প্রথম দর্শনের কথা বলা যাক। পরে গুণ বিচার বা স্বাদ বিচার। মৌচাক দেখে প্রথমে যে কথাটা মনে হয়েছিল, এ গোটা মিষ্টি নয়। অর্ধেক। দেখতে অনেকটা জ্যামিতি বক্সের চাঁদার মতো। তবে চাঁদার মতো জিরো ফিগার নয়। ‘খাতে পিতে ঘর কা’। রং গাঢ় বাদামি। মিষ্টির উপরে ধারের দিকে ক্ষীরের একটা বর্ডার লাইন আছে। অর্ধগোলাকার দিকের ধার নয়। সরলরেখার দিকের ধার। এই ধারের দিকে মিষ্টিটা জাল জাল মতো। অনেকটা মৌচাকের প্রকোষ্ঠের মতো। এই জন্যই মৌচাক নাম।

খেতে কেমন? দীপু বলেছিল, ‘‘ভাজা ছানার একটা স্বাদ পাচ্ছি। কিন্তু ভিতরে কী আছে বুঝতে পারছি না।’’ আমিও বুঝতে পারিনি। বুঝতে দোকানের এক কর্মীর সাহায্য নিতে হল। তিনি জানালেন, মৌচাকের উপকরণ হল ছানা, মধু, ক্ষীর আর গুলকন্দ। গুলকন্দটা কী বুঝতে পারলাম না। ওই কর্মীও বলতে পারলেন না। বাড়ি ফিরে সাহায্য নিতে হল ‘চলন্তিকা’র। শব্দটা ফরাসি। এর অর্থ, গোলাপ জল দেওয়া মিষ্টান্ন। অর্থাৎ গুলকন্দ মিষ্টির একটি পরিবার। যে পরিবারের এক সদস্যের নাম, মৌচাক। মিষ্টিতে কামড় দিলে ভিতর থেকে মধু গড়িয়ে আসে। স্বাদ-মউলির জিভে সেই স্বাদ চারিয়ে যায়। উপকরণের বাহুল্যে মৌচাককে আমার মিষ্টির জগতের বিরিয়ানি বলতে ইচ্ছে করে। অতটা না হলেও পোলাও বলাই যায়। একটা মিষ্টিতে এত উপকরণ খাওয়ার সৌভাগ্য তেমন হয়নি।

ছানার টোস্ট।

মৌচাকে আমরা আরেকটা মিষ্টি খেয়েছিলাম। ছানার টোস্ট। বাংলার মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে বহুল প্রচলিত মাখন-টোস্ট যেমন দেখতে আকারটা তেমন। মূল উপকরণ ছানা। মাখন-টোস্টে পাউরুটির উপরে মাখন মাখানো হয়। ছানার টোস্টে পাউরুটির ভাগটা তৈরি হয় ছানা দিয়ে। তার উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ক্ষীরের গুঁড়ো। ছানার টোস্টের মতোই একটা মিষ্টি বাংলার মিষ্টান্ন ভান্ডারে রয়েছে। সেটির নাম টোস্ট সন্দেশ। প্রণব রায় জানিয়েছেন, কৃষ্ণনগরে এই মিষ্টি মেলে। নামে সন্দেশ হলেও আসলে রসগোল্লা জাতীয় মিষ্টি। বাটা ছানাকে চিনির রসে পাক করে টোস্টের আকারে কেটে নেওয়া হয়। তার উপরে গোলাপজল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। মৌচাকের ছানার টোস্টে গোলাপজলের গন্ধ পাইনি। একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। মৌচাকে আগে ছানার টোস্ট খাবেন। তার পর মৌচাক। না হলে মৌচাকের মধু, গুলকন্দ আর অন্য উপকরণের তীব্রতা স্বাদ কোরককে ছানার টোস্টের স্বাদ নিতে বাধা দেবে।

ওড়িশার রসগোল্লা। ভিতরে কোনও গর্ত নেই।

মৌচাক অভিযানের পরে পুজো এসে গেল। আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলে। গন্তব্য ছিল ঝাড়গ্রামের হাতিবাড়ি (‘নদীতে জিয়োনো মাছ আর হাতিবাড়ির রাত’ দ্রষ্টব্য)। জায়গাটা বাংলার শেষ সীমানা। এর পরেই ওড়িশা। এবার সঙ্গী দীপু ছাড়াও বাবলা এবং ইন্দ্র। ঠিক করেই নেওয়া হয়েছিল, আমরা যেখানেই যাব সেখানকার মিষ্টি চেখে দেখব। কিন্তু হাতিবাড়িতে বাংলার অংশে কোনও দোকানই দেখতে পাইনি। মিষ্টির দোকান বাড়াবাড়ি ধরনের চাওয়া। তবে ওড়িশা অংশে জামসোলার মোড়ে একটা দোকান পেয়েছিলাম। ঝুপড়ি দোকান। সেখানে দু’টো মিষ্টি পেয়েছিলাম। মালপোয়া আর জিলিপি। তখন কি জানতাম, এই দুই মিষ্টির প্রভাব এখানে কতটা!

ছানাপোড়ার স্বাদ নিচ্ছে ইন্দ্র।

ওড়িশায় আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল, ক্ষীরমোহন চাখার। রসগোল্লা নিয়ে বাংলা-ওড়িশা যুদ্ধে দাবি উঠেছিল, ক্ষীরমোহন নামের মিষ্টিটাই রসগোল্লার আদি পুরুষ। ক্ষীরমোহন নামক রসগোল্লাই বাংলায় ঢুকেছে পরে। এমন প্রত্নতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মিষ্টি চাখতে পারা একটা প্রাপ্তি। গিয়েছিলাম ময়ূরভঞ্জের দিকে। ডোকরা শিল্পীদের গ্রাম কুলিয়ানায়। পথে একটা বাজার এলাকা পড়েছিল। খাবারের দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্ষীরমোহন মেলেনি। তবে প্রতিটি দোকানে জিলিপি আর মালপোয়া মিলেছিল। একটা ছোট দোকানদার একটু এগিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভাই ভাই সুইটস নামে দোকানটি বড়। ওখানে ক্ষীরমোহন মিললেও মিলতে পারে।

বাঁদিকে কাতরা মালপোয়া। ডানদিকে কাকরা মালপোয়া।

দুই ভাই, মানে ভাই ভাই, হতাশ করল। ক্ষীরমোহন নেই। তবে দোকানটা সত্যিই বড়। অনেক ধরনের মিষ্টি থরে থরে এবং ডেকচিতে সাজানো। এসে যখন পড়েছি তখন ক্ষীরমোহনের বদলে ওড়িশার অন্য মিষ্টিতে স্বাদ পূরণ করা উচিত। বিশেষ করে মালপোয়ার। দোকানে দোকানে তার কেন এত প্রভাব? তা ছাড়া ওড়িশার ছানাপোড়ারও নাম শুনিছি।

শুরু হল মিষ্টি চাখা। রসগোল্লা দিয়েই শুরু। ক্ষীরমোহনের উত্তরসূরি রাজপাট ধরে রেখেছে কিনা বোঝার চেষ্টা আরকী। দোকানে তিন রকম দামের রসগোল্লা পাওয়া যাচ্ছিল। ৫, ১০ ও ২০ টাকার। ২০ টাকার রসগোল্লাগুলো জাম্বো আকারের। বড় আকারের জন্যই কিনা জানি না সেগুলো রস-চাকতি হয়ে উঠেছে। মানে গোল আকারটা ধরে রাখতে পারেনি। আমরা চাখলাম ৫, ১০। অতি সুস্বাদু। স্পঞ্জ নয়। নরম তুলতুলে। এরকম রসগোল্লা নদিয়া, বর্ধমান, চব্বিশ পরগনা, হুগলিতে খেয়েছি। আমার তো খুব ভাল লাগে এই ধরনের রসগোল্লা। আরেকটা বৈশিষ্ট্য নজরে এল। বাংলার রসগোল্লায় ভিতরে নকুলদানা দিয়ে ছানার গোল্লা পাকানো হয়। ফলে ভিতরে একটা গর্ত থাকে। ওড়িশার রসগোল্লার ভিতরে ফাঁপা অংশটা দেখলাম না।

জামসোলার সেই গুটলি মালপোয়া।

এর পর এল ছানাপোড়া। এই মিষ্টি পুরীতে জগন্নাথদেবের ভোগেও দেওয়া হয়। খেতে ভালই লেগেছিল আমার, দীপুর, বাবলার। কিন্তু মুশকিলে ফেলল ইন্দ্র। ছানাপোড়া মুখে দিয়েই বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে লাগল। নেতিবাচক নাড়া। মানে ওর ভাল লাগছে না। দেখেই প্রমাদ গুনলাম। আর কোনও তথ্য বুঝি মিলবে না। দোকানে দাঁড়িয়ে খাবারের বদনাম কোন দোকানদার সহ্য করবে? ইন্দ্র পরে বলেছিল, কটকে না কোথায় একটা ও ছানাপোড়া খেয়েছিল। সেই স্বাদের স্মৃতি নাকি ওর জিভ এখনও ধরে রেখেছে। তুলনায় ভাই ভাই হেরে গিয়েছিল বলে ও চটজলদি রায় জানিয়ে দিয়েছিল মাথা নেড়ে। দোকানদার জিজ্ঞাসাও করে বসেছিল, ‘‘কী ভাল নয়?’’ পরিস্থিতি কোনও মতে সামলে নেওয়া গিয়েছিল। উনি ছানাপোড়ার উপকরণও বললেন। সুজি, চিনি, ছানা, কাজু, গাওয়া ঘি এবং গুজরাতি এলাচ।

ভাই ভাইয়ের জাঁদরেল ল্যাংচা।

মালপোয়া আর খাবার মতো জায়গা ছিল না পেটে। তিন ধরনের মালপোয়া কিনে নিয়েছিলাম। চাখা হয়েছিল বাড়িতে ফিরে। আমার ব্যাগে রয়ে গিয়েছিল বলে আমিই শুধু স্বাদ পেয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় মালপোয়ার নাম কাকরা। দেখতে আমাদের বাঙালি মালপোয়ার মতো। বাঙালি মালপোয়া বাদামি হয়। এর রংটা সাদাটে। আর আকারে রুটি-পরোটার মতো। কাতরা মালপোয়া স্বাস্থ্যবান। গড়ন হাতের বালার মতো। তবে অনেকটা মোটা। ভীমের বালা বললেই মানানসই হয়। অন্যটা সাধারণ মালপোয়া। গুটলি মতো। হাতিবাড়ির কাছে জামসোলার দোকানে যেটা দেখেছিলাম। ওই দোকান থেকে কিনেছিলাম বলে ভাই ভাই থেকে গুটলি মালপোয়া কিনিনি। এই মালপোয়ার মাঝে ফুটো থাকে বালুশাহির মতো। মালপোয়ার উপকরণ মোটামুটি ময়দা, কলা, বাদাম, নারকেল। মৌড়ি। ভাজা হয় তেলে। ভাই ভাইয়ের দোকানে ল্যাংচাও ছিল বিশাল আকারের। আমাদের জিভ আর মিষ্টি নিতে পারছিল না। তাই খাইনি। এমন জাঁদরেল আকারের ল্যাংচা আমাদের বাংলাতেও মেলে।

ঝাড়খণ্ডের বহড়াগড়ার মিষ্টির দোকান।

এই সফরে আমরা আরেকটি রাজ্যেও প্রবেশ করেছিলাম। সাবেক বিহার। মানে ঝাড়খণ্ডে। ওড়িশা থেকে ঝাড়খণ্ডের বহড়াগড়া হয়েই ফিরি। ওখানকার দোকানে স্থানীয় মিষ্টির খোঁজ করেছিলাম। মেলেনি। সবই চেনা মিষ্টি। ছানাপোড়াও ছিল। ঝাড়খণ্ডের কোনও মিষ্টি চাখা হবে না! এই ভাবনা থেকে কাজু বরফি কেনা হয়েছিল। তাড়াহুড়োয় উপকরণ জানা হয়নি। বেশ জমাট ধরনের মিষ্টি। খাওয়ার সময়ে দাঁতের লড়াই চলে। স্বাদ বেশ ভাল।

কভারের ছবি— ওড়িশার ২০ টাকা দামের রসগোল্লা

ছবি— দীপশেখর দাস, ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *