জলবাড়ি।
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

নির্জনতার খোঁজে বেলুন ইকো-স্টে

তনয় শীল

ভরা বসন্তে প্রকৃতির ডাকে এবারের ভ্রমণে বেড়িয়ে এলাম ‘বেলুন ইকো-স্টে’। বেড়িয়ে এলাম মানে থেকে এলাম। নির্জনতার সঙ্গে গোটা একটা দিন-রাত। জায়গাটা পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহর থেকে কিছুটা দূরে। এলাকার লোকের কাছে এই ইকো-স্টে ‘কাটোয়া জলবাড়ি’ নামে বেশি পরিচিত।

ছায়া ঘেরা গ্রামের নির্জন পথ।

সপ্তাহান্তে নির্জনতার খোঁজে বেরিয়েছিলাম তিনবন্ধু। শিবম, অভ্র আর আমি। গত ৫ মার্চ, শনিবার সকাল ৫.৩৮ মিনিটের আপ কাটোয়া লোকাল ধরেছিলাম হাওড়া থেকে। আগের দিন রাতে ফোনে (৯৮৭৫৪৬৫৯৫৮) বুক করে রেখেছিলাম ঘর। তিনটি কৃত্রিম জলাশয়ে ঘেরা প্রায় ৩০ বিঘা জমির উপর জঙ্গলে ঘেরা এই ইকো-স্টে। ৪টি তিন শয্যার ঘর আছে। থাকা খাওয়া-সহ তিনজনের মাথা পিছু খরচ ২৫০০ টাকা। ফোন বুকিংয়ের সময় ৫০ শতাংশ টাকা অগ্রিম জমা করতে হয়। ম্যানেজার একজন টোটোচালকের নম্বর দিয়েছিলেন। ট্রেনে উঠেই ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি কাটোয়া স্টেশন থেকে আমাদের ৩০০ টাকা ভাড়ায় নিয়ে যাবেন।

দেখা হল অজয় নদের সঙ্গে।

ট্রেন ঢুকল কাটোয়া স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে টোটোয় চাপলাম। পৌঁছতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। মেন রোড ছেড়ে টোটো ঢুকল গ্রাম্য রাস্তায়। বসন্তের শুকনো ঝরা পাতা বিছানো রাস্তার উপর দিয়ে টোটো এগিয়ে চলল। জাজিগ্রাম, কোশিগ্রাম, খয়েরহাট, পুরুলিয়া গ্রাম, কেতুগ্রাম, অজয় নদ পেরিয়ে চলতে লাগলাম। বাইরে ক্রমশ সরে যাচ্ছে সবুজে সবুজ চাষের জমি। নজরে পড়ছিল হাতে গোনা কিছু শিমূল, পলাশ গাছ। ১০টা ৩০ মিনিটে টোটোচালক আমাদের পৌঁছে দিলেন ইকো-স্টেতে। ম্যানেজার আমাদের নামতে দেখে নিতে এলেন। ঘরে ঢুকতে এল ওয়েলকাম ড্রিংক্স। দিলেন লেবুর সরবত। ঘরের সঙ্গেই আছে অর্ধেক মাথা খোলা বাথরুম। উপর দিয়ে উঁকি মারছে ঘন জঙ্গল।

তিন জলাশয়ের একটি। জলবাড়ি নাম এ জন্যই।

ঘরের সামনে রয়েছে জলাশয়। যার উপর দিয়ে রয়েছে ঘরে ঢোকার রাস্তা। একপাশ দিয়ে অবিরত জল ঝরছে। জলবাড়ি নাম সার্থক। জলাশয়গুলোয় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রচুর মাছ এবং অনেক জলজ গাছ। চারিদিকের বিস্তীর্ণ জমিতে রয়েছে অগণিত ফুল ও ফলের গাছ। চারিদিকে পাখির কূজন। পাশেই জঙ্গল। এখানে রয়েছে শেয়াল, বনবিড়াল, ভাম, বিভিন্ন সরীসৃপ প্রাণী। জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে একটি কালীর মন্দির। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে শিবাই নদ। নদে নৌকো চেপে ঘোরা যায়। জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে একটি বড় বাথটাব। এখানে স্নানের ব্যবস্থাও আছে। দুপুরে স্নানটা খোলা প্রকৃতিতে বাথটাবেই সারলাম।

এমন পরিবেশেই রয়েছে থাকার জায়গা।

এবার মধ্যাহ্ন ভোজনের পালা। টেবিলে বসতেই আমাদের সামনে খাবার পরিবেশিত হল। মেনুতে ছিল গরম সাদা ভাত, স্যালাড, মুগডাল, কাতলা মাছ ভাজা, শুক্তো, ফুলকপির তরকারি, কাতলা কালিয়া, চাটনি, পাঁপড়, পায়েস। খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ ভাত ঘুমের পর বিকেল ৪টেয় বেরিয়ে পড়লাম নদীতে নৌকা ভ্রমণে। নিজেরাই নৌকা চালিয়ে ঘুরতে লাগলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম দূর থেকে দূরে। নির্জন পরিবেশে জলের শব্দ, পাখির ডাক, প্রজাপতির মেলা, নুইয়ে পড়া গাছের ডাল, সে এক মায়াবী প্রকৃতি। পড়ন্ত সূর্য জানান দিল এবার ফেরার পালা।

শিবাইয়ে নৌকা বিহারের ব্যবস্থা

ঘাটে নৌকা বেঁধে ঘরে ফিরে এলাম। সন্ধ্যে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্জনতা যেন আরও গাঢ় হল। ঘরে ও বারান্দায় হালকা আলো জ্বলছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকির দল ঝিকমিকিয়ে উঠছে। কানে বাজছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হালকা শীতল হাওয়া বয়ে আসছে। এরই মাঝে রিসর্টকর্মী হাজির হলেন জলখাবার নিয়ে। সুন্দর ভাবে সাজিয়ে দিলেন মুড়ি, শশাকুচি, পেঁয়াজকুচি, লঙ্কাকুচি, টম্যাটোকুচি, চানাচুর, বেগুনি, চপ, চা। চায়ে চুমুক দিতে দিতে জলাশয়ে মুড়ি ছুড়ে দিতেই মাছের দল জড়ো হতে লাগল। মাছেরা খেলায় মেতে উঠল। এভাবেই সন্ধ্যা কেটে গেল। চাইলে অদ্ভুত রোমাঞ্চের অনুভূতি নিতে খুব সতর্কতা অবলম্বন করে জঙ্গলেও হেঁটে আসা যায়।

জলের ধারে আড্ডা দেওয়া যাবে খোলা বারান্দায় বসে।

রাত ৯টা ৩০ মিনিটে গেলাম নৈশভোজে। মেনুতে ছিল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, মিক্সড সবজি, আলু দিয়ে মাটনের পাতলা ঝোল, স্যালাড। এখান থেকে চাইলে গাড়ি বুক করে ঘুরে নেওয়া যেতে পারে মহালক্ষ্মী সতীপীঠ (১৮ কিমি), অট্টহাস মন্দির (২২ কিমি), নয়াচর (৪০ কিমি)। নয়চরে শিবাই নদ গঙ্গায় মিশেছে।

অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা।

রাত কাটল নির্জন নিস্তবতায়। সকাল ৮টায় ঘরে এল প্রাতরাশ। লুচি, আলুর দম, মিষ্টি। সকাল ১০টায় টোটোতে চেপে কাটোয়া স্টেশনে এলাম। নির্জনতা কাটিয়ে রওনা দিলাম যান্ত্রিক পরিবেশের দিকে।

কভারের ছবি— জঙ্গলের মাঝে জলধারা

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *