জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

নদীতে জিয়োনো মাছ আর হাতিবাড়ির রাত

দীপক দাস

চোখ চলে গেল ব্রণটার দিকে। ডান কপালে ভুরুর উপরে উঁচু হয়ে আছে। তখন ভোর রাত। ৪টে বাজে। দুর্গাপুজোর সপ্তমী। পুজোর আলোয় ব্রণ দেখতে অসুবিধে হয়নি। অসুবিধে হয়েছিল শুধু ইন্দ্রর। পুরো সফর জুড়ে ব্রণ আর ওর পিছন ছাড়েনি।

আমরা চলেছি পুজোকালীন সফরে। করোনা অতিমারিতে এক বছর সফর বন্ধ ছিল। এ বছর পুজোর সময়ে ভাইরাসের তেজ একটু কমতির দিকে হওয়ায় সাহস করে বেরিয়ে পড়া। হাওড়া থেকে ৬.৩৫ এর ইস্পাত ধরব। তার আগে বড়গাছিয়া বাস স্টপে জমায়েত। প্রতি বছরই হই। এবার একটু ব্যতিক্রম। প্রতি বছর দেরি করে ইন্দ্র। এ বছর দেরি করেছিল ছোটা ডন, বাবলা। ব্যাটা আসেই না। দীপু বলল, ও আর সকালে উঠতে পারে না। অনেক রাত পর্যন্ত মোবাইলে ব্যস্ত থাকে। শুনে প্রথম কথা যেটা মনে হয়েছিল, পরের বছর পুজোয় বাবলা আর যাচ্ছে না। মানে যাওয়ার সাহসে আর কুলোবে না ওর। কোনও পুরুষই সে সাহস আজ পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি। ইতিহাস সাক্ষী।

সিদো-কানু-বিরসা সেতু থেকে সুবর্ণরেখা।

যথেষ্ট দেরি করেছিল বাবলা। অতক্ষণ কী করা যায়? বিনোদন। ইন্দ্রর ব্রণ আছে তো! বললাম, ‘‘তাহলে বয়স তোর শেষ পর্যন্ত কমেই গেল?’’ ইন্দ্র সবসময় এমন হাবভাব করে যেন ওর বয়স সবে বয়:সন্ধির দোড়গোড়ায়। একদিন মঙ্গলবারের আড্ডায় এল ভাঙা গলা নিয়ে। এখন ব্রণ নিয়ে হাজির। আমাদের জিজ্ঞাসায় বেশ আনন্দই পাচ্ছিল।

অবশেষে বাবলা এল। আমার ছোটভাই বাইকে দিয়ে গেল। আমাদেরও দিয়ে গিয়েছিল। এর পরের সফর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবুও দু’টো ঘটনার কথা বলা উচিত। ঘটনা দু’টো নিমন্ত্রণ বাড়ির ভোজে পাতে নুন, লেবু দেওয়ার মতো। লোকে নুন, লেবু খেতে যায় না। কিন্তু বাদ দিলে গৃহকর্তার সুনামে ঘাটতি। প্রথম ঘটনা বড়গাছিয়াতেই। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। একটা হলুদ ট্যাক্সি হাওড়া ফিরছিল। পুজোর রাতে কোনও সওয়ারি এনেছিল সম্ভবত। ফেরত যাচ্ছে ভোরে। থামিয়ে ভাড়া জিজ্ঞাসা করতে চালক দর হাঁকলেন ৮০০ টাকা। বলে কী! ২৬ কিলোমিটার পথের চারজনের ভাড়া ৮০০ টাকা! বাসে ট্রেনে ঝাড়গ্রাম পৌঁছে গেলেও ওই ভাড়া থেকে শ’তিনেক বেঁচে যাবে। ট্যাক্সি চলে যেতে আমাদের মধ্যে একটা আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পর্ব চলল। ‘‘গ্রামের লোককে এরা ভাবে কী!’’ আমার মন্তব্য। দীপু বলল, ‘‘শহুরে ড্রাইভার তো। তাই ভেবেছিল যা বোঝাবে তাই বুঝবে।’’ মোক্ষম কথাটা বলেছিল বাবলা, ‘‘বাড়িতে প্রচুর দাবি। তাই পাগলের মতো দাম বলছে।’’

নদীর বুক থেকে তোলা বালির পাহাড়।

দ্বিতীয় ঘটনা বাসে। পুরাশ-হাওড়া মিনিবাসটা ফাঁকাই ছিল। বসার জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম। টিকিট কাটার সময়ে দীপু ইন্দ্রকে দেখিয়ে বলল, ‘‘হাফ টিকিটের ব্যবস্থা আছে? এর সবে ব্রণ উঠেছে।’’ কন্ডাক্টর হেসে ফেলেছিলেন।

নির্দিষ্ট সময়ের ঘণ্টাখানেক আগেই হাওড়া পৌঁছেছিলাম। যা আমাদের স্বভাব বিরুদ্ধ। এবং কোনও সফরেই সেটা হয়নি। এবার আবার আগেই টিকিট কাটা। ইন্দ্র টিকিট কাটা নিয়ে কোনও ঝামেলা করার সুযোগ পায়নি। একে অপরের পা টেনে, নিজস্বী তুলে প্ল্যাটফর্মে ‘সময়টাকে খুন’ করে ফেললাম।

ওড়িশা সীমানা। স্বাগত জানাচ্ছে ভিন রাজ্য।

ইস্পাত এক্সপ্রেসও তেমন ঘটনাবহুল ছিল না এবারের সফরে। আমরা তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাবলা ফোন নিয়ে রাত জাগায় বদহজমের শিকার। আমি মাত্র দু’ঘণ্টা পাশ ফিরেছিলাম। দীপুবাবুর ঘাসপুসের থিসিস জমা দেওয়ার সময় সমাসন্ন। ফলে রাত জেগে কাজ করেছে। জেগেছিল শুধু ইন্দ্র। খড়্গপুরে চোখ খুলতে ওর কাছ থেকে একটা রিপোর্ট পেলাম। সামনের দিকের আসনে বসা এক সহযাত্রী নাকি মিনিটে মিনিটে খাচ্ছেন। ব্যাগ খুলছেন আর কিছু না কিছু মুখে পুরছেন। একবার টপ করে একটা ডিম পুরলেন। সেটা দেখেই ইন্দ্র অস্থির হয়ে উঠেছিল। সারা রাস্তা ‘আমাকে তোমরা ডিম খাওয়ালে না’ কথাটা ধ্রুবপদের মতো আউড়ে গেল। ডিমে ওর ভীষণ টান। করোনার কারণে ট্রেনে হকার ওঠা বন্ধ। আইআরসিটিসি লেখা পোশাকে কয়েকজন জলের বোতল, টোস্ট বিক্রি করছিলেন। ডিম খাওয়াব কোথা থেকে? হকারের অভাব বোধ করছিল বাবলাও। ওর আক্ষেপ, ‘‘ঝালমুড়ি না খেলে কি ট্রেনে যাওয়া পোষায়?’’

জামসোলা মোড়ের সেই দোকান।

সফরটা ফর্মে ফিরল ঝাড়গ্রামে নামার পর। আমাদের মতো হয়ে গেল আর কী! স্টেশনের সামনে থেকে রেশনের জন্য শসা, পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা কিনে একটা টোটো ভাড়া করে পান্থসখায় গেলাম। আমরা পান্থসখা পছন্দ করি দু’টো কারণে। এখানে তালের গুড়ের রসগোল্লা পাওয়া যায়। আর দোকানটায় সাহিত্যিকদের আড্ডা বসে। এর প্রয়াত মালিক অশোক মহান্তি নিজেও কবি ছিলেন। কিন্তু রসগোল্লা মিলল না। করোনার কারণে বাঁকুড়া থেকে গুড় আসা বন্ধ হয়েছে। খেয়েদেয়ে আমার ভ্রাতৃবধূ অনীতাকে ফোন করলাম। গাড়ি আর ফেরার দিনের আস্তানা ও ঠিক করে দিয়েছে। ভ্রাতৃবধূ জানাল, গাড়ির ড্রাইভারের মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। যেতে পারবে না। বিপদতারণ হয়ে দেখা দিলেন টোটোচালক দাদা। তাঁদেরই একটা গাড়ি আছে। বললে ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। বললাম এবং দরে পুষিয়ে যাওয়ায় তাতেই হাতিবাড়ি রওনা দেওয়া গেল।

জামসোলা চেকপোস্টের পরিত্যক্ত বাড়িঘর।

গাড়ির চিন্তা দূর হতে মাথায় চাপল থাকার চিন্তা। যথারীতি আমরা আগে থেকে কোনও ঘর ঠিক করে বেরোইনি। ‘জয় সফরেশ্বরী’ বলে বেরিয়ে পড়েছি। ব্যবস্থা হয়েছে প্রতিবারই। তাই বেপরোয়া ভাবটাও বেড়েছে। এবার আশঙ্কা যে একেবারেই হচ্ছে না তা নয়। ঝাড়গ্রামে আমাদের আস্তানার মালকিন বলে দিয়েছেন, ঘর মিলবে না হাতিবাড়িতে। গোপীবল্লভপুরে মিলতে পারে।

চিন্তা পথে পড়া জঙ্গলে ফেলে দিয়ে মজা শুরু করলাম। নজর ছিল সড়কের পাশের স্থাননামের আধুনিক বোর্ডগুলোর দিকেও। অন্যরকম নামের জায়গাগুলো। একটা নাম মনে আছে, নিরামিষপুর। গোপীবল্লভপুর মোড়ে একটা আপাদমস্তক মূর্তি। কার সেটা আর জানা হল না। দীপু প্রতীক্ষালয়ের ছবিটা তুলতে পেরেছিল। তাতে লেখা রসিকানন্দ প্রতীক্ষালয়। মূর্তিটি তাহলে রসিকানন্দের হওয়াই সম্ভব। গোপীবল্লভপুর রসিকানন্দ আর তাঁর গুরু শ্যামানন্দের কর্মভূমি। এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্মের বিস্তার ঘটেছিল এই দু’জনের জন্য। গাড়ি থেমেছিল গোপীর মোড় ছাড়িয়ে। জায়গাটা জমজমাট একটা গঞ্জ। এখানে থাকার থেকে বাড়িতে থাকা ভাল। চালকদাদা তাপস মণ্ডলকে বললাম, ‘‘হাতিবাড়ি চলুন। ওখানে জায়গা না পেলে গোপীতে ফিরে আসব।’’

গোপী থেকে হাতিবাড়ি পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশ বেশ সুন্দর। মন ভাল হয়ে যাবে এই রাস্তায় যাতায়াত করলেই। পথে একবার নদীর সঙ্গে দেখা হল। সুবর্ণরেখা। চড়া পড়ে গিয়েছে। তবুও কত সুন্দর। নদীর পাশে পাহাড় করে রাখা বালির স্তূপ। সুবর্ণরেখার বুক খুঁড়েই জমা করা। সিদো-কানু-বিরসা সেতু থেকে দেখলাম। নদীর চড়ায় কাশফুল ছেয়ে আছে।…

বন দফতরের রেঞ্জ অফিস। এখানেই প্রথমে ঘর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।

আশঙ্কাই সত্যি হল। তাপসদা একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বললেন, ‘‘এই হল হাতিবাড়ি।’’ সেখানে রাস্তার দু’পাশে জঙ্গল। থাকার জায়গা তো দূরের কথা বাড়িঘরই তো চোখে পড়ছে না। বন দফতরের অতিথিশালা আছে। সেটাই বা কোথায়? একটা লেখা পড়েছিলাম, ‘মোবাইকে উড়িষ্যার জঙ্গলে’। লেখক পুরঞ্জয় ভট্টাচার্য ও মিতেন্দ্র গাঙ্গুলি। তাঁরা হাতিবাড়ির কাছে জামসোলা নামে একটা জায়গার কথা লিখেছিলেন। জায়গাটা ওড়িশায়। আসলে জায়গাটা বাংলা-বিহার-ওড়িশার সংযোগস্থল। এখন অবশ্য বিহার নেই। ঝাড়খণ্ড হয়েছে। জামসোলায় একটা চেকপোস্ট আছে। চেকপোস্ট মানে গাড়িঘোড়ার ব্যাপার। বাড়িঘরের ব্যাপারও হতে পারে। তাপসদাকে বললাম, ‘‘জামসোলা নিয়ে চলুন।’’

জামসোলা দেখে মন আরও ভেঙে গেল। মোড়ের মাথায় শুধু একটা খোলামেলা ঝুপড়ির মতো দোকান। পলিথিনের ছাউনি। কিছু ঘরবাড়ি আছে। দোকানে জিজ্ঞাসাবাদ চলল। কোনও বাড়ি একদিনের জন্য যদি ভাড়া পাওয়া যায়? সুরাহা হল না। কম বয়সি দোকানদার বন দফতরের বাংলোর কথাই বলল। সেটা না পেলে জঙ্গলের ভিতরে বেসরকারি একটা থাকার জায়গা আছে। না হলে? মনে মনে বললাম, গোপীবল্লভপুরে মানুষের আর ঘরবাড়ির জঙ্গলে।

বনবীথি।

ফিরে আসছিলাম। তাপসদা বললেন, ‘‘একবার গেটটা দেখবেন না?’’ চেকপোস্টটাকে এখানকার লোকে গেট বলেন। বিশাল একটা গেট আছে নাকি। অল্প হেঁটে গিয়ে দেখি, সব ফাঁকা। কোথায় গেট! পরিত্যক্ত বড় বড় বাড়ি। কী হত এখানে? গেট নামটাই বা কেন? একজন বাইক নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে জানতে চাওয়া হল। তিনি ওড়িয়া টানে বললেন, ‘‘এখানে গাড়ির কাঁটা হত।’’ মানে গাড়ির ওজন হত। কিন্তু গেটের ব্যাপারটা খোলসা হল না। পাশে দেখলাম জামসোলা আউট পোস্ট। কিন্তু তালা বন্ধ। উল্টোদিকে একটা বাড়ি। ডাকাডাকিতে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। ইনিও ওড়িয়াভাষী। অনুরোধ করলাম কোনও পুরুষকে ডেকে দিতে। এক তরুণ বেরোলেন। এবং তিনি জানালেন, আধ কিলোমিটারের মধ্যেই থাকার জায়গা মিলবে। বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা দেখিয়েছিলেন। ভাবলাম নতুন কোনও পাড়ার পথ। রাস্তা ধরে কিছুটা যেতেই বুঝতে পারলাম, উনি হাতিবাড়ির কথাই বলছেন। আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই এসে পৌঁছলাম। সেই ঝুপড়ির দোকান।

গেস্ট হাউসের সামনে সুবর্ণরেখা। পাড়ে সার সার মাথা উঁচিয়ে মাছ ধরার লাটাই।

অগত্যা ফেরা। পথে একবার ঝাড়গ্রাম পুলিশের একটা চেকপোস্টে থেমে আরেক প্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। এই চেকপোস্টের পরেই ওড়িশা সীমানা শুরু হয়ে যাচ্ছে। বিশাল বিলবোর্ডে ওড়িয়া আর ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন জায়গার দূরত্ব লেখা। স্বাগতও জানানো হয়েছে। তবে দুই ভাষায় কিনা জানি না। ওড়িয়া পড়তে পারি না।…

বন দফতরের রেঞ্জ অফিসে গেলাম। থাকার কথা জিজ্ঞাসা করতে এক ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় না-না করে উঠলেন। জানালেন, অনলাইনে বুকিং হয়। আর সব বুকিং হয়ে গিয়েছে। দীপুর পাহাড়ে ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে। ও জিজ্ঞাসা করল, ‘‘রেস্টরুম ফাঁকা নেই?’’ ভদ্রলোক জানালেন, রেস্ট রুম ড্যামেজ। তা ছাড়া ওটা অফিসারদের জন্য। এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। শাল গাছের জঙ্গলের ভিতর থেকে প্রচুর পাখি ডাকছে। থাকতে পারলে বেশ হত। ভদ্রলোক তখন একটু নরম হয়েছেন। আরেকটু গিয়ে বেসরকারি গেস্ট হাউসে খোঁজ নিতে বললেন। ফিরে আসতে আসতে একটা কথা মনে হল। এই অনলাইন বুকিংয়ের কালে জন্মালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ লিখতে হত না।…

সুবর্ণরেখার আরেকদিক।

গেস্ট হাউসে এসে দেখি, মূল দরজায় তালা দেওয়া। তার মানে অতিথি নেই, আশা আছে। গেস্ট হাউসের নাম হাতিবাড়ি ফ্রেন্ডস রিট্রিট। একটা ব্যানার ঝুলছে। তাতে কয়েকটি ফোন নম্বর। একটা নম্বর দেখে ফোন করলাম। তিনি জানালেন, সব ঘর বুকিং আছে। এই রে! ততক্ষণে দেখে নিয়েছি, বাড়িটার ছাদের উপরে একটা ছাউনি দেওয়া। এখন যথেষ্ট গরম। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদি ছাদটাও ভাড়া পাওয়া যায় রাত কাটাতে অসুবিধা হবে না। ফোন ধরা ব্যক্তিটিকে অনুরোধ করলাম, যদি ছাদে থাকার অনুমতি দেন। উনি আমাদের ঘোরাঘুরির এই প্রবণতার প্রশংসা করলেন। জানালেন, তিনিও কম বয়সে এরকম জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতেন। ভদ্রলোক কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন করবেন বলে জানালেন। একটা আশার আলো।

সড়ক পথে চলেছে গরুর পাল।

ফোন এল। ভদ্রলোক জানালেন, তাঁদের কেয়ারটেকার বাবলু যাচ্ছেন কিছুক্ষণের মধ্যে। ওঁকে যেন বিষয়টা বুঝিয়ে বলি। ততক্ষণ আমরা একটু আশপাশ ঘুরে দেখে নিই। আশার আলোর ভোল্টেজ একটু বাড়ল। কোথাও যাইনি। গেস্ট হাউসের সামনের চত্বরেই ছিলাম। সাইকেলে চেপে একজন এলেন। খালি গা। পরনে লুঙ্গি। আমাদের দেখে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ জমে উঠল। নাম সনৎ পাল। স্থানীয় বাসিন্দা। নদীতে মাছ ধরতে যাচ্ছেন। এমনিতে চাষবাস করেন। কিন্তু এই তিন মাস নদীতে মাছ ধরেন। গেস্ট হাউসের সামনেই সুবর্ণরেখা নদী। একই সঙ্গে জঙ্গল আর নদী হাতিবাড়ির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।

দড়ি দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা হচ্ছে ভেটকি মাছটা।

কেয়ারটেকারের আসতে দেরি আছে। আমরা সনৎবাবুর সঙ্গে নদীর পাড়ে চলে গেলাম। সেখানে যে কী বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল! নদীটা চড়ায় চড়ায় জেরবার। মিহি নরম বালির চর পেরিয়ে জলের কাছে যেতে চোখে পড়ল, পাড়ে নাইলনের সুতো গোটানো লাটাইয়ের মতো সার সার কিছু পোঁতা আছে। ওগুলোই মাছ ধরার সরঞ্জাম। অনেক কাঁটার থুপিতে বড় ডেলা করে টোপ ফেলে নদীতে ছুড়ে দেন সনৎদারা। তার পর সুতো লাটাইয়ের পাশে একটি ছোট বাখারিতে ফাঁস দেন। মাছ খেলে ওই ফাঁসটা খুলে যায়। তার পর টেনে তোলা। বেশ কয়েকজন মাছ ধরছেন। সনৎদা আগেই জানিয়েছিলেন, আড়াই কিলো, তিন কিলোর মাছও ধরা পড়ে। মাছ বিক্রি না হলে তাঁরা নদীতে জিইয়ে রাখেন।

নদীতে মাছ জিইয়ে রাখা! সে আবার কী? দেখতে হয়। সনৎদাকে অনুরোধ করলাম, দেখাতে। উনি বললেন, ‘‘আমার তো জিয়ানো নেই।’’ অন্য আরেকজনের দেখালেন। কিলো তিনেকের একটা মৃগেল। নদীর জলে খেলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পালাতে পারছে না কোথাও। মুখ আর নাকের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা। সেই দড়ি পাড়ের একটা খোঁটায় আটকানো। গরু মাঠে খোঁটায় বাঁধা থাকে। তেমন ভাবেই নদীতে মাছ বাঁধা আছে। বাবলা নামী বঁড়শেল। ও অন্যের হয়ে মাছ ধরতে ভাড়ায় যায়। বাবলা পর্যন্ত চমকে গেল নদীতে মাছ জিয়োনোর কায়দা দেখে।

গরু চরানোর মতো করে যেন মাছ চরাচ্ছেন শিকারি। জিয়োনোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ সুবর্ণরেখার সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে এলাম গেস্ট হাউসের সামনে। তখনও কেয়ারটেকার বাবলু আসেননি। আজ দুপুরে ভাত জুটবে না নিশ্চিত। রেশনে আনা বিস্কুট, চালভাজা, চানাচুরই খেতে হবে। সঙ্গে ছোট্ট পিসের কেক আছে। সেগুলো খেয়ে পিত্তি রক্ষা হল। কিছু পরে বাবলুদা এলেন। আমাদের জঙ্গলে থাকার আগ্রহ বুঝিয়ে বলতে উনি ছাদে নিয়ে গেলেন। খাবার চেয়ার টেবিল পাতা। মানে অতিথিরা এখানেই খাওয়াদাওয়া করেন। একটা চৌকিও আছে দেখলাম। দীপু দেখতে পেল ফোমের গদিও আছে ভাঁজ করা। বাথরুমও। ঠিক হল, ইন্দ্র রাতে চৌকিতে শোবে। ও সুখী মানুষ। আমরা তিনজনে ফোম পেতে মেঝেয় শুয়ে পড়ব। সঙ্গে মশা তাড়ানোর ধূপ তো রয়েছেই। ব্যাগট্যাগ ছাতে রেখে চোখে মুখে জল দিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম। তাপসদার গাড়ি ধরে রেখেছি। এখানে আজ আর কোনও গাড়ি মিলবে বলে মনে হয় না। ওঁর গাড়িতে আশপাশটা দেখে নিতে হবে।

গেস্ট হাউস পেরিয়ে পাড়াখানি।

ফিরে এসে আবার চমক। যাঁরা বুকিং করেছিলেন তাঁদের কয়েকজন আসেননি। ফলে নীচের রুমটা তাঁদের লাগছে না। আমরা থাকতে পারব। ‘জয় সফরেশ্বরী’। তাপসদাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঘর দখল করে দ্রুত চানটান করে নিলাম। ইন্দ্র আর বাবলা বাথরুমে চান করেছিল। আমি আর দীপু করলাম মাঠের পাশে নলকূপে। দারুণ ঠান্ডা জল। লিরিল সাবান না মেখেই লিরিলের সতেজতা। এবার খেতে হবে। পেঁয়াজ, লঙ্কা, শসা কুঁচিয়ে আনল দীপু। তা দিয়েই সান্ধ্যকালীন লাঞ্চ হল। আমাদের রাতে রান্না করে খাওয়াবেন আনন্দদা। পাঁচ কিলোমিটার দূরে কাটাঙ্গিতে বাড়ি ওঁর। কেয়ারটেকার বাবলুদার বাড়ি পাকা রাস্তার ওপারে নোয়াগাঁয়। এই গেস্ট হাউসটা তিনজন মিলে তৈরি করেছেন। সকালে যাঁকে ফোন করেছিলাম তিনি শ্যামল মাইতি। তিনজনের একজন। সেলট্যাক্সের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। হাতিবাড়ি গোপীবল্লভপুর ১ ব্লকের সাতমা গ্রাম পঞ্চায়েতে পড়ে।

রাতের খাওয়াদাওয়া নিয়ে একপ্রস্ত আলোচনা হল। জঙ্গলে এসেছি। দেশি মুরগির ঝোল আর ভাতই হবে। না হলে ইন্দ্র প্রচণ্ড রাগারাগি করবে। খাওয়ার ব্যাপারে ও কোনওরকম সমঝোতা করতে রাজি নয়। তার উপরে দুপুরে ভাল খাবার পায়নি।

একটু সন্ধ্যা হতে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গল পথে। পাকা সড়কের দিকে। আধখানা চাঁদ আকাশে। তবুও আঁধার এতটুকু ফিকে হয়নি। নানারকম পোকার ডাক। একটা পাখি ডাকছে অদ্ভুত স্বরে। একা থাকলে গা ছমছম করত। এই দিকটায় কোনও লোকজন চোখে পড়েনি। তবে গেস্ট হাউসের সামনের রাস্তা দিয়ে সাইকেলে, বাইকে লোকজন যেতে দেখেছি। যাচ্ছে এর উল্টোদিকে। ওইদিকটায় সনৎদাদের পাড়া। সড়ক পার করে আমরা ঢুকে পড়লাম জঙ্গলের রাস্তায়। কোথাও কোনও আলো নেই। তবে পথ যখন আছে তখন পথিকও আছে। মানে পাড়া আছে। হয়তো অনেকটা যেতে হবে। কিছুটা গিয়ে আমরা ফিরলাম।

মৃত বটগাছটি।

তখনই পাকা সড়ক থেকে নানা রকম গোলমালের আওয়াজ কানে এল। একটু কাছে এগোতে দেখি, দল দল গরু চলেছে। লাঠি হাতে একটা একটা গরুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে একজন করে লোক। গরু তাড়ানো, গরু পেটানো আর গরুর গলায় ঘণ্টার শব্দে জঙ্গলের নির্জনতা ভাঙছে। মোটা লাঠি দিয়ে গরু পেটানোর আওয়াজে গা শিউরে ওঠে। শব্দ শুনে বাবলা বলল, ‘‘এরা পিটুনি খাচ্ছে আর মালিকের পেট ভর্তি হচ্ছে।’’ পাকা রাস্তায় উঠে আমরা চেকপোস্টের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। অন্ধকার রাস্তায় জঙ্গলে মোড়া সড়কে হাঁটতে বেশ লাগছিল। চেকপোস্টে পৌঁছে দেখি, সেখানটা পুরো গরুময় হয়ে উঠেছে। হাঁকডাকে দিনের থেকে রাত সরগরম।…

আনন্দদার রান্না ৮টার মধ্যেই সারা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খাওয়ার অভ্যাস আমাদের নেই। ইন্দ্র সন্ধে অল্প গড়ালেই শুয়ে পড়ে। ও শুয়েই পড়েছিল। আমরা তিনজনে মোমবাতি নিয়ে গেস্ট হাউসের সামনে অল্প জঙ্গল আর নদীর মাঝে সিমেন্টের চাতালে গিয়ে বসলাম। মোমবাতির আলো, পোকার ডাক, নির্জনতায় হাতিবাড়ি যাপন মুহূর্তে মুহূর্তে ভরে উঠছিল। ইন্দ্র গেস্ট হাউসে ঘুমোচ্ছে। ওকে ফোন করে ডাকলাম। দুপুরের খাওয়া থেকে বেচারা বঞ্চিত হয়েছে। এমন দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হলে ওর ঘোরাঘুরিটায় বলার মতো কিছু থাকবে না। ঘুম জড়ানো চোখে ইন্দ্র এসে বসল। তখনই কাদের যেন নদীর পাড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেলাম আমরা। সঙ্গী তিনজনেই বলল, রাতের নদীটা একটু ঘুরে আসা যাক।

পাড়া পেরিয়ে সুবর্ণরেখার পথে।

ভাগ্যিস বলেছিল। তাই আবার একটা বিস্ময়ের সাক্ষী হলাম। নদীর পাড়ে পৌঁছেছি, একজন অন্ধকার থেকে হাঁকডাক করে কাকে যেন ডাকছিলেন। ডাকে সাড়া দিয়ে একজন দৌড়ে যাচ্ছিলেন। বাবলা বলল, ‘‘বড় মাছ ধরা পড়েছে। চলো চলো।’’ দীপু, বাবলা বেশ দৌড়েই যাচ্ছিল। বারণ করলাম। নদীর বালি মিহি হতে পারে। কিন্তু প্রচুর পাথর আছে পাড়ে। অন্ধকারে হোঁচট লাগলে রক্তারক্তি হবে। গিয়ে দেখি, বিশাল একটা ভেটকি ধরা পড়েছে ছিপে। এখানে দুই পদ্ধতিতে মাছ ধরা হয়। এক নাইলনের লাটাই কল। দুই, জাওলা দিয়ে। জাওলায় ছোট জ্যান্ত মাছের টোপ দেওয়া হয়। সেই টোপেই কিলো তিনেকের ভেটকি গেঁথেছে। দৌড়ে আসা লোকটি হাত জালে মাছ পাড়ে তুলতে সাহায্য করলেন। তার পর মাছটিকে খোঁটায় বাঁধার ব্যবস্থা করা হল। পদ্ধতিটা একটু ভয়াবহ। একটা শক্ত কাঠি দিয়ে মাছের চোখের পাশে বিঁধে অন্য পাশের চোখ দিয়ে বার করে হয় সুতো। তার পর মুখের কাছে সুতোয় গিঁট দিয়ে জলে জিয়োনোর ব্যবস্থা।…

জাওলা দিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা।

রাতে ১০টার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। যাতে ভোরবেলা উঠে একটু আশপাশটা দেখে নেওয়া যায়। শোয়ার আগে ইন্দ্রকে সাবধান করা হয়েছিল, ভোর রাতে উঠে যেন মোবাইল চালিয়ে বিরহের গান না শোনে। আর নেট চালিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের নোটিফিকেশনের আওয়াজে ঘুমের বারোটা না বাজায়। সারাদিন আমাকে অনেক গালি দিয়েছে। ভোর রাতে আমি তার শোধ তুলে নেব। ইন্দ্র কথা শুনেছিল। ভোরবেলা ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে নদীর পাড়ে চলে গিয়েছিল। তবে নানারকম শব্দ করে আমাদের ঘুমটা ভাঙিয়ে।

সেই ঝিল। পাড়ে কাশ।

সকালে ব্রাশ করতে করতে আমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। গেস্ট হাউস ছাড়িয়ে কিছুটা গেলেই একটা পাড়া। টালির, খড়ের চাল। চাল বেয়ে লাউ গাছ উঠেছে লতিয়ে। বাড়ির সামনে বাচ্চারা কেউ খেলছে। কেউ দাঁত মাজছে। একটা ইঁদারা। অনেক বাড়িতেই ছাগল পুষেছে দেখলাম। রাস্তায়, উঠোনে, বাঁশবনে মুরগি চরছে। ইন্দ্র নধরকান্তি দেখলেই ‘ওই দেখো, ওই দেখো’ বলে উল্লসিত হয়ে উঠছে। আর মুরগি ডাকলেই আমরা বলছি, ‘‘আগের পাড়ার বন্ধুদের সাবধান করে দিচ্ছে বোধহয়। পাড়ায় খতরনাক কেউ ঢুকেছে।’’ আমরা ডানদিকে শিবমন্দির আর প্রাথমিক স্কুল পার করে, মরা বটগাছটা বাঁ হাতে রেখে পৌঁছলাম নদীর পাড়ে। ভোরে নদীর ওপারে অল্প অল্প কুয়াশার মতো। এদিকটাতেও সারি সারি মাছ ধরার জাওলা। কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার ফেরার পালা।

বিদায় হাতিবাড়ি।

গেস্ট হাউসে ফিরে চানটান করে আরেক প্রস্ত মুড়ির চাট বানিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আগের দিন চোখে পড়েনি। আজ দেখলাম, গেস্ট হাউস পেরিয়ে কিছুটা এলে বাঁ দিকে দূরে একটা ঝিল রয়েছে। তাতে পাখিও আছে। পাড়ে কাশফুল ফুটেছে।

জঙ্গলের পথ ধরলাম আমরা। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগোলাম চেকপোস্টের দিকে। ওখানে যদি কোনও শস্তার গাড়ি মেলে! ওড়িশার দিকে যাব। ডোকরা শিল্পীদের গ্রামে।

ছবি— ইন্দ্র, দীপু আর বাবলা

(সমাপ্ত)

One thought on “নদীতে জিয়োনো মাছ আর হাতিবাড়ির রাত

  1. জামসোলার চেকপোস্ট বা স্থানীয় ভাষায় গেট কেন বন্ধ হল কেউ কি জানেন? আমরা সঠিক তথ্য পাইনি। কেউ বলছেন, জিএসটি চালু হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কেউ বলছেন, আরও আগে, অন্তত বছর দশেক হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে চেকপোস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *