pantihal station
অন্য সফর ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

ইস্টিশন ইস্টিশন— দ্বিতীয় পর্ব

দীপক দাস

বড়গাছিয়া— কদমতলের স্টেশনটি

শিকড়ে যাও। শিকড়ে। বছর কয়েক আগের গানের ভাষায় বললে, ‘গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও…’। নবম শ্রেণি থেকে বোধহয় গভীর সন্ধানী হয়ে পড়েছিল মনটা। নাকি অষ্টম শ্রেণিতে? সেই যে বাংলায় নামকরণের সার্থকতা কোশ্চেন! জায়গার নাম পেলেই তার সার্থকতা খোঁজার চেষ্টা করি। যেমন জানলাম মেদিনীপুরের লোধাশুলি। শুলি কোল ভাষার শব্দ। যার মানে উর্বর দোঁয়াশ মাটি। এমন শুলিতে লোধাদের বাস। তাই লোধাশুলি।

বড়গাছিয়া। সেই কদমকাননে।

এলাকার নাম বড়গাছিয়া। কেন এমন নাম? এখনকার বড়গাছিয়ায় এলে কেউ নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পাবেন না। বড়গাছিয়া মানে বড় বড় গাছ আছে এমন জায়গা। গাছের নামে জায়গা আছে, বেলগাছিয়া, কুলগাছিয়া। একসময় বড় বড় গাছ ছিল বড়গাছিয়ায়। কিছু বছর আগে সেই মহীরুহদের শেষ প্রতিনিধি বহাল তবিয়তে ছিলেন। বিশাল একটা শিরীষ গাছ। মোটা একটা ডাল শুকনো হওয়ার পরে গাছটা কেটে ফেলা হয়। এলাকার নামে এখনও সেই গাছের স্মৃতি রয়ে গিয়েছে। বড়গাছিয়ার ওই জায়গাটির নাম খিরিশতলা। শিরীষই তো লোক মুখে খিরিশ।

একটা রেলস্টেশন আছে বড়গাছিয়ায়। জায়গার নামেই নাম। তবে মহীরুহ কিছু নেই। কিন্তু স্টেশন গাছগাছালিতে ভরা। স্টেশনে ঢোকার মুখে দু’টো কদমগাছ। বিশাল লম্বা। কদমফুল যখন ফোটে তখন দারুণ লাগে। মঞ্জরী ঝরে পড়া কদমফুলের পুষ্পাধার অনেকটা মুগের লাড্ডুর মতো দেখতে। বর্ষায় ঝরে পড়া সেই পুষ্পাধার কেমন একটা মাদকতার গন্ধ ছড়ায়। কদমগাছের পাশে একটা হেলে পড়া কৃষ্ণচূড়া গাছও রয়েছে। বসন্তে সে-ও অতি রূপবান। কদমগাছ ছাড়িয়ে এগোলে উড়ালপুল আর ওয়েটিং হলের মাঝে অনেকটা ফাঁকা চত্বরে একটা নারকেল গাছ। প্ল্যাটফর্মে ওঠার আগেও বেশ কিছু গাছ আছে। বেশ সুন্দর ছায়া ছায়া একটা স্টেশন।

ফল-ফলাদির গাছ রয়েছে স্টেশনে।

বড়গাছিয়া স্টেশনের চারপাশটাও বেশ সুন্দর। দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশে খাল, তার পর দিগন্ত বিস্তৃত জমি। একদিকে লোকালয়। লোকালয় যাওয়ার রাস্তা। হাওড়ার দিকে এগোলে ডানপাশে ভাঙাচোরা, পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টার। তার পর শুধু জমি। বাম পাশে জমি-বসতি।

রেলের মানচিত্রে বড়গাছিয়া চিরকালই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখন খানিকটা ডিমোশন হয়েছে। একসময় হাওড়া-আমতা মার্টিন রেল চলত। সেই রেলের গুরুত্বপূর্ণ জংশন ছিল বড়গাছিয়া। কারণ এখান থেকেই আলাদা হয়ে যেত চাঁপাডাঙা লাইন। হুগলি জেলাকে রেলপথে যোগ করত। অবশ্য স্টেশনটি যে এলাকায় তার কিছুটা দূর থেকেই হুগলি জেলার শুরু। ১৯৭১ সালে মার্টিন রেল বন্ধ হল। রেল মানচিত্র থেকে মুছে গেল বড়গাছিয়া। মানচিত্রে আবার ঠাঁই পেতে পেতে ১৯৮৫ সাল। ওই বছর দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ে ইএমইউ চলাচল ডোমজুড় থেকে বাড়িয়ে বড়গাছিয়া পর্যন্ত করল। পুরনো মার্টিন রেল স্টেশনের কাছে নয়, নতুন স্টেশন তৈরি হল বাজার-হাটের একটু বাইরের দিকে। একটু গুরুত্ব হয়তো তখন বেড়েছিল স্টেশনের। লোকাল ট্রেনের নাম তখন জায়গার নামে। বড়গাছিয়া লোকাল।

লাইন চলেছে পাতিহালের দিকে।

বহু স্মৃতি বড়গাছিয়া লোকালের। কলেজ যেতাম ট্রেনে। লোকজন একদমই হত না। শেষের দিক থেকে দু’নম্বর কামরাটা ছিল ছাত্র ছাত্রীদের। কারণ টিকিয়াপাড়ায় নেমে নরসিংহ কলেজের দিকে যেতে হলে হাঁটতে কম হতো। কিন্তু সেই ছাত্র ছাত্রী আর কতজন? কুড়িয়ে বাড়িয়ে ছ’জন-সাতজন হবে। তখন লাইনও ছিল খারাপ। ট্রেন চলতে শুরু করলে দুলতে শুরু করত। সে দোলা ভয়ানক। বড় মিষ্টির প্যাকেটে মাত্র দু’খানা দানাদার ভরে হেঁটেছেন কখনও? হাঁটলে দেখবেন, দানাদার দু’টো প্যাকেটের এপাশ ওপাশ গড়িয়ে চলেছে। যাত্রীদের অবস্থা হত তেমনই। আমরা পড়ুয়ারা নাম দিয়েছিলাম, গনি খানের দোদুলদোলা। বড়রা বলতেন, গনি খান তখন রেলমন্ত্রী। রেল বাঁধের মাটি ঠিক মতো বসেনি। সেই অবস্থাতেই উদ্বোধন করে দেওয়া হয়েছিল ট্রেন চলাচল। ভোটের অঙ্ক নাকি মাটি বসার জন্য অপেক্ষা করতে দেয়নি। মাটি ঠিক মতো বসতে দিতে গেলে ভোটব্যাঙ্ক বসে যেত। এমন লাইনে কর্তাব্যক্তিদের তেমন নজর ছিল না। বর্ষায় সন্তোষপুর, দক্ষিণবাড়ির কাছে রেলবাঁধে ধস নামত।

কত টুকরো স্মৃতির সাক্ষী স্টেশনটা। এক বুড়ি মা মাঝে মাঝেই তার আধদামড়া ছেলের নাম ডেকে ডেকে প্ল্যাটফর্মের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খুঁজতেন। ছেলে আত্মভোলা। ট্রেন ছেড়ে চলে যেত। সে স্টেশনেই বসে থাকত। অফিস যেতে তার ভাল লাগত না। তাই বুড়ি মা ছেলেকে ট্রেনে তুলে দিতে আসতেন। কিন্তু ছেলে সাড়া দিলে তো! সে ঘাপটি মেরে বসে থাকত।

ছায়ার ঘোমটা মুখে টানা স্টেশনটি।

বড়গাছিয়া স্টেশনই শেষ গন্তব্য ছিল বলে আমাদের একটা গর্ব ছিল। হু-হু বাবা আমাদের এলাকার নামে স্টেশন। ২০০১ সালে সেই গুমোরও ভেঙে গেল। লাইন বাড়ল মুন্সিরহাট পর্যন্ত। ট্রেনের নামও বদল হল। স্টেশন ভবিষ্যতে কোনও দিন হয়তো হারানো তাজ ফিরে পাবে। রেল মন্ত্রকের বহুদিনের প্রস্তাব, মার্টিন রেলের সেই পুরনো চাঁপাডাঙা লাইন আবার চালু করা। চালু হলে হয়তো আবার জংশন হবে বড়গাছিয়া।

পাতিহাল— ইতিহাসের স্টেশন

সে-ও এক ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’র গল্প। একটা ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কীসে পালাচ্ছে? হাওড়া-আমতা মার্টিন রেলে চড়ে। শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প, ‘হাওড়া আমতা মার্টিন রেলের দুর্ঘটনা’। স্কুলের গ্রন্থাগার থেকে নেওয়া কোনও বইয়ে সম্ভবত পেয়েছিলাম। গল্পের নামটা ঠিকঠাক না-ও হতে পারে। এই গল্পেই প্রথম পাতিহাল রেল স্টেশনের নাম পেয়েছিলাম। পেয়েই পুলকিত। পাতিহাল যে আমার গ্রাম। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখতে গর্ব বোধ হয়। ছাপার অক্ষরে নিজের গ্রামের নাম দেখতে পেলেও বড় খুশি হই। একে আঞ্চলিকতা বলতে পারেন। ‘মুম্বই অস্মিতা’ নাম দিতে পারেন। বা গাঁয়ের গর্বও বলতে পারেন।

‘নতুন পাতা’ সিনেমার পাতিহাল।

তার পরেও বহুবার বহু জায়গায় পাতিহালের নাম পেয়েছি। বহু গর্বিত ইতিহাসের প্রসঙ্গে। এখন তো স্টেশনের ইতিহাস চলছে। তাই রেল সংক্রান্ত ইতিহাস নিয়েই আলোচনা হোক। রেলের মানচিত্রে বহু আগে থেকেই পাতিহাল স্থান পেয়েছে। সেই উনিশ শতকে। ১৮৯৮ সালে মার্টিন কোম্পানির রেলপথ (লাইট রেলওয়ে) বড়গাছিয়া থেকে মাজু পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। পাতিহালের নামও রেলের মানচিত্রে ঢুকে যায়।

এখনকার পাতিহাল।

হাওড়ার মার্টিন রেল, চাঁপাডাঙা লাইন হোক বা শিয়াখালা, সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। পাতিহাল স্টেশনটি স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের ইতিহাসে। প্রথমে সিনেমার ইতিহাস। দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় ‘নতুন পাতা’ বাংলা চলচ্চিত্রের উল্লেখযোগ্য ছবি। প্রতিভা বসুর গল্প অবলম্বনে এই সিনেমার শ্যুটিংয়ের অনেকটা হয়েছে পাতিহালে। আর বারবারই এসেছে মার্টিন রেলের পাতিহাল স্টেশনটি। এসেছে এলাকার অন্যতম প্রাচীন স্কুল পাতিহাল দামোদর ইনস্টিটিউশনও। নায়ক শমিত ভঞ্জ এই স্কুলেই পড়াতেন। পুরনো লোকজন এখনও বলেন, ছবির অনেক ফ্রেমেই গ্রামের দু’চারজনকে দেখা যায়। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রদের দলের সকলেই স্থানীয়। তাঁদেরই একজন দিলীপ পাল। পাতিহাল গুমোতলায় তাঁর দোকান রয়েছে। ক্লাসের রমেন নামের ছেলেটি তিনিই। তাঁকেই খাতাগুলো গুছিয়ে রাখতে বলেছিলেন শিক্ষক শমিত ভঞ্জ।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস খুঁজলেও পাতিহাল স্টেশনের উল্লেখ মিলবে। ‘ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস’এ (সুপ্রকাশ রায়) একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। সালটা ১৯৩২। তারিখ ২২ জানুয়ারি। হাওড়া জেলার ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার চেষ্টা হয়। সেটা হয়েছিল পাতিহাল স্টেশনের কাছে। স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ছিল ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো। বিপ্লবীরা বাংলোয় বোমা ছুড়েছিলেন। তাতে তিন কনস্টেবল আহত হন। কিন্তু নলিনীকিশোর গুহ ‘বাংলার বিপ্লববাদ’ গ্রন্থে লিখছেন, ওইদিন স্টেশনে রেলগাড়ির সেলুন কামরায় বোমা ছোড়া হয়েছিল। বোমা ছোড়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন বিপ্লবী কানাইলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জেল হয়েছিল। সেলুন কার না বাংলো, বোমা কোথায় ছোড়া হয়েছিল সেই দ্বন্দ্ব এখন আর মেটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ হাতের কাছে কোনও নথি নেই।

ওই দূরে পাতিহাল দামোদর ইনস্টিটিউশন।

১৯৭১ সালে মার্টিন রেল বন্ধ হয়ে যায়। হারিয়ে যায় পাতিহাল স্টেশন। তার সমৃদ্ধ ইতিহাস। এর বহু বছর পরে দক্ষিণ-পূর্ব রেল হাওড়া-বড়গাছিয়া ট্রেন পরিষেবা সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়। তখন আমরা পাতিহাল দামোদরের ছাত্র। সেই ‘নতুন পাতা’ সিনেমার পাতিহাল দামোদর স্কুল। মাপজোক শুরু হতে সে কী উত্তেজনা। স্কুল থেকে ট্রেন দেখতে পাব। আমি তো ভাবতাম, ট্রেনে চেপে ইস্কুলে আসব। কিন্তু মুশকিল হল, আমার বাড়ি দুই স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায়। বড়গাছিয়া স্টেশন থেকেই বাড়িটা কাছে হয়। ট্রেনে ইস্কুলে আসতে হলে সেই বড়গাছিয়া যেতে হবে তার পর ট্রেনে চাপতে হবে। তার পর পাতিহাল। ভৌগোলিক এবং সময়ের হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারতাম না। কারণ চিরকালই আমি লেট লতিফ। ট্রেন ধরায় বিলম্ব নিয়ে আমার বহু গল্প আছে। একবার বাইক থেকে আছাড় খেয়ে বাঁ হাতে এখনও ব্যথা। লকডাউনে কোথাও ঘুরতে যাওয়া বারণ। এক মঙ্গলবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে তোলা হল স্টেশনের ছবি। সঙ্গী দীপুবাবু।

সিনেমায় পাতিহাল দামোদর ইনস্টিটিউশন।

স্কুল, কলেজ পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলুম। তার পর হাওড়া-বড়গাছিয়া ব্রডগেজ লাইন পাতিহাল পৌঁছল। ২০০০ সালে। ন্যারোগেজের মার্টিন রেলের স্টেশন যেখানে ছিল সেখানেই হল নতুন পাতিহাল স্টেশন। পূর্ণাঙ্গ স্টেশন অবশ্য নয়। কমিশন এজেন্ট নিয়োগে স্টেশন চলে। স্টেশনের কাছে দু’টো সড়ক। একটা হাওড়া-আমতা। এই সড়কে বাস চলাচল শুরু হওয়ার পরেই মার্টিন রেলের শেষের দিন শুরু হয়ে যায়। ধীর গতির ট্রেন পাল্লা দিতে পারল না বাসের সঙ্গে।পাতিহাল-খাঁদারঘাট রোডটা রেললাইনের উপর দিয়েই। ফলে একটা লেভেল ক্রসিং আছে। লেখার সময়ে ‘নতুন পাতা’ চালিয়ে দেখছিলাম। সেই গ্রামীণ পরিবেশ এখনও স্টেশনটিকে ঘিরে রয়েছে। স্টেশনের পাশেই বিশাল এলাকা জুড়ে চাষের জমি। প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকে ঝোপঝাড়। গাছপালা। একটা জিলিপি গাছও আছে। প্যাঁচালো মিষ্টি সুগন্ধী ফল হয় গাছটাতে। সুন্দর খেতে। স্কুলে পড়ার সময়ে বহু খেয়েছি। স্টেশন থেকে দূরে দেখা যাচ্ছে দামোদর স্কুল। মুন্সিরহাটের দিকে একটু এগোলে আবারও খোলা দিগন্ত। সবুজ। আর হ্যাঁ, স্টেশনে ছাতিম গাছ আছে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে থাকে ছেলে-মেয়েরা। দুপুরে-বিকেলে। তাদের কয়েকজন হয়তো মানসসঙ্গী। কোনও বসন্তের বিকেলে ছাতিম ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা স্টেশন স্বর্গীয় হয়ে ওঠে।

লকডাউনে ট্রেন নেই। তাই লাইনে হাঁটাহাঁটি।

একটা বিষয় বলা দরকার। স্টেশনে পাতিহাল নামটি চন্দ্রবিন্দু দিয়ে লেখা। আর আমি লিখেছি চন্দ্রবিন্দু ছাড়া। পাতিহালের চন্দ্রবিন্দুত্বের প্রাপ্তিও এক দীর্ঘ ইতিহাস। নামকরণের ইতিহাসও দীর্ঘ এবং মতানৈক্য সঙ্কুল। সময়-সুযোগে আলোচনা করা যাবে।

ছবি- দীপশেখর ওরফে দীপু ওরফে ঘাসপুস।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *