জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

তিন নদী পেরিয়ে শুশুকের ডাইভ

নন্দিতা দাস

বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। জোড়া শিকে। ঘুরতে যাবার ডাক। তা-ও আবার বাইকে। একেবারে তেরো নদী না হোক, তিন তিনটে নদী পেরিয়ে। শুনে ইস্তক ‘মন আমার ফড়িং হয়ে পদ্ম পাতা’য় নাচছে। বহুদিন ধরে, বহু ঘ্যান ঘ্যান করে অবশেষে ক্যাপ্তেন সাহেব (গুরুমশাই) দলে নিতে রাজি হয়েছেন। ভাইস ক্যাপ্তেন সাহেব একটু গাঁইগুই করছিলেন বটে, তবে অবশেষে তিনিও রাজি।

শুরু থেকে শুরু করি। দোলের দিন সন্ধ্যেবেলা গুরুমশাইয়ের জরুরি তলব। গিয়ে একই সঙ্গে অভিভূত ও চমকিত। পরের দিন ভাটোরা যাওয়া হচ্ছে। হাওড়ার দ্বীপাঞ্চল ভাটোরা। নামটা শোনা ছিলই। কয়েকদিন আগেই পড়েছি ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’য়। শুনে তো নাচার অপেক্ষায়। পরেরদিন সকাল ৮টায় যাত্রা শুরু।

শিয়াগড়ির সেই বাঁশবন। আর মেছোবিড়ালের উপস্থিতির ঘোষণা।

পরেরদিন। সকাল ৮টা বেজে ৪৫ মিনিট। আটজনের দলের ছয় জন উপস্থিত। পুরোপুরি। একজন অর্ধেক উপস্থিত। মানে তখনও তৈরি হয়ে উঠতে পারেননি। উঠোনের মাঝে ইতঃস্তত ঘোরাঘুরি করছেন। আর একজনের তো পাত্তাই নেই। ইনিই সেই স্বনামধন্য ইন্দ্রদা। বড়দার (দীপকদা) কথায় ‘গুবলেটেশ্বর’। লেট করে আর গুবলেট করে। এতদিন শুধু শুনেছিলুম। এবারে একেবারে অক্ষরে অক্ষরে এইরূপ নামকরণের হেতু মর্মোদ্ধার করতে পারলুম। সবাই তৈরি। কিন্তু ইন্দ্রদা আসে আর না। ওদিকে সূর্যদেব মাথার উপর চড়ছেন। আর সেই সঙ্গে সবার মস্তিষ্কের পারদও। বিস্ফোরণ হয়-হয় তিনি এলেন। ঘড়ির কাঁটা তখন ৯টার ঘর পেরিয়েছে। বড়দার সঙ্গে একচোট হল। ইন্দ্রদা অফেন্স ইজ এ বেস্ট ডিফেন্স ধরে খেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সকলেই ভীষণ বিরক্ত। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে নরম হয়ে এল।

সেই নাম না জানা ধারা।

দেরি হয়ে যাওয়ায় ঠিক হল আপাতত শুধু গাড়িতে জ্বালানি ভরে এগোনো যাক। দেহযন্ত্রে জ্বালানি আমতায় গিয়েই ভরা হবে। কিন্তু আমতায় গিয়ে বিপদ। সবকিছু যতটা সহজ ভাবা হয়, আসলে তত সহজ নয়। খাবারের দোকান অজস্র, কিন্তু খাবার কোথাও নাই। এক চায়ের দোকানে ঘুগনি-মুড়ি পাওয়া গেল। কিন্তু অনেক দূরের পথ। রাস্তায় আর কিছু জুটবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। কাজেই ঘুগনি-মুড়িতে কাজ চলবে না। আবার খোঁজ শুরু। বহু খুঁজে এক দোকানে পাওয়া গেল। সেখানে বেঁচে থাকা কিছু পরোটা আর কয়েক হাতা ঘুগনি। তাই ঢের। ওই ভাগ করে খেয়ে ফের রওনা। বাবলাদার ভাগে এতই কম ছিল যে দোকানদারকাকু সেটা ফাউই দিয়ে দিলেন।

যাত্রাপথের প্রথম সাঁকো।

এবার আর গন্তব্যের আগে কোথাও থামা নয়। ‘রূপনারানের কূলে জেগে ওঠা’র পরেই গাড়ির চাকা থামবে। এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় এগোনো গেল ফের। কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা তো ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নয়। আর প্রকৃতি যেখানে নিজেই এত উদার, সেখানে দু’দণ্ড না থেমে সেই সৌন্দর্য-সুধারস না চেখে এড়িয়ে যাওয়াই বরং অন্যায়। আমতা থেকে দামোদর পেরিয়ে জয়পুর আসতে রাস্তা একটু ভুল হয়েছিল। একজন বললেন, একটু পিছিয়ে গেলে একটা রাস্তা আছে। সেটা ধরে শিহাগোড়ির মোড় হয়ে সোজা জয়পুর মোড়ে পৌঁছনো যাবে। সেই অনুযায়ী এগোনো গেল। রাস্তার শুরুতেই একটা সাইনবোর্ড। মেছোবিড়ালের পারাপারের জায়গা। একটু এগোতেই যেন মনে হয়, জঙ্গল-সাফারিতে বেরিয়েছি। দু’ধারে ঘন বাঁশবন। কোত্থাও জনমনিষ্যি নাই। এখানে একটু না দাঁড়ালে চলে! দাঁড়ালাম। ছবি তোলা চলল। ছবি-টবি তুলে খানিক এগোতেই অবশ্য ভুল ভাঙল। জায়গাটা জনবিরল নয় মোটেই। বাঁশবন পেরিয়েই বসতি। ছাড়া-ছাড়া, অল্প-স্বল্প।

প্রথম সাঁকোর কাছে নদী তীর।

শিহাগোড়ির মোড়ের একটু আগেই একটা সেতু। নীচ দিয়ে বেশ চওড়া একটা জলধারা প্রবহমান। আমরা ভেবেছিলাম কোনও নদী। কিন্তু তা নয়। স্থানীয় মানুষ নাম বলতে পারলেন না। হতে পারে ওটা কোনও নামবিহীন সেচখাল। একটা ছোট্ট তথ্য দিয়ে রাখি। পাছে ফের পথ ভুল হয় সেই ভয়ে এখান থেকেই ডিজিটাল মানচিত্রের সাহায্যে এগোচ্ছিলাম আমরা। সেই সঙ্গে আরও বেশি নিশ্চিত হতে মাঝে মধ্যেই দাঁড়িয়ে রাস্তার হদিশ নিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। তা সে এক রাস্তা বটে। দু’পাশে আদিগন্ত বিস্তৃত জমি। খোয়া বিছোনো রাস্তা অজগরের মতো এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে মাঝ বরাবর। সেই রাস্তা ধরে ধুলো উড়িয়ে এসে পৌঁছলাম মুন্ডেশ্বরী নদীর পারে। নদীর এপার-ওপার জুড়েছে এক বাঁশের সাঁকো। তখনও বুঝিনি যে সেই বাঁশবন আর এই বাঁশের সাঁকো-সবে শুরু মাত্র। সারাদিনটা শুধুই বাঁশে ভরা।

পৌঁছলাম ভাটোরায়। রূপনারায়ণের পারে।

সাঁকো পার করতে মাথাপিছু দক্ষিণা লাগে। সাঁকোর উপর বাইক চেপে যাওয়া মানা। বাইক হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হয়। আমার আবার উপর থেকে নীচে জলের দিকে তাকাতে ভয়। অতিকষ্টে চোখকান বুজে মনে মনে রাম নাম জপে ওপারে পৌঁছে হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তে শুনি কে যেন ডাকে, ‘ওরে সাঁকোয় উঠে আয়। ছবি তোলা হবে’। এদিকে আমার অবস্থা তখন শাঁখের করাত। ওই ডাক শুনে মনে তো হচ্ছে যেন পরপারের ডাক। কিন্তু ভয় পাই বুঝতে দেওয়া চলবে না। এক পা দু’পা করে এগোচ্ছি সাঁকোর দিকে। তক্ষুনি যাত্রী প্রতীক্ষালয় থেকে একটা কথা কানে আসায় থামতে হল। একজন অন্যজনকে বলছেন, ‘‘ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে কেন রে?’’ ক্যামেরা কাঁধে ছবি তোলায় এর আগে অনেকবার দাদাদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, সে গল্প পড়েছি। কাজেই প্রথমেই যেটা মাথায় এল, ‘‘এবার মনে হয় সবাই মিলে গণধোলাই খাব।’’ ওইখানে সেইমুহূর্তে আমি একা। দাদারা সবাই সাঁকোর উপর। কাজেই দায়িত্ব নিয়ে এই সম্ভাবনার কথাটা বড়দার কানে আমাকেই তুলতে হয়।

ফেরি চলেছে গোপীগঞ্জের দিকে।

ভয় ভুলে ছুটলাম সাঁকোর উপর। ‘‘ও বড়দা, ও বড়দা, এখানে ছবি তোলা বারণ মনে হয়। ওখানে সবাই বলাবলি করছে আমরা ছবি কেন তুলছি!’’ শুনে বড়দা গেল ব্যাপারটা বুঝতে। বোঝা গেল যে ওঁরা ভেবেছিলেন হয়তো এবার এখানে পাকা সেতু হবে। তাই তার সার্ভে করতে সরকারি লোক এসেছে। আমরা তা নই শুনে স্পষ্টই তাঁরা আশাহত হলেন। হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রতি বছর যে জলযন্ত্রণা সহ্য করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের! ওঁদের কাছেই ফের রাস্তার খোঁজ জেনে আবার রওয়ানা হলাম আমরা।

দুই উদ্বোধক। আমার আর সৌমিকের হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাজটা ভালই লাগছে।

পাড়ার ভিতর দিয়ে পথ। কিন্তু সব পথ একই রকম। এই ঢালাই রাস্তার যুগে গ্রামের পথ তার চরিত্র ভুলে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে যেন। অনেক ঘুরে এ গলি সে গলি তস্য গলি হয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে। ভাটোরা ফেরিঘাট। নদীতে তখন ভাটা চলছে। জল অনেক নিচে। পাড়ের নরম কাদামাটিতে কাঁকড়াছানাদের অবিশ্রাম ছুটোছুটি দেখতে দেখতে বড়দা খোঁজ খবর করে জানল ওপারে গেলে চাঁইপাট বলে এক জায়গায় নাকি প্রাচীন মন্দির দেখা যেতে পারে। কিন্তু হাতে সময় কম। ওপারে যাওয়া হবে কিনা সে নিয়ে খানিক আলোচনা চলল। ওপারে যেতে গেলে নদী পেরোতে হবে। ভরসা একমাত্র ভটভটি। পিপের উপর বাঁশ পেতে জেটির মতো বানানো। তার উপর দিয়ে বাইক ঠেলে নিয়ে গিয়ে নৌকায় উঠতে হবে। ব্যবস্থা দেখে তো ছোড়দা (দেবাশিস দাস, দলের নিয়মিত সদস্য নয়, আমার মতোই) বেঁকে বসেছে। কিছুতেই রাজি নয় ওভাবে পারাপারে। বলে ‘তোরা ঘুরে আয়। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। এই ভারী বাইক ঠেলে ওরকম করে আমি যাবোই না।’’ তাকে অনেক বুঝিয়ে বড়দা রাজি করায় যা হোক করে।

দুলতে থাকা জেটি।

ওপারে যাওয়ার আগে বেশ কিছু ছবি তোলা হল। ছবি তুলতে তুলতেই হঠাৎ খেয়াল করলাম নদীতে জল বাড়ছে। আমরা লাফাচ্ছি জোয়ার আসছে, জোয়ার আসছে। স্থানীয় একজন বললেন, এটা বানডাক। জোয়ারের আঞ্চলিকীকরণ বোধহয়। এবার বলি, আমাদের এই ঘোরাটা নিছক ঘোরা ছিল না। এবারে বিশেষ উদ্দেশ্য, দলের জার্সি উদ্বোধন। দাদাদের অনেকদিনের আরও একটা স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ভাটোরার রূপনারায়ণকে সাক্ষী রেখে জার্সি উদ্বোধন হবে। দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে আমাকে আর সৌমিককে (গার্ডবাবুর ভাই, ইনিও আমার মতো প্রথম) একটা করে জার্সি হাতে দাঁড় করিয়ে দিল ক্যামেরার সামনে। তিনজনের হাতে ক্যামেরা। বাকিরা মোবাইলে তাক করে আছে। সবাই বলে এদিকে তাকা। আমার আর সৌমিকের জন্য সে এক জটিল পরিস্থিতি।

চাঁইপাটের শতাব্দী প্রাচীন মন্দির।

এলাকাটার আশ্চর্য এক রূপ আছে। দ্বীপের মতো এলাকা। চারিদিকে নদী ঘেরা। নৌকা নির্ভর জীবন। কিন্তু নদীর পারের একটা সৌন্দর্য আছে। ওপারে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীগঞ্জ। গঞ্জ মানেই একটু জমজমাট এলাকা। সেটা এপার থেকে দেখলেই বোঝা যায়। গোপীগঞ্জের দিকে মুখ করে থাকলে ডানদিকে দূরে একটা জায়গা। আরেকটা বাঁশের সাঁকো দেখা যাচ্ছে। ওটা হুগলি জেলার সঙ্গে মেদিনীপুরের সংযোগ। আবার বাঁদিকে তাকালে ইট ভাটা, নদের আঁকাবাঁকা পথ। ওদিকে বেশ কিছুটা গেলে কোলাঘাট পড়বে। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, নৌকা ভাড়া করলে কোলাঘাট পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনবেন মাঝিরা। আমরা যেদিকটায় দাঁড়িয়ে আছি সেদিকে প্রচুর বাঁশবন। ফাঁকে ফাঁকে ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। আরেক দিকে বেশ জঙ্গল। নদের পাড় দেখলেই বোঝা যায়, বর্ষায় জল অনেকটা দূর পর্যন্ত উঠে আসে। একজন বললেন, পুরো এলাকাটাই জলের তলায় চলে যায়। এখানকার বাসিন্দাদের জীবনে প্রচুর কষ্ট।

নৌকায় বাইক তোলার সেই ঝক্কি।

ওপারে যাওয়ার নৌকায় ঘাটে এসে গেছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, বাঁশের জেটি পেরোতে এবারে আর ভয় করল না। মনে হল, বাঁশ ব্যাপারটায় বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তবে নৌকায় বাইক তোলা আর নামানোটা বেশ একটা দাঁড়িয়ে দেখার জিনিস বটে। ওপারে গেলাম। চাঁইপাটে প্রাচীন মন্দির আছে। ওখান থেকে চার কিলোমিটার। গিয়ে অবশ্য হতাশ হলাম। শুনে গিয়েছিলাম যে ওখানে চারটে প্রাচীন মন্দির আছে। খুঁজে পেলাম না। মন্দির দেখতে চাই শুনে এক ভদ্রলোক তাঁদের পারিবারিক প্রাচীন মন্দির দেখাতে নিয়ে গেলেন। সে দেখে বোধ করি কারও মন ভরেনি। অগত্যা ফেরা। ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় দু’টো। পেটে কিছু দিতে হয়। তবে এবারে আর সকালের মতো ভাগ্য বিরূপ হয়নি। গোপীগঞ্জ বাজারের সামনেই এক বিরিয়ানির দোকান। এসবে আমাদের প্রচুর আগ্রহ। ঢুকে পড়া গেল।

পানশিউলির ঘাটে বাইক নামানোর চেষ্টায়।

এই দলটার দু’একজন বাদে সবাই প্রচুর কথা বলে। পরস্পরের পা টানাটানিও করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মালিকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল। বেরিয়ে এল নাড়ির খবর। মালিক হাওড়ার বাসিন্দা। বাড়ি জয়পুরে। আমরাও হাওড়ার লোক শুনে খুশি হলেন। তিনি আমাদের এলাকার বিএসএনএল টেলিফোন টাওয়ারে কাজও করে এসেছেন। তিনি আবার একটা আনকোরা রাস্তার খোঁজ দিলেন। সেই রাস্তাটাই নাকি খুব সুন্দর। ভাগ্যিস বলেছিলেন। আমরা ফেরার রাস্তা বদলে ফেললাম।

পানশিউলিতে রূপনারায়ণ-মুণ্ডেশ্বরীর সঙ্গমস্থল।

রাস্তাটা খুবই সুন্দর। নদীর পারে গাছগাছালি ভরা বাঁধের রাস্তা। ফেরার কথা ছিল ভাটোরা হয়ে। এবার আমরা যাব হুগলি হয়ে। পৌঁছলাম কৈজুড়ি ফেরিঘাট। আবার সেই রূপনারায়ণের সামনে। ওপারে হুগলি জেলা। এখানকার ফেরিঘাট আরও মারাত্মক। এখানেও সেই বাঁশের জেটি মতো। তবে এবারে আর সেটা পিপের উপর না। কয়েকটা খুঁটির উপর পাতা। জোয়ারের জন্য যার অর্দ্ধেকের বেশি জলের তলায়। খানিক দাঁড়িয়ে বোঝা গেল, নৌকা থেকে জলের উপর দু’টো পাটাতন পেতে দেওয়া হবে। সেই পাটাতনের একটা দিয়ে নিজেকে উঠতে হবে, আর অন্যটা দিয়ে বাইক ঠেলে তুলতে হবে। আবার ছোড়দা নারাজ। কিছুতেই নৌকায় উঠবে না। ঘুরে কোলাঘাট দিয়ে যাবে বলে গোঁ ধরল। এবারেও সেই বড়দাই ভরসা। কোনও রকমে রাজি করালো আবার।

ওই যে ডলফিনের পিঠ।

নদ পার হয়ে হুগলি পৌঁছলাম। জায়গাটার নাম পানশিউলি। একটা বাজার আছে। নাম মাড়োখানা। আসলে জায়গাটা রূপনারায়ণ আর মুন্ডেশ্বরীর মোহনা। মাড়োখানা একদিকে রূপনারায়ণ আর অন্যদিকে মুন্ডেশ্বরী দিয়ে ঘেরা। রূপনারায়ণের ওপারে পশ্চিম মেদিনীপুর। মুন্ডেশ্বরীর ওপারে হাওড়ার উত্তর ভাটোরা। হাওড়া-হুগলির যোগ আবার সেই বাঁশের সাঁকো। তবে দিনের শেষ আর সর্বোত্তম বিস্ময় যে এইখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে তা এক মুহূর্ত আগে অবধি কেউ বুঝিনি।

বাঁদিক থেকে মিস্টার ঘাসপুস, বড়দা, আমি, গার্ডবাবু, ছোটা ডন, ছোড়দা, সৌমিক এবং গুবলেটেশ্বর ইন্দ্রদা।

প্রথম দেখতে পেল ছোড়দা। তবে বুঝতে পারেনি। দলের ছোটা ডন বলে পরিচিত বাবলাদাকে দেখিয়েছিল। বাবলাদা আবার ছিপ ফেলে মাছ ধরায় ওস্তাদ। ও বলল, নদীতে বিশাল বিশাল মাছ আছে। ছোড়দা বড়দাকে বলল। বড়দা নদীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল ওগুলো ডলফিন। শুশুক বলে বাংলায়। জলে ডাইভ দিচ্ছে। তখন আমাদের কী উত্তেজনা। উঠে এলাম বাঁশের সাঁকোয়। এখানে মুণ্ডেশ্বরী একেবারেই শান্ত। কিন্তু রূপনারায়ণে স্রোত আছে। ডলফিনগুলো আছে মুণ্ডেশ্বরীর দিকেই। নদীতে ছোট মাছের বেশ কিছু ঝাঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাবলা বলল, তারই মাছ। ওই মাছগুলোই খাচ্ছে ডলফিনরা। আমার দাদা, যাকে সবাই মিস্টার ঘাসপুস নামে চেনে, আর বড়দা বলল, এগুলো গ্যাঞ্জেস ডলফিন। সরু, লম্বাটে মুখ। দাঁত আছে। মাঝে মাঝেই জেলেদের জালে আটকে পড়ে। মারা যায়। পুরো দলটা দাঁড়িয়ে গেলাম সাঁকোর ওপরে। ছবি তোলা আর শেষ হয় না। বিপন্ন প্রাণী এরা। এত কাছ থেকে দেখব, ভাবতে পারিনি তো!

বাংলার রূপ।

শুশুক দেখার পরে নেমে গেলাম নদীর পাড়ে। সে এক আশ্চর্য পরিবেশ। চরে নোঙর গেঁথে জলে ভাসছে নৌকা। আরেকটু দূরে একটা নৌকায় জাল গুটোচ্ছেন জেলে-মাঝিরা। আরও দূরে রূপনারায়ণে ভাসছে কয়েকটা নৌকা। মাছ ধরার নৌকা। এখানে একসময় ইলিশও উঠত বলে শুনেছি। সূর্যের তেজ ছিল প্রবল। কিন্তু আমাদের ছবি তোলার শেষ ছিল না।

ঘরে ফেরা পাখির দল। আমরাও।

এবার ঘরে ফেরার পালা। সারাদিন যখন সুন্দর কাটে সেই ভালোলাগার রেশ আরও বেশ কিছুক্ষণ জিইয়ে রাখার জন্য বোধহয় সূর্যাস্তটাও নান্দনিক হয়। মেঘের আড়ালে ডুবতে থাকা সূর্যের সামনে দিয়ে পাখিদের ঘরে ফেরা দেখতে দেখতে আমরাও ঘরমুখো হলাম। মেঠোপথ, ঘাসের ফাঁকে শেষ বিকেলের গন্ধ মাখতে মাখতে গোটা একটা দিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাই ভাবছিলাম। প্রায় বর্ষাতেই এইসব জায়গায় বন্যা হয়। যাতায়াত ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরা তো একদিন এসেই এভাবে নদী পারাপারে ভীত। এই মানুষগুলো রোজ এভাবেই বেঁচে আছেন। একটা স্থায়ী সেতু নেই, নৌকায় নিরাপত্তার সরঞ্জামও নগণ্যই। তা-ও জীবনধারণের তাগিদে নিত্য প্রয়োজনে এভাবেই ঝুঁকি নিয়ে চলে নদী পারাপার। হয়তো অভ্যাসে মিশে গিয়েছে। হয়তো মানিয়ে না নিয়ে উপায় নেই।

ছবি— সকলের।

কভারের ছবি— মুণ্ডেশ্বরীতে শুশুকের খেলা

(সমাপ্ত)

One thought on “তিন নদী পেরিয়ে শুশুকের ডাইভ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *