জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

সাতসকালে সুতানে

দীপশেখর দাস

ছুটি পেলেই মনটা জংলি হয়ে উঠে। রোজকার এই ইট-সিমেন্ট-বালির ধূসর জঙ্গল থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা হয়। সবুজের জঙ্গলই তখন টানে। আসলে গাড়ির ভোঁ, কলের ধোঁয়া আর মানুষের কোলাহলকে ফাঁকি দিয়ে একমাত্র ওর ‘হৃদ মাঝারে’ই আশ্রয় নেওয়া যায় শান্তিতে। বেশ কিছুটা সময় নিজেদের উপলব্ধি করা যায় ঐসব নিরিবিলি প্রান্তরে। এই পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাকে আমরা গুরুত্ব দিই বরাবরই। তাই মাঝে মাঝেই উঁকি দিই বাংলার এদিক সেদিক। গতবারের দুর্গাপুজোতেও তার অন্যথা করিনি। আমরা চারজনে গিয়েছিলুম বাঁকুড়ার ঝিলিমিলি। ঝিলিমিলি কেমন করে পৌঁছছিলুম তা আমাদের কেঁদতল-কুসুমতল-ঝিলিমিলি (http://www.jathaichchatathaja.com/2019/11/05/) যাত্রায় বলা আছে। তাই আর সে কথায় গেলুম না।

সে সফরে আমাদের লক্ষ্য ছিল ঝিলিমিলিই। কিন্তু সেখানে পৌঁছে বুঝেছিলুম ঝিলিমিলির কেন্দ্রস্থল একটা বেসরকারি লজ। ঝিলিমিলিকে জানতে গেলে আমাদের বেরোতে হবে কেন্দ্রস্থল থেকে। কোনও বারেই আমাদের ঘর আগাম বুকিং থাকে না। আসলে আমাদের বেশিরভাগ গন্তব্যই ঠিক হয় বেরোনোর কয়েক ঘণ্টা আগে। তখন আর ঘর বুকিংয়ের সুযোগ থাকে না। তাই ওই ‘বিখ্যাত’ বাবুয়ানার লজে আমাদের ঠাঁই হয়নি। খুঁজতে খুঁজতে একটা ঘর জোগাড় হয়েছিল ঝিলিমিলি থেকে কিলোমিটার দুয়েক দূরের পোড়াডিতে। বাড়ির মালিক মনোরঞ্জনবাবু মালপত্র ঢাঁই করে রাখা একটা ঘর পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন আমাদের জন্য।

জঙ্গলমহল নাম যে। গ্রামের পথে তারই ছাপ।

বাড়ির নীচের তলার একটা অংশে তাঁর খাবার হোটেল। রাত্রে খাবার সময় সেখানেই খোঁজ পেলুম সুতানের। একটা গাড়ির খোঁজ আমরা আগেই করে রেখেছিলুম। ফোন করে তাকে জানিয়ে দিলুম সকালে মনোরঞ্জনদার হোটেলে চলে আসতে। আমরা সুতান যাব।

সকাল ৬টায় গাড়ি এল। মারুতি ওমনি’র আধুনিক সংস্করণ ইকো গাড়ি। তখনও আশেপাশের খাবারের দোকান খোলেনি। প্রাতরাশ বাকি রেখেই আমরা গাড়িতে চড়ে বসলুম। বেড়াতে বেরোলে খাওয়া দাওয়ার রীতি মানার নিয়ম আমাদের নেই। যখন যেমন জুটবে তাই পেটের মধ্যে সাঁধবে। সারথি শিবু হেমব্রম গাড়ি ছোটাল সুতানের দিকে।

সুন্দর শৈশব। ওই কৌতূহল, ওই হাসি…বজায় থাকুক…বজায় থাকুক।

রাস্তাটা পিচের হলেও সরু। দুটো চার চাকা গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে না এমন। পাশ দিতে হলে রাস্তা ছেড়ে একটু ধারে ঘাসের উপর নেমে যেতে হয়। শিবু বেশ পোক্ত হাতেই স্টিয়ারিং সামলাচ্ছে। এসব জায়গা তার নখদর্পণে। দু’পাশে সবুজের রাশি। রাস্তা জনশূন্য। হালকা কুয়াশার আস্তরণ ঢেকে রেখেছে দূরের বনপালাকে। সূর্যের রোদ তখনও মাটি ছোঁয়নি। এক অপরূপ স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে চারিদিকে। নি:স্তব্দ সবুজ সমারোহের নৈশব্দ্য ভঙ্গ করছে শুধু ইঞ্জিনের সোঁ সোঁ আর ক্যামেরার শাটারের খিচ খিচ খিচ ধ্বনি।

তাহাদের গৃহতলে।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর পিচ রাস্তা ছেড়ে শিবু সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া রাস্তা ধরল একটা। একটু পরেই কী একটা গ্রামে এসে পৌঁছলুম। নামটা আজ আর মনে নেই। জঙ্গলমহলের গ্রাম তখন সকালের আড়মোড়া ভাঙছে। গ্রাম্য ভিড় তখনও পথে নামেনি। ছাগল-গরুগুলো তখনও খোঁটায় বাঁধা। শুয়োরগুলো খোঁয়ারে বন্দি। শুধু তিন শিশু পথের ধারে পড়ে থাকা চাতালে বই খাতা হাতে পড়তে বসেছে। ছোটবেলায় পুজোর গন্ধ পেলে পড়া লাটে তুলতুম। এরা কি পুজোর গন্ধ পায় না? নাকি রোজকার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সেই গন্ধকে তারা আলাদা করে চিনতে চায় না? উত্তর জানা নেই আমার।

নতুন ওয়াচ টাওয়ার। পর্যটকদের জন্য। পাশে পুরনোটি দুখী হয়ে লুকিয়ে।

ঘণ্টা দেড় দুয়েকের জার্নি। জঙ্গল, গ্রাম, মাঠ আবার জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছলুম সুতানে। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলুম সামনে দুটো ওয়াচ টাওয়ার। একটা সিপাহি ধরনের, লোহা নির্মিত। আর একটা নব নির্মিত,  সিমেন্টের। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য। শিবু জানাল, এক সময়ে এখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সে সেই জঙ্গলমহলের বিপ্লবের সময়ে। সিআরপিএফের তৈরি ওই লোহার টাওয়ার। একটু ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলুম ভগ্নপ্রায়, চালাবিহীন কয়েকটা ঘর। ঘরগুলো যেন একটু ঝলসানো। জানা গেল, ‘ওদের’ কীর্তি। পর্যটন বুর্জোয়া ব্যাপার যে। ঘরগুলো পেরিয়ে চোখে পড়ল একটা ঝাঁ চকচকে বাংলো। নতুন করে কেউ বানিয়েছেন পর্যটনের উদ্দেশ্যে। থাকা যায় নাকি সেখানে। কলকাতা না কোথা থেকে যেন বুকিং করতে হয়।

জলাশয়ের শোভা।

যাক যে এসব কথায় কাজ নেই। আমরা এসব কৃত্রিমতার টানে সুতান ছুটে আসিনি। এসেছি এখানের প্রকৃতির গল্প শুনে তাকে চাক্ষুষ করতে। তার কথাই বলি। সবুজে মোড়া সুতানের সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র একটা বড় ঝিল। ঝিলের আকারটা অনেকটা একটা ইংরাজির ‘এল’ অক্ষরের মত। ঝিলের জলে লাল শালুক ফুটেছে। আর ঝিলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে নানা রকমের গাছ। শাল-পিয়াল-অর্জুন-সোনাঝুরি কি নেই সেখানে। সোনাঝুরিতে তখন ফুল ধরেছে। সবুজ বন ইতিউতি সোনালি ছোঁয়ায় অসাধারণ রূপসী। আর সেই অপরূপ রূপের প্রতিচ্ছবি ফুটে ঝিলের জলও অপূর্ব মোহময়ী। সে রূপের বর্ণনা করার মতো শক্তি কম্পিউটারের কী বোর্ড অর্জন করেনি।

তিনি। প্রাণদায়িনী।

ঝিলের পাশ দিয়ে ঝিরিঝিরি বইছে এক সরু জলে ধারা। সেই জলের ধারাই আশেপাশের অঞ্চলকে সজীব করেছে। বাবলা শিকারি মানুষ। সময় সুযোগ পেলেই ছিপ হাতে মাছ শিকারে বসে পড়ে। ছিপটা যে সঙ্গে আনেনি তাই আফশোস করছে। সে যে খুঁজে পেয়েছে ঝিলের ওপারে কয়েকজন মাছ শিকারে বসেছে। তবে তার শিকারি চোখের উপকারও আমরা পেয়েছি বেশ কয়েকবার। এবারও পেলুম। সে আবিষ্কার করল ঝিলের জলে এদিক সেদিক সাঁতরে বেড়াচ্ছে বেশ কয়েকটা কচ্ছপ। তার আঙুলের অনুসরণে আমরাও দেখতে পেলুম তাদের। একটু করে সাঁতরায় আবার টুপ করে ডুব দেয়। যেন আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে তারা। ছোট-বড়-মেজো, নানা ধরনের কচ্ছপ।

জলাশয়ের শোভা মগ্ন। বাবলা কচ্ছপ দেখাচ্ছে। শিবুও রয়েছে খোঁজে।

ধারার সাঁকো পেরিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলুম। জঙ্গল বেশ ঘন। জঙ্গলের ভিতরে এদিক সেদিক সেনা ছাউনির চিহ্ন স্পষ্ট। ঝিলের পরিবেশ আর ওই কচ্ছপেরা যেন মায়ায় বেঁধেছিল আমাদের। পা নড়তেই চাইছিল না সেখান থেকে। আর কতরকম গাছ ঝিলের পাশে ঢেউ খেলানো জায়গাটায়। আমাকে তো বাবলা, ইন্দ্রদা আর দীপকদা নাম জিজ্ঞাসা করে করে অস্থির করে তুলছিল। প্রকৃতি মুগ্ধ হয়ে আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে ছিলুম সেখানে। অনেকক্ষণ। সম্বিৎ ফিরল শিবুর ডাকে। তাকে আরও কয়েক জায়গায় যাবার জন্যে বলেছিলুম। সে জানাল এখানে এতটা সময় দিলে অন্য জায়গাগুলো দেখা বাকি পড়তে পারে। তবুও এ জায়গার মায়া কাটাতে পারছিলুম না।

গভীর জঙ্গলের দিকে।

এবার আরও গভীর জঙ্গলের দিকে চাইলুম সকলে। শিবু নিয়ে চলল। বেশ খানিকটা গিয়ে দেখি সেখানে আরও একটা ওয়াচ টাওয়ার। তবে বেশ জীর্ণ। শিবু উঠতে চাইল না। তবু আমরা উঠলুম। আমরা মানে বড়দা-আমি আর বাবলা। ইন্দ্রদা বলল, ওর ভার নাকি সিঁড়িগুলো নিতে পারবে না। হবে হয়তো! ইন্দ্রদার এই মহানুভবতা আমরা অনেকবার দেখেছি। একটু উঁচু পাহাড় আর সিঁড়িদের ইন্দ্রদা কষ্ট দিতে চায় না। তবে এ টাওয়ারের মাঝ বরাবর উঠে আমিও থমকালুম। বাকি সিঁড়িগুলো বেশ জীর্ণ আর গার্ডওয়ালহীন। জলের ছোঁয়া পেয়ে শ্যাওলাগুলো সিঁড়িতে সবুজ রং ধরিয়েছে। দেখেশুনে সবথেকে সাহসি বাবলাও থেমে গেল। থামল না শুধু দীপকদা।

সুতানের গভীর জঙ্গলের ভিতরে।

বুড়োটা টাওয়ারের মুড়োয় চড়ল। মোবাইলে ছবিও তুলল বেশ কয়েকটা। টাওয়ার থেকে নেমে উপরের ছবি দেখতে চাইলুম। দেখাল না। আমার কেমন যেন মনে হল দীপকদা গোল গলা টি-শার্টের কলারটা উল্টে নিল একটু।

সাঁকো পেরিয়ে জঙ্গলের পথ।

সুতানের টান ছিন্ন করে ফেরার পথ ধরলুম। অনেকটাই বেলা হয়েছে। অনেক জায়গায় যেতে হবে। ধারা টপকে দেখলুম বাংলোর পাশের মাঠে দু’টো বাচ্ছা মেয়ে কাঠ কুড়োচ্ছে। পুজোর গন্ধ এরাও অনুভব করেনি। কে জানে হয়তো ওদের হাতের ওই কাঠের বহ্নিশিখাই আজকের ভাত-ডালে ফুট ধরাবে।

শৈশবের এই রূপও দেখেছি।

আমরা গাড়িতে উঠলুম। শিবু স্টার্ট দিল।

ছবি— লেখক ও ইন্দ্র

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *