পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

দু’চাকায় বরন্তি, চারচাকায় চরকি— দ্বিতীয় পর্ব

দীপশেখর দাস

পরেরদিন ঘুম ভাঙতে দেরি হল। আগের রাতের ঘুমহীনতা আর সারাদিনের চরকিপাক বেশ ক্লান্ত করেছিল। ১০টা নাগাদ সাইকেলের দোকানে পৌঁছলুম। আমাদের ৭টার পর যেতে বলেছিলেন সাইকেল দাদা। দেরি দেখে চিন্তান্বিত হয়েছিলেন বোধহয় একটু। না হওয়ারও কিছু ছিল না। আমরা না এলে খানিকটা লোকসানই হত। গ্রামে আর সাইকেল ভাড়া কে নেয়! জুতসই চারটে সাইকেল নিয়ে রওনা দিলুম। প্রথমেই পৌঁছলুম মুরাডি স্টেশনের সেই কচুরির দোকানে। গতদিনই এ কচুরি বেশ মুখ সয়েছিল। গরম কচুরি উদরস্থ করে পথের দিশা জেনে নিয়ে প্যাডেলে চাপ দিলুম।

আগেরদিন রিকশায় আমরা গ্রামের পথ ধরেছিলুম। এদিন অন্য পথ ধরলুম। রাস্তাটা রাঙা মাটির। ট্রেন লাইনের পাশ বরাবর। শীতের সকাল, গ্রাম্য পথ। মনের সুখে সাইকেলের চাকা ঘুরে চলল। একের পর এক মাঠ পেরোতে লাগলুম। শীতের ফসল ঘরে উঠেছিল। তাই একটা খালি ভাব জুড়ে ছিল চারিদিকে। গৃহে বাসিন্দা না থাকলে যেমন সেটা নিঃশব্দ প্রেতপুরীর মতো হয়ে যায় বা মানুষ বন্ধুহীন হয়ে পড়লে যে শূন্যতা বিরাজ করে। তেমনই বেরঙা মাঠগুলো তার নৈশব্দ্য, শূন্যতা জানান দিচ্ছিল। শুধু বিস্তীর্ণ প্রান্তরের একপাশে থাকা জলাশয়গুলোই এই মরা গাঁয়ে প্রাণের প্রকাশ করছিল।

চার চরকি।

লোকালয় আর এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর পার করে পাকা রাস্তায় উঠলুম। দূর থেকেই বরন্তির সেই পাহাড় দেখতে পেলুম। রাস্তার পাশেই ছোট খেলার মাঠ। রবিবার ছিল। সকাল থেকেই ছেলের দল ক্রিকেটে মেতেছে। এমন সকাল, এমন পরিবেশ আমরাও রোজ যদি একটু পেতুম।

মুরাডি থেকে বরন্তি আসার এ রাস্তাটা অনেকটাই। ঘণ্টা দেড়েক সাইকেল চালিয়ে বড়ন্তি পৌঁছন গেল। যদিও মাঝে মধ্যেই দাঁড়িয়ে আমাদের ফটো সেশন চলেছে। গল্প গুজব কিছু হয়েছিল পথ চলতি বাচ্ছা বুড়োর সঙ্গে। আলোচনার বিষয় বস্তু আজ আর মনে নেই যদিও। আমি আর শুভ দু’জনেই ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলুম। দু’জনের ক্যামেরাই শাটারের আওয়াজ তুলছিল সময়ে সময়েই। আমাদের স্মৃতিশক্তি কম। তাই সবকিছুই ক্যামেরার স্মৃতিতে বেঁধে নিতে চাইতুম আমরা। বরন্তির আনাচ কানাচও লেন্স বন্দি করার চেষ্টায় মগ্ন হলুম।

মাঠে চলেছে খেলাধুলো।

শীতের শুরু। পর্ণমোচীরা পাতা ঝরানোর উদ্যোগ করতে শুরু করেছে। ভিন্ন রং লেগেছে তাদের পাতায় পাতায়। সবুজ পাতা বুড়িয়ে হলুদ-লাল হয়েছে। চিরসবুজদের সে বালাই নেই। তারা প্রকৃতিকে সবুজ রাখার দায়িত্ব নিয়েছে। আর এই সব সবুজ-হলুদ-লাল মিলেমিশে পাহাড়টা নতুন রূপ নিয়েছে। বসন্তে পুরুলিয়া নতুন রং ধারণ করে শুনেছি। রাঙা মাটির দেশ লাল হয়ে ওঠে শিমূল পলাশের পুষ্প প্রকাশে, জেনেছি। তবু এ রূপকেও খাটো করা যায় না মোটেই।

পাহাড়কে পিছনে ফেলে যে রাস্তাটা বরন্তির ওই খ্যাতনামা বন রিসর্টগুলোর দিকে গেছে সেই পথ ধরলুম। পর্যটক সমাগম হচ্ছে। সঙ্গে রাস্তাঘাটও ভাল হচ্ছে। রাস্তা পাকা করার কাজও চলছিল তখন। সেসব অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলুম সেই সব রিসর্টের সামনে যেখান থেকে আমাদের কাল পত্রপাঠ বিদায় নিতে হয়েছিল। আজও সেসব জায়গায় বড় বড় কোম্পানির বড় বড় গাড়ি। আমাদের চার সাইকেলের আটচাকা এ দৃশ্যে বড়ই বেমানান। রিসর্ট থেকে উঁকি মারা বিস্ময়ের চোখগুলো এ কথাটাই হয়তো জানান দিতে চাইছিল।

বনপথ।

রিসর্টগুলো পেরিয়েই রাস্তা দু’দিকে বেঁকেছে। ডানদিকের পথ ধরে আমরা ঢুকে পরলুম এক আধিবাসী গাঁয়ের মধ্যে। মনোরম গ্রাম। নিজস্ব গুণেই স্বতন্ত্র। বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রামে পাহাড়ের কোলে জঙ্গল পাশে নিয়ে এমন গ্রাম আগেও দেখেছি। এখানেও তেমনটাই। তবুও আমার এমন প্রত্যেকটা গ্রামকে আলাদা রকমই লাগে। যতবারই যত রকমভাবে যেখানেই দেখি না কেন। গ্রামটা পেরিয়ে গেলুম। আবার ফাঁকা মাঠ। মাঠের বুক চিরে এক ক্ষীণস্রোতা। বরন্তির ড্যামের জলাশয়ের থেকেই বোধহয় বয়ে এসেছে। এই রুক্ষতার মাঝে বয়ে এনেছে এক চিরন্তন সজীবতা। লাল-সাদা শালুক জীবন পেয়েছে এই জলেই। রঙিন করেছে প্রকৃতিকে।

বিস্তারিত বরন্তি জলাধার।

শীতকাল হলেও রোদ্দুর বেশ চড়া। দুপুরে খাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমরা ফিরতি পথ ধরলুম। আধিবাসী গ্রাম পেরিয়ে রিসর্টের রাস্তার দিকে না গিয়ে আমরা সোজা পথ ধরলুম। এ পথ জঙ্গলের। শাল-সেগুন-পিয়াল-হিজল-অশ্বত্থ-বটের মিলিত প্রচেষ্টায় সবুজ হয়েছে চারিদিক। এই চিরহরিৎদেরই বুক চিরে রাস্তা চলেছে। এ পথ আরামের—চোখ, মন দুয়েরই। সে পথে সাইকেল চালিয়েছি। চলেছি বহুক্ষণ। এ পথ ছাড়তে ইচ্ছা করে না। তবু ছাড়তে তো হবেই। ফিরতে হবে নিশ্চিত আশ্রয়ে। আজ রাতেই ফেরার ট্রেন ধরতে হবে আসানসোল থেকে।

সুন্দর পাড়া।

পথে একজনকে পেলুম। তিনি পথ বাতলে দিলেন। খানিক এগোলেই পাকা রাস্তা। ন্যাশন্যাল হাইওয়ে। সে পথ ধরে গেলেই মুরাডি পৌঁছন যাবে। পথ মাঝে নাকি এক ধারা আছে। তা-ও দেখা যেতে পারে। তবে আর কী! আবার প্যাডেলে চাপ। নতুন উদ্যমে।

ধারার ধারাপাত যদিও চোখস্থ করার নয়। একটা বড় ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে ধারার পথ গেছে। বড় বড় লরি চলেছে সে পথে। ক্ষণে ক্ষণে ধুলোয় ভরে যাচ্ছে চারিদিক। ধোঁয়া আর ধুলোয় ধূসর হয়ে আছে চারিদিক। তবুও আমরা গিয়েছিলুম। কী দেখলুম! সেই এক দৃশ্য। প্রকৃতির স্বাভাবিক আশ্চর্যকে মানুষিক রূপদান। জলের ধারাকে পছন্দসই পথে বাঁধা। আর সেই বাঁধানো পথের পাশেই মন্দির স্থাপন। মানুষের এ এক আশ্চর্য প্রতিভা।

পাহাড়তলির বাঁকে।

সন্ধ্যা নামছিল। আমরাও ফেরার পথ ধরলাম। পাহাড়ে সূর্যাস্তটা বোধহয় সবখানেই রোমাঞ্চকর হয়। রোমাঞ্চ আমাদের একটু বেশিই হয়েছিল। রাস্তার পাশেই অনেক খেজুর গাছ। খেজুর রস নামাচ্ছিলেন একজন। গুড়ের জন্যেই নামানো যদিও। বিকেলের রসে নাকি সকালের মতো মিষ্টতা থাকে না। তবুও চেখেছিলুম। খানিক আগিয়েই দেখলুম রসে জ্বাল দেওয়া চলছে। সে জাল কেটে ফিরলুম। গুড় বাড়ি নিয়ে আসার উপায় ছিল না। সাইকেল যথাস্থানে জমা দিয়ে কিছু পেটে ফেলে ঘরে ফিরলুম।

সুদূরের টানে।

বরন্তির রূপ দেখা হয়েছিল। রাতেই মুড়াডি থেকে ট্রেন ধরলুম। আসানসোল হয়ে ব্যান্ডেলে খানিকটা সময় কাটিয়ে ভোর রাতের লোকাল ধরে হাওড়া ফিরলুম।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *